ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: আবার দ্বিজেন টুডুর সঙ্গে দেখা হলো।দ্বিজেন টুডুর সঙ্গে প্রথম দেখা ২০১৬ সালের ৭ নভেম্বর। আবার দেখা হলো প্রায় দুবছর পর ৯ সেপ্টেম্বর। প্রথম দেখা হয়েছিল একটি হাসপাতালে। এবারও দেখা হলো আরেক হাসপাতালে।
দুবছর আগে চোখে গুলিবিদ্ধ দ্বিজেনকে ঢাকার শেরেবাংলা নগর চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে নিয়ে এসেছিলেন পুলিশের দুজন সদস্য। সঙ্গে ছিলেন বোন মার্থা টুডু। দিন দশেক আসা-যাওয়ার মাঝে ওই অসহায় ভাই-বোনের সঙ্গে অনেক কথা হয়েছিল তখন।
এবার ৯ সেপ্টেম্বর দ্বিজেন ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে এলেন পুলিশ ছাড়াই। দ্বিজেন এখন জামিনে। এবার তাঁর সঙ্গে এলেন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার আহত আরও ছয় অধিবাসী। অনেক দিন ধরে তাঁদের চিকিৎসা চলবে এবার।
প্রথম দেখায় দ্বিজেনকে গুলিবিদ্ধ দেখেছিলাম। এবার দেখলাম গুলিবিদ্ধ সেই চোখ চিরতরেই নষ্ট হয়ে গেছে। শরীরে এখনো রয়েছে অসংখ্য ছররা গুলি। দুবছরের যন্ত্রণাকাতর জীবনের ছাপ তাঁর চোখে-মুখে।
শরীরে গুলি নিয়ে জীবনযাপন
গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের ছয়তলায় দেখলাম, দ্বিজেনের সঙ্গে আসা চরণ সরেনেরও মাথায় ছররা গুলি ঢুকে আছে। বিমল কিস্কুর পায়ের দুই জায়গা গুলিতে থেঁতলে আছে। ক্রাচে ভর দিয়ে কষ্ট করে হাঁটেন বিমল। বুকের পাঁজর গুলি ভেদ করে গেছে হোপনা মুর্মুর। প্রায় পঙ্গু তিনিও। মাঝি হেমব্রম, মাইকেল মার্ডিরও শরীরের এখানে-সেখানে অনেক ছররা গুলি আটকে আছে দুই বছর ধরে। এই দলের নারী সদস্য আহত মুংলি টুডুরও মাথায় ছররা গুলি ঢুকে আছে। তাঁদের সঙ্গে দেখাশোনা করতে এসেছেন দুই বাঙালি স্বপন মিয়া ও জাফরুল ইসলাম প্রধান। বাংলাদেশের ভেতরে-বাইরে অনেকেই এখানকার ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বনাম বাঙালির সংঘাতের কাহিনি শোনান হামেশা। কিন্তু তাঁরা যদি একবার দেখে যেতেন কীভাবে জাফরুল আর স্বপন হাড্ডিসার দ্বিজেন-বিমল-মুংলিদের আগলে রাখছেন দিনের পর দিন! এ এক অসাধারণ মৈত্রী ও যৌথ সংগ্রাম। দুই বছর ধরে নানাভাবে দেখছি। গাইবান্ধার বাঙালি-আদিবাসী রক্ত দিয়ে অসাধারণ এক বন্ধন গড়েছে। নিশ্চিত জানি ঘৃণাজীবী প্রচারকেরা তার খোঁজ জানে না এবং এর ঐতিহাসিক মর্ম বুঝতেও অক্ষম।
যেভাবে দুটি বছর পার হলো
পাশাপাশি ছয়টি বেডে শুয়ে থাকা দ্বিজেনসহ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ছয়জনই জানালেন, তাঁদের বিরুদ্ধে এখনো তিন থেকে আটটি করে মামলা আছে। কারও বিরুদ্ধে তিনটি, কারও পাঁচটি, কারও বিরুদ্ধে সাতটি। পেনাল কোডের বহু ধারার রাষ্ট্র এঁদের বাঁধতে তৎপর। হাইকোর্ট জামিন দিয়ে সাময়িকভাবে সেটা থামিয়েছেন মাত্র। হাসনাত কাইয়ূম, জ্যোতির্ময় বড়ুয়াসহ কয়েকজন তরুণ আইনজীবী আইনগত সহায়তার কাজটি করছেন।
ইতিমধ্যে পূর্বপুরুষের দাবিকৃত জমি থেকে উৎখাত এঁরা সবাই। গাইবান্ধার মাদারপুরের জয়পুরে তাঁবু খাটিয়ে আছেন এসব উদ্বাস্তু আদিবাসী-বাঙালি প্রায় দুবছর হলো। চরম খাদ্যাভাব এখন জয়পুরের উদ্বাস্তুদের ওই ‘তাঁবুপাড়া’য়। তবু হারানো জমির পাশেই পড়ে আছেন তাঁরা। প্রায় ১২০টি বাঙালি এবং ৩৩০টি আদিবাসী পরিবার আছে সেখানে। একদিন পূর্বপুরুষের ভিটায় আবাদ দেবেন—এই স্বপ্নের চেয়ে আর বেশি কোনো চাওয়া নেই তাঁদের। জমিনে সবুজ উদ্ভিদ ফলানোর বাইরে আর কিছু শেখেননি এসব দরিদ্র চাষি। কিন্তু গুলি আর মোকদ্দমায় ছিন্নভিন্ন শরীরে পরের জমিতেও খাটতে অক্ষম তাঁরা। এত পরিবার একসঙ্গে উদ্বাস্তু হওয়ায় এলাকায় কাজেরও অভাব পড়েছে। ফলে বিমল-মুংলি-মাইকেলদের ঘরে রান্না হয় কদাচিৎ। ৫ নং সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শাকিল বুলবুল, গোবিন্দগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ, স্থানীয় এমপি আজাদ সাহেব কিংবা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এই দুর্ভিক্ষাবস্থার কোনো দায় নেই যেন। কেউ তাঁরা গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমিসংগ্রামীদের পাশে নেই। জাতীয় রাজনীতি ও বুদ্ধিজীবিতার কাছেও এটা কোনো এজেন্ডা আকারে হাজির নেই আর। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে আন্দোলনের অভিভাবক শাহজাহান আলী মারা যাওয়ার পর রক্তাক্ত এই জমিযুদ্ধ বৈরী নির্যাতনের যন্ত্রণায় ডুবে গেছে অনেকখানি।
১৮৪২ একর জমিতে অধিগ্রহণের আগুন
জাতীয় এবং প্রান্তিক নানান প্রচারমাধ্যমে দুই বছর আগে গাইবান্ধার ক্ষুদ্র জাতিসত্তা-বাঙালিদের ১৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমির লড়াইয়ের প্রসঙ্গটি এসেছিল বারবার। রংপুরের মহিমাগঞ্জ চিনিকলের জন্য এই জমি অধিগ্রহণ করা হয় পাকিস্তান শাসনামলে কয়েকটি গ্রামের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা লোকজন-বাঙালিদের উচ্ছেদ করে। শর্ত ছিল, জমিতে শুধু মিলের জন্য আখ চাষ হবে। মিলের প্রয়োজন না থাকলে জমি মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে (সারেন্ডার করা হবে)। ১৯৬২ সালের ৭ জুলাই এই মর্মে তখনকার সরকার ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের মধ্যে চুক্তিপত্র হয়। তার পরের কাহিনি এ রকম: ২০০৪ সালে এসে চিনিকলটি লে-অফ ঘোষিত হয়। কিন্তু এরপরও চিনিকলের কর্তারা জমির সুবিধা ভোগ করছিলেন স্থানীয় প্রভাবশালীদের ইজারা দিয়ে। চুক্তির বরখেলাপ হিসেবেই সেখানে ধান-সরিষা-আলু ইত্যাদি আবাদ হতো। পরে সেখানে অর্থনৈতিক জোন করার প্রস্তাব ওঠে।
এ রকম পটভূমিতেই ওই জমির পুরোনো মালিকদের উত্তরপুরুষেরা অধিগ্রহণ করা জমি ফেরতের আন্দোলনে নামেন। একপর্যায়ে ২০১৬ সালের শেষার্ধে উত্তরপুরুষ মালিকানার দাবিদার ক্ষুদ্র জাতিসত্তা-বাঙালি পরিবারগুলো ছোট ছোট কুঁড়েঘর বানিয়ে দাবিকৃত ভূমির দখল নেয়। আর তাদের উচ্ছেদে ওই বছর ৬ নভেম্বর পুলিশি অভিযান চালানো হয়। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় কুঁড়েঘর, পাঠশালাসহ সব স্থাপনায়। শ্যামল হেমব্রম, রমেশ টুডু ও মঙ্গল মার্ডি মারা যান গুলিতে।
তারপর থেকে ওই জমিতে কাঁটাতারের বেড়া। আর জমির দাবিদার মানুষগুলো কেউ স্বজন হারিয়ে, কেউ আহত হয়ে আশপাশে, দূর-দূরান্তে ছিটকে পড়ে আছেন। অনেককে তাৎক্ষণিকভাবে কারাগারে যেতে হয়। অনেককে হাতকড়া পরে হাসপাতালে। এর মাঝেই সাঁওতাল বস্তিতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় মানবাধিকার কমিশনসহ অন্তত তিনটি সংস্থা তদন্ত করে। সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিওতে এবং হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও কৃষ্ণা দেবনাথের বেঞ্চে অ্যাটর্নি অফিস যে রিপোর্ট পেশ করেন, তাতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কয়েকজন সদস্যের দরিদ্র ভূমি দাবিদারদের ঘরে আগুন দেওয়ার স্বীকৃতি ছিল। এর কোনো ন্যায়ানুগ বিচার হয়নি। জমিতে উচ্ছেদ হওয়া মানুষগুলোর পুনর্বাসনের বিষয়ও আজও অনিশ্চিত। কাঁটাতারে ঘেরা জমি ও পুকুরগুলো যথারীতি চিনিকলের প্রভাবশালীরা ভোগদখল করে যাচ্ছে। উৎখাত হওয়ার আগে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা-বাঙালি পরিবারগুলো যে আবাদ করে এসেছিল, সেই ফসলও কেটেছে অন্যরা।
বিমল কিস্কু তাঁর বিধ্বস্ত পায়ে শুধু হাত বুলান
রাষ্ট্রের কাজ জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়া। অথচ রাষ্ট্র যখন জনগণের ঘরে আগুন দেয়, তখন যা যা করণীয়, সেটা সাপমারার দরিদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তা লোকজন-বাঙালিরা কিছুই করতে পারে না। তারা বিষণ্ন হয়ে ঘোলাটে চোখে ক্ষতস্থানে হাত বুলায় আর ক্ষুধার কথা ভাবে। অনেকেই এখন জানে না, সর্বশেষ কবে পেটপুরে খেয়েছিল। বিমল কিস্কু বেডে শুয়ে শুয়ে শোনাচ্ছিলেন কীভাবে আগুন ও গুলির পর তাঁর সপ্তম শ্রেণিতে পড়া ছেলে স্বপন স্কুল ছেড়ে কাজকর্মের খোঁজে নেমে পড়ল। কিন্তু পাঁচজনের সংসার তাতে চলে না। দ্বিজেনের ছয়জনের পরিবার চলছে মায়ের চায়ের দোকানটি থেকে। তাতে দিনে বিক্রি ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। তাতে খরচ বাদ দিয়ে থাকে ৩০ টাকা। এ দিয়ে চলছে পুরো পরিবার। দ্বিজেন অবশ্য আশাবাদী। তিনি কবিরাজি করে টিকে থাকতে চান। অন্ধ চোখের হতাশা ভুলতে চান নতুন কর্মোদ্যমে। কিন্তু জমির লড়াইয়ের কী হবে, সেটা জানে না কেউই। বাবার মৃত্যুর পর জাফরুল ইসলাম প্রধান এই সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ যেন দায়িত্বের পরম্পরা। তাঁরা তাঁদের পূর্বপুরুষের ভিটা ফিরে চান। আইন-আদালত-প্রশাসন-প্রচারমাধ্যমকে তাঁরা পাশে চান। কিন্তু জমির লড়াই যে রীতিমতো শ্রেণিযুদ্ধ। ইতিমধ্যে ওই জমির দিকে দৃষ্টি পড়েছে দেশি-বিদেশি অনেকে ‘বিনিয়োগকারী’র। কথিত বিনিয়োগকারীরা ওই জমিতে রাষ্ট্রের লাগাতার উন্নয়নের স্বপ্ন ফলাতে চায়। কিন্তু মাঝি হেমব্রম আর মুংলি টুডু প্রায় ২৩০ কিলোমিটার দূরে ঢাকায় গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের ছয়তলায় ২৩ আর ২৪ নম্বর বেডে শুয়ে শুয়ে ভাবেন, সুস্থ হয়ে ফিরে গিয়ে আবার সবাই মিলে দখল নিতে যাবেন বাপ-দাদার ভিটা। নিজের জমির চালে একবার অন্তত দুপুরের খাবার খেতে চান তাঁরা। মুংলি আর মাঝি হেমব্রমের এই পুরোনো স্বপ্নের কথা জানে জয়পুরের গির্জা দুটোর পুরোনো ঘণ্টাও। আগুন লাগার দুবছর পরও তারা নিরন্তর বেজে চলেছে তাঁবুবাসী মানুষগুলোর আশা-হতাশা-দীর্ঘশ্বাসের মতোই।