বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাজ্য সরকারের দেয়া ২০২০ সালের প্রতিবেদনকে ‘বানোয়াট’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।সমসাময়িক বিষয়ে সোমবার (১২ জুলাই) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে যুক্তরাজ্যের প্রতিবেদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘(যুক্তরাজ্য) নিজের দেশের অবস্থা ভালো করতে পারেনা, অন্যরে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে।’পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা চাই, তারা যে তথ্য দেবে তা যেন তথ্যনির্ভর হয়। তা না হলে, এটা যদি বানোয়াট হয়, তাহলে গ্রহণযোগ্য হবেনা। এটা তখন মনে হবে, তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটা করেছে। দিস ইজ নট গুড। তাদের প্রথমে নিজেদের ফেস দেখা উচিত। তারপর মাতব্বরি করলে ভালো হয়। একই অবস্থা দেখি আমেরিকানদের ক্ষেত্রেও। আমার কাছে হিসাব আছে, ২০২০ সালে আমেরিকাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে ৮৫ হাজার। আমাদের বছরে ছয় থেকে সাতশ। সব মিলে ৯ হাজার। এটা কল্পনারও বাইরে। তারা আমাদের উপদেশ দিতে আসে।’মানবাধিকার ও গণতন্ত্র-সম্পর্কিত ২০২০ সালের ‘ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস রিপোর্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে উপস্থাপন করা হয়।গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের অভিযোগ আনা হয়েছে। এতে বিচারবহির্ভূত হত্যা, মৃত্যুদণ্ড, গুম ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টিও উল্লেখ আছে।
প্রতিবেদনে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ থাকা এমন ৩২টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।এতে বলা হয়, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিরোধীদলীয় প্রার্থীর ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও হামলার অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক মিশনের সমালোচনা করেছিল বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।প্রতিবেদনে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়। তবে এক্ষেত্রে কোনো সমালোচনা করা হয়নি। প্রতিবেদনটিতে খালেদা জিয়াকে দেশে থেকে চিকিৎসা এবং বিদেশ ভ্রমণ না করার সাজা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত উল্লেখ করে বলা হয়, কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও তিনি ২০২০ সালে ঢাকায় ‘গৃহবন্দি’ ছিলেন।২০২০ সালে দেশে ‘ক্রসফায়ার’ ও নির্যাতনের ঘটনাসহ ২২৫টি বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে বলেও যুক্তরাজ্যের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। আনা হয় ২০২০ সালের আগস্টে কক্সবাজারে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের নিহত হওয়ার ঘটনাটিও।
প্রতিবেদনে ওই বছরে অন্তত ৩১ জনের গুম হওয়ার খবর পাওয়ার কথাও জানানো হয়। বলা হয়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের কারণে রিপোর্টার্স উইথাউট বর্ডারসের প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫১তম।ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৪৮১ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ১৯৮টি মামলা; ৪১টি মামলায় ৭৫ জন সাংবাদিককে আসামি করা এবং অন্তত ৩২ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের কথাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের ৫৩ দিন নিখোঁজ থাকার পর ভারত সীমান্তের কাছে উদ্ধার এবং তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টিও যুক্তরাজ্যের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।এ ছাড়া, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়ে হামলা, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ নিয়ে ম্রো সম্প্রদায়ের বিক্ষোভ, নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়গুলোও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, ‘আবার যুক্তরাজ্যের কথা বলি। তাদের জনসংখ্যা মাত্র ৬০ মিলিয়ন। আমাদের ১৬০ মিলিয়ন। তারা আসে আমাদের উপদেশ দিতে। বৃটিশ ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার স্বীকার করেছেন, তাদের প্রতিবেদন নির্ভুল ও তথ্য নির্ভর হওয়া উচিত। তিনি তা তার হেড কোয়ার্টারকে জানাবেন।ধনী দেশগুলোতে অহরহ মানবাধিকার লঙ্ঘন হলেও সেসব ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের নির্লিপ্ততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আপনারা তাদের অন্যায়, বিশৃঙ্খলা নিয়ে লেখেন। আপনারা রিপোর্ট করেন না কেন। তাদের টাকা পয়সা আছে। দুনিয়ার সব দেশে ভালো-মন্দ আছে। কেউই ফেরেশতা না। ভালোমন্দ আছে বলেই আমরা বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্ট, গেম, টেম, স্পোর্টস, অমুক তমুক তৈরি করেছি। তারা খামোখা দোষারোপ করার জন্য একটা কথা বলে দিল। তাদের রিপোর্টে যদি সত্যিই কিছু থাকতো তাহলে আমরা তা থেকে শুধরানোর চেষ্টা করতাম। যাদের নিজেদেরই এত দুর্গতি, এত সুন্দর একটা সোসাইটি থাকার পরও যারা নিজেরা তা কন্ট্রোল করতে পারেনা, তারা আসছে উপদেশ দিতে।যুক্তরাজ্যের প্রতিবেদন নিয়ে রোববার ঢাকায় দেশটির ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার জাভেদ প্যাটেল ডেকে পাঠায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।এতে বলা হয়, বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয়ে যুক্তরাজ্যের প্রতিবেদনে গভীর হতাশা প্রকাশ করেছে সরকার। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রকৃত মানবাধিকার পরিস্থিতি ফুটে ওঠেনি।