আলাপের পয়লা কোনো লেখককে আপনি যখন ফ্যাশন নিয়ে প্রশ্ন করবেন, তখন কি তিনি খুশি হবেন, নাকি বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে মনে মনে বলবেন, লেখালেখি নিয়ে প্রশ্ন না করে এসব কী! হ্যাঁ, ঝুঁকিটি আমরা নিয়েছিলাম। পৌষের সকালে তরুণ কথাসাহিত্যিক তাহমিমা আনামের সঙ্গে কথোপকথনের সূচনায় যখন বললাম, ‘শুরুতে আপনার ফ্যশন নিয়ে কথা বলি। ফ্যাশনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক মানুষেরই তো নিজস্ব একটি শৈলী রয়েছে…।’ কথাগুলো শুনে তাহমিমা চুপচাপ, গম্ভীর। ঘরজুড়ে সে সময় নেমে এসেছে নিস্তব্ধতা। স্থান: গুলশানে তাহমিমাদের বাসা। তারিখ: ৫ জানুয়ারি ২০১৯। সময়: বেলা ১১টা।
‘ফ্যাশনের ক্ষেত্রে ওইভাবে নির্দিষ্ট কোনো ধারা মেনে চলি না আমি।’ নীরবতা ভেঙে তাহমিনার প্রথম কথা।
দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গেল বছরের মে মাসে প্রকাশিত হারপার’স বাজার ইন্ডিয়ার প্রচ্ছদে ছিল উপমহাদেশের তিন তরুণ নারী লেখকের ছবি। যাঁরা ইংরেজি ভাষায় লিখে বহির্বিশ্বে দারুণ আলোচিত। তিনজনের একজন বাংলাদেশের তাহমিমা আনাম, আ গোল্ডেন এজ লিখে ২০০৮ সালে জিতে নিয়েছিলেন কমনওয়েলথ পুরস্কার। পরে লিখেছেন আরও দুটি বই—দ্য গুড মুসলিম ও দ্য বোনস অব গ্রেস। বাকি দুজন—পাকিস্তানের সংস অব ব্লাড অ্যান্ড সোর্ড বইয়ের লেখক ফাতিমা ভুট্টো এবং ভারতের তিশানী দোশি, কান্ট্রিজ অব দ্য বডি উপন্যাস দিয়ে সাহিত্যের মঞ্চে যাঁর অভিষেক।
অভিজ্ঞতাটা অদ্ভুত
ফ্যাশন সাময়িকীর ব্যক্তিত্ব হিসেবে উপস্থাপিত হওয়ার পরও সত্যিই আপনি ফ্যাশনসচেতন নন? আমাদের প্রশ্ন। বাজার-এ আপনাকে দেখে কিন্তু তা মনে হয়নি।
এতক্ষণের গাম্ভীর্য গলে খানিকটা হাসির রেখা ফুটল তাঁর মুখে, ‘ফ্যাশন নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাই না আমি। সাজসজ্জা নিয়ে আমার কোনো রুটিন নেই। মেকআপ করি না, তা বললে ভুল হবে। বরং বলা যায়, করতে পছন্দ করি না। কখনো যদি করিও, তা সাধারণভাবেই করি। আরাম দেয়, এমন কিছুতেই স্বচ্ছন্দবোধ করি। যেহেতু আমি দুই সন্তানের মা, তাই দুটো বাচ্চা সামলে ফ্যাশনের দিকে মনোযোগ খুব কমই দিতে পারি।’
তাহমিমার কথা শেষ হলে আমাদেরও মনে পড়ল, রুমি ও রোকেয়া নামে পাঁচ ও দুই বছর বয়সী দুসন্তানের মা তিনি। তাঁর স্বামী রোলেন্ড ল্যাম্ব লন্ডনের একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। অবকাশ কাটাতে তাহমিমা সম্প্রতি লন্ডন থেকে দেশে এসেছিলেন বাবা-মায়ের কাছে। আমরা যেদিন তাঁর সঙ্গে কথা বলছি, এর পরদিনই এ লেখকের ফিরে যাওয়ার কথা লন্ডনে।
: বাজার ইন্ডিয়া আপনাদের তিন সাহিত্যিককে মডেল করে বিশেষভাবে ফটোশুট করল, আর উপমহাদেশের কোন কোন নারী লেখক আপনাদের অনুপ্রাণিত করেছেন, তা নিয়ে আবার লিখতেও বলল আপনাদের। সাময়িকীটি সচরাচর তো এমনটি করে না। সব মিলিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
: বাজার-এর সম্পাদক একদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। বললেন, আমাদের নিয়ে একটি কাজ করতে চান। তারপর তো…
কথা শেষ করেন না তাহমিনা। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি এই ‘তারপর তো…’ বাক্যাংশের মধ্যই লুকিয়ে আছে ফটোশুটের কাহিনি।
: আপনি তো পেশাদার মডেল নন, কেমন লাগল ফটোশুট করতে?
: ফটোশুট হয়েছিল লন্ডনের ল্যাংহাম হোটেলে। আমি খুব সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। মেকআপ করি না, চুল সাজাই না। বলতে পারেন, আমার জন্য এটা একটু অদ্ভুত অভিজ্ঞতাই। আমাদের তিনজনের কিছু একক ছবি তোলা হলো, দলগতভাবে তোলা হলো কিছু ছবি। চারটি ছবির মধ্যে তিনটি ছিল দলীয় আর একটি একক। প্রায় সারাক্ষণই পোশাক বদলাতে হয়েছিল আমাদের। তাই সময়টাও একটু বেশি লেগেছিল। প্রতিটি শট নিতে ধরুন আধ ঘণ্টা-এক ঘণ্টা সময় লেগেছিল। করিডর ধরে হেঁটে যেতে একটি ছবি তোলা হয়েছিল। সেটি তুলতে বেশ সময় লেগেছিল। প্রচ্ছদের ছবি তুলতেও অনেক সময় লাগল। কেননা, কে কোথায় দাঁড়াবে, কীভাবে দাঁড়াবে—এগুলো ঠিক করতে করতেই অনেক সময় লেগে গেল। এভাবে সারা দিন চলে গেল এখানেই। গিয়েছিলাম ভোর ছয়টায়, আর বের হতে হতে সন্ধ্যা ছয় কি সাতটা। একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা বলতে পারি। ফটোশুটের ওই দিন আমরা সারা দিন কিছুই খাইনি। কেবলই কাজ আর কাজ, এই করিডরে যাচ্ছি তো এই আবার ঘরে। আমাদের সঙ্গে আলোকচিত্রী নরবার্ট নিয়াত—এভাবে দিন যখন প্রায় যায় যায়, প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়ে গেল আমার। কাছের একজনকে বললাম, দয়া করে আমাকে পাশের দোকান থেকে একটা স্যান্ডউইচ এনে দিন। এনে দিল। তারপর আমি ওটা খেলাম। বাকিরা কেউই সারা দিনে কিছুই খায়নি।
: এ তো দুঃখের অভিজ্ঞতা, মজার কোনো ঘটনা নেই?
* বাংলাদেশি কথাসাহিত্যিক
* বাবা: দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম
* মা: মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম
পড়াশোনা
* যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃতত্ত্বে পিএইচডি
* যুক্তরাজ্যের লন্ডনের রয়েল হলওয়ে কলেজে সৃজনশীল লেখালেখির ওপর পড়াশোনা
বই
* আ গোল্ডেন এজ (২০০৭)
* দ্য গুড মুসলিম (২০১১)
* দ্য বোনস অব গ্রেস (২০১৭)
পুরস্কার
* আ গোল্ডেন এজ উপন্যাসের জন্য ‘কমনওয়েলথ সেরা প্রথম বই পুরস্কার ২০০৮’
* ‘গার্মেন্টস’ গল্পের জন্য ও’হেনরি পুরস্কার ২০১৮
এবার ও হেনরি পুরস্কারপ্রাপ্ত গল্পকার তাহমিমা আনাম আরেকটু সহাস্য। হাসির রেখাকে আরও খানিকটা দীর্ঘ করতে করতে বললেন, ‘সাদা রঙের যে পোশাকগুলো আমাদের জন্য রাখা হয়েছিল, ওগুলো ছিল আসলে আমার চেয়ে আরও লম্বা উচ্চতার নারীর জন্য। পোশাক নিয়ে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল, সব পোশাক মানাচ্ছিল না আমাকে। তবে নানা হাঙ্গামা সত্ত্বেও ওই দিনটা খুব আনন্দে কেটেছে। আমি, তিশানি ও ফাতিমা নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলেছি, তাঁদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলেছি, সমসাময়িক অন্যান্য সাহিত্যিককে নিয়েও কথা বলেছি।
তাহমিমা এমনভাবে বলছিলেন, সেই সময়টি যেন তাঁর চোখে এখনো ভাসছে। সেই সময় থেকে তাহমিমাকে এই সময়ে নিয়ে এল ছোট্ট একটি প্রশ্ন, আপনার প্রিয় পোশাক কী?
‘যখন যে পোশাকে স্বচ্ছন্দবোধ করি, তা-ই পরি। তবে কোনো অনুষ্ঠানে গেলে অবশ্যই আমার প্রথম পছন্দ শাড়ি। ঢাকার অরণ্যের শাড়ি আর জামদানি—সাধারণত এ দুরকম শাড়িই পরতে পছন্দ করি। শাড়ির মাধ্যমে আমি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারি।’ একনিশ্বাসে বলে গেলেন তাহমিমা।
লেখালেখি ও পরিবার
তাঁর ব্যক্তিগত দিনযাপনের খোঁজখবর নিতে চাইলাম আমরা। এ ক্ষেত্রে তাহমিমা উত্তর দিলেন ঠিক ঠিক ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে, ‘আমি থাকি পূর্ব লন্ডনে। ভোর পাঁচটা-ছয়টার মধ্যে রুমী আর রোকেয়া ঘুম থেকে উঠে পড়ে। তাই আমিও উঠে পড়ি। খানিক বাদে রুমীকে স্কুলে নিয়ে যাই। সংগীতের ওপর জোর দেয়, এমন একটি স্কুলে পড়ে ও। এসব করে ঘরে ফিরতে ফিরতে সকাল নয়টা। এরপর থেকে দুপুরের খাবারের আগ অব্দি আমার লেখার সময়। পরে সন্ধ্যার দিকে আমার স্বামীর প্রতিষ্ঠানে বসি। মাসে একবার নাটক দেখতে যাই—এভাবে রুমী-রোকেয়া, লেখালেখি আর পারিবারিক কাজকর্ম করতে করতেই চলে যায় দিন।’
তাহমিমা একজন লেখক, একজন মা; যিনি তাঁর ছেলের নাম রুমী রেখেছেন পারস্যের কবি জালালুদ্দীন রুমীর নামে, অন্যজন মেয়ে রোকেয়ার নাম রেখেছেন নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের নামে।