২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি, বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি কলঙ্কিত অধ্যায়। ১৩ বছর আগে ২০০৯ সালের এই দুই দিনে রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর সদর দফতরে (বর্তমান বিজিবি) ঘটে যায় এক মর্মান্তিক ও নৃশংস ঘটনা। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুবরণ করেন ৫৭ সেনা সদস্যসহ মোট ৭৪ জন।বহুল আলোচিত ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় (পিলখানা হত্যা মামলা) ১৩৯ জনকে ফাঁসি, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন এবং ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা। দীর্ঘ বিচার ও রায় শেষে ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি পিলখানা হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন আদালত।
সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল?
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা ২৭ মিনিটে বিজিবির বার্ষিক দরবার চলাকালে দরবার হলে প্রবেশ করেন একদল বিপথগামী বিদ্রোহী সৈনিক। এদের মধ্যে একজন তৎকালীন মহাপরিচালকের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করেন। এরপরই ঘটে যায় ইতিহাসের সেই নৃশংস ঘটনা। বিদ্রোহী সৈনিকরা সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্রসহ ঝাঁপিয়ে পড়েন। তারা সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের হত্যা করে তাদের পরিবারকে জিম্মি করে ফেলেন। পুরো পিলখানায় এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। চারটি প্রবেশপথ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আশপাশের এলাকায় গুলি ছুড়তে থাকেন তারা।বিদ্রোহীরা দরবার হল ও এর আশপাশ এলাকায় সেনা কর্মকর্তাদের দিকে গুলি চালাতে শুরু করেন। মূলত তাদের গুলিতে একে একে লুটিয়ে পড়তে থাকেন সামরিক কর্মকর্তারা। যদিও ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পর এ বিদ্রোহের অবসান হয়। পিলখানা পরিণত হয় এক রক্তাক্ত প্রান্তরে। পরবর্তী সময়ে পিলখানা থেকে আবিষ্কৃত হয় গণকবর। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের মরদেহ। দীর্ঘ ৩৬ ঘণ্টার এ হত্যাযজ্ঞে ৫৭ সেনা কর্মকর্তা, একজন সৈনিক, দুই সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, ৯ বিজিবি সদস্য ও পাঁচজন বেসামরিক ব্যক্তি প্রাণ হারান।
আদালতের রায়ে ১৩৯ জনের ফাঁসি
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় দুটি ফৌজদারি মামলা করা হয়। এর মধ্যে একটি ছিল হত্যা মামলা আর অপরটি বিস্ফোরক আইনের মামলা। হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ৮৫০ জনের বিচার শেষ হয়। এতে ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আর ২৭৮ জন খালাস পান। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টেও মামলাটির আপিলের রায়ও হয়ে যায়।অপর দিকে বিস্ফোরক মামলায় ৮৩৪ জনকে আসামি করা হয়। মামলাটি হত্যা মামলার সঙ্গে বিচার কাজ ২০১০ সালে শুরু হয়েছিল। যদিও মাঝপথে শুধু হত্যা মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। বিস্ফোরক মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করেনি। এক পর্যায়ে বিস্ফোরক মামলার কার্যক্রম একপ্রকার স্থগিত করে দেয় রাষ্ট্রপক্ষ। যে কারণে মামলাটির বিচারকাজ শেষ হতে কিছুটা বিলম্ব হয়।
মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতরা সকলেই বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিডিআর) সদস্য ছিলেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিতদের মধ্যে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীও রয়েছেন। নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ২০১৫ সালের ৩ মে রাজশাহী কারাগারে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।হাইকোর্টের রায়ে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ জন আসামির মধ্যে ১৩৯ জনের ফাঁসির রায় বহাল রাখেন। একই সঙ্গে আটজনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও চারজনকে খালাস দেওয়া হয়। অন্য দিকে মামলাটির অন্যতম আসামি বিএনপি নেতা নাসিরউদ্দিন পিন্টু হাইকোর্টের বিচার চলাকালীন প্রাণ হারান।এছাড়া বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া ১৬০ জন আসামির মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখেন হাইকোর্ট। এদের মধ্যে দুজন আসামির মৃত্যু হয় এবং ১২ জন আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
বিডিআর পুনর্গঠন ও বিজিবি গঠন
পিলখানায় কলঙ্কিত সেই বিদ্রোহের ঘটনায় বিডিআরের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে যায়। এতে শুরু হয় বিডিআর পুনর্গঠনের কাজ। বিডিআরের নাম, পোশাক, লোগো ও সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তন করা হয়। পরবর্তী সময়ে বিডিআরের নাম পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) রাখা হয়। এমনকি পরিবর্তন করা হয় বিদ্রোহের আইনও।
পিলখানায় শহীদদের স্মরণে দোয়া-মিলাদ মাহফিল
পিলখানা ট্র্যাজেডির দিনটিতে নিহতদের স্মরণে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে বিজিবি। বাহিনীটির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন, পিলখানায় সংঘটিত বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে শহীদদের স্মরণে শুক্রবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) শাহাদত বার্ষিকী পালিত হবে। শহীদদের রুহের মাগফেরাতের জন্য বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদর দফতরসহ সব রিজিয়ন, প্রতিষ্ঠান, সেক্টর ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় খতমে কুরআন করা হবে। বিজিবির সব মসজিদ এবং বিওপি পর্যায়ে শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হবে।এছাড়াও এদিন সকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় বনানী সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান (সম্মিলিতভাবে), বিজিবি মহাপরিচালক (একত্রে) শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। দিনটি পালন উপলক্ষে বিজিবির সকল স্থাপনায় বাহিনীর পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে এবং বিজিবির সব সদস্য কালোব্যাজ পরিধান করবেন। এছাড়া বিজিবির সব সেক্টর ও ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে বিশেষ দরবার অনুষ্ঠিত হবে।বিজিবি আরও জানায়, শুক্রবার জুমার নামাজের পর পিলখানায় বিজিবির কেন্দ্রীয় মসজিদ, ঢাকা সেক্টর মসজিদ এবং বর্ডার গার্ড হাসপাতাল মসজিদে শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।