আফগানিস্তানে কি শান্তি ফিরে আসছে?

জাহিদ হুসেন :: আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় দোহায় যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান তালেবানের মধ্যে আলোচনার অগ্রগতি হয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তারা এবং আফগান তালেবান একটি খসড়া চুক্তির কাছাকাছি পৌঁছেছে, যা আফগানিস্তানে দীর্ঘতম যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারে। যদিও এখনো বড় বড় বাধা রয়েছে, তারপরও উভয় পক্ষের মধ্যে এই দীর্ঘ আলোচনা আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছানোর পথকে প্রশস্ত করেছে। এর আগে তালেবানের আলোচনা থেকে সরে যাওয়ার হুমকির কারণে শান্তিপ্রক্রিয়ায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে সুর কঠিন করতে হয়েছিল।

মার্কিন আলোচক দলের প্রধান জালমে খলিলজাদ এমন ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন যে তালেবানকে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনার জন্য সামরিক চাপ বাড়ানো হবে। গত বছরের শেষ নাগাদ আবুধাবিতে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে এক বৈঠকের পর এ ঘটনা ঘটে। ওই বৈঠকে পাকিস্তান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত যোগ দিয়েছিল এবং ইতিবাচক মেজাজে এর সমাপ্তি ঘটেছিল। যাহোক, কাবুল সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে (যাঁরা ওই সময় আবুধাবিতে অবস্থান করছিলেন) বৈঠকে বসতে তালেবানের অস্বীকৃতি ওই বৈঠকের ফলাফল ও মেজাজের ওপর ছায়া ফেলেছিল।

কিছু খবরে বলা হয়েছিল, খলিলজাদ সৌদি আরব থেকে এই নিশ্চয়তা পেয়েছিলেন যে তালেবান কাবুল সরকারের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বসবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তালেবান প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসে। আলোচনায় বসার ব্যাপারে তালেবান কোনো নমনীয়তা দেখায়নি বলে শান্তিপ্রক্রিয়ায় অচলাবস্থা দেখা দেয়। তালেবান আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির ওপর ক্ষুব্ধ, যিনি তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হামদুল্লাহ মুহিবকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাঠিয়েছিলেন। জানুয়ারিতে সৌদি আরবে অনুষ্ঠেয় আরেকটি বৈঠক তালেবান প্রত্যাখ্যান করলে ভঙ্গুর শান্তিপ্রক্রিয়ার ওপর আরেকটি আঘাত আসে। তবে তালেবান কর্মকর্তারা জানান, বৈঠকস্থল নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের সন্দেহজনক আচরণের কারণেই তালেবান আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। আগের বৈঠকগুলোতে স্বাক্ষরিত চুক্তির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কপটতার আশ্রয় নিয়েছে বলে তালেবান অভিযোগ করেছে।

তবে পরে ব্যাপক কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পর এ বরফ গলেছে; তালেবানকে আলোচনার টেবিলে ফেরানোর জন্য ইসলামাবাদ বড় ভূমিকা পালন করেছে। তালেবান ও মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে সর্বশেষ বৈঠকটি প্রথমে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু বৈঠকের তথ্য ফাঁস হওয়ার কারণে পরে তা দোহায় স্থানান্তর করা হয়। ছয় দিনের এ আলোচনায় উভয় পক্ষই নমনীয়তা দেখিয়েছে। তালবানের আলোচক দলে পরিবর্তন আনায় সম্ভবত আলোচনায় সাফল্য এসেছে। দোহা আলোচনার মাঝামাঝি সময়ে তালেবান আলোচক দলে মোল্লা বারাদার আখুন্দকে নিয়োগ দেয়। তিনি তালেবানের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও মোল্লা ওমরের ডেপুটি। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ মোল্লা বারাদারকে এক দশকের বেশি সময় ধরে আটকে রেখেছিল, মুক্তি দিয়েছে মাত্র কয়েক মাস আগে। দীর্ঘদিন জেলে থাকার পরও মোল্লা বারাদারকে তালেবানের দ্বিতীয় নেতার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়া এবং কাবুল সরকারের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসা—এসবই এখন নির্ভর করছে তালেবানের ওপর। প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাবে তালেবানের ক্রমাগত প্রত্যাখ্যান শান্তির প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে একটি কাঠামোগত চুক্তির পর তালেবানের আন্ত–আফগান সংলাপে রাজি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এ আলোচনার পর যুদ্ধবিরতি হতে পারে। তবে সব অংশীজনের মধ্যে একটি সমন্বিত চুক্তি হতে এখনো অনেক দেরি আছে।

ওয়াশিংটনের বৈদেশিক নীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে আসা। যদিও যুদ্ধে জেতার সম্ভাবনা নেই, তবু যুক্তরাষ্ট্রের বিদায় নেওয়া হয়তো সহজ হবে না। দীর্ঘ ১৭ বছরের যুদ্ধ দেশটিকে আরও বিভক্ত করেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয় ও বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তালেবান বিদ্রোহীরা নিশ্চিতভাবেই সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। সম্প্রতি আফগান সামরিক বাহিনী ও স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করে তালবানের বড় ধরনের হামলা বিদ্রোহীদের আরও উসকে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে সম্মত না হওয়া পর্যন্ত তালেবান তাদের বন্দুক নামিয়ে নেবে—এমন কোনো ইঙ্গিত নেই। প্রকৃতপক্ষে আসন্ন বসন্তে তালেবানের হামলা আরও বাড়তে পারে। এটা হবে একটা যুদ্ধ-যুদ্ধ এবং আলাপ-আলোচনার পরিস্থিতি। আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মরিয়া হয়ে ওঠাকে তালেবানের বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

দাভোসে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির বক্তব্যে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের পরিকল্পনা ও কাবুল সরকারের উদ্বেগের মধ্যে বিদ্যমান ফারাকেরই ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। আশঙ্কা বাড়ছে যে মার্কিন বাহিনী চলে গেলে তালেবান শক্তিশালী হবে এবং আফগানিস্তানকে আরেক দফা গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবে। এসব উদ্বেগ খুবই যুক্তিসংগত এবং তালেবানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করার সময় অবশ্যই এগুলো বিবেচনায় নিতে হবে।

Advertisement