ব্রিট বাংলা ডেস্ক : যারা ধর্ষণের শিকার হন, তাদের প্রতি ব্রিটেনের ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম কেমন আচরণ করে তা উঠে এসেছে মর্গান বার্বোরের লেখা থেকে। ২০১৩ সালে আমেরিকা থেকে ব্রিটেনে অভিনয় নিয়ে পড়াশোনা করতে যান বার্বোর। তার পাঁচ মাস আগে ব্রিটেনে পেশাদার ভায়োলিনবাদক ফ্রান্সিস অ্যানড্রাদের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। পরে জানা যায়, তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। অভিযোগ ওঠে মাইকেল সি ব্রিউয়ারের বিরুদ্ধে। মাইকেলের ছয় বছরের জেল হয়। ব্রিটেনে ধর্ষণের শিকারদের থেরাপি নিতেও জটিলতায় পড়তে হয়। অনেক সময় বাধ্য হয়েই নির্যাতিতরা থেরাপি থেকে বেরিয়ে আসেন। আবার বিচারব্যবস্থার ফাঁক-ফোকর দিয়ে অপরাধীরাও বেরিয়ে আসেন। তাদের যথা শাস্তি হয় না। কয়েক বছর আগে ব্রিটেনে ধর্ষণের ঘটনা যেন মহামারিতে রূপ নেয়। ২০১৯ সালে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ধর্ষণ মামলার অর্ধেকের বেশি চলতি পথেই শেষ হয়ে যায়, যদিও অভিযুক্তরা ধর্ষক হিসেবে চিহ্নিত হয়। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে অভিযোগ দেয়া হয়েছে এমন ধর্ষণ বৃদ্ধি পায় ১৭৩ শতাংশ। এর মধ্যে ১৯ শতাংশ মামলা পুলিশ গ্রহণ করেনি এবং ৪৪ শতাংশ মামলা ঝুলে পড়ে দেশটির ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসের কারণে। বার্বোর নিজেও ধর্ষণের শিকার হন। এসব বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন তিনি।
২০১৬ এর ফেব্রুয়ারিতে দণ্ডাদেশের অর্ধেক শাস্তি ভোগ করে জেল থেকে ছাড়া পান মাইকেল ব্রিউয়ার। একই বছরের এমিলি ডোয়ের ‘ভিকটিম ইম্প্যাক্ট স্টেটমেন্ট (বর্তমানে বিশ্বজুড়ে চ্যানেল মিলার নামে সুপরিচিত) বাজফিডে প্রকাশ পাওয়ার পর ভাইরাল হয়।
বার্বোর লিখেছেন, পরদিন নিজের বাড়িতে আমি ধর্ষণের শিকার হই। অপরাধী একজন ব্রিটিশ। সে ডাবলিনে এসেছিল মঞ্চে কাজ করতে। এ শহরে আমি বছরখানেক কাটিয়েছি। আমেরিকা থেকে ২০১৫ সালে সহকর্মী ক্যারোলিন ডাউন্সকে সাথে নিয়ে আয়ারল্যান্ডে ভ্রমণে যাই। তখন আমি সবেমাত্র লন্ডনের রয়্যাল সেন্ট্রাল স্কুল অব স্পিচ অ্যান্ড ড্রামা-তে গ্র্যাজুয়েট প্রগ্রামে ভর্তি হয়েছি। আমি যখন ধর্ষণের শিকার হই তখন আয়ারল্যান্ডে গর্ভপাত অবৈধ। সে সময়টাতে আমার পরিষ্কার কিছু স্মৃতির একটি হলো- খুব ভোরে ডাবলিনের সারা দিন-রাত খোলা থাকা ফ্লাই ই ফিট ব্যায়ামাগারের সবচেয়ে ওপরের তলায় জানালায় দাঁড়িয়ে ডাবলিন প্রাসাদে তাকিয়ে থাকা। ভাবতাম আমার পেটের ওপর যদি জিমনেশিয়ামের সবচেয়ে ওজনদার কেটেলবেলগুলো চাপিয়ে দিতে পারতাম। আমি ছিলাম ফাঁদে পড়া পশুর মতো। আমি পাগলের মতো অপেক্ষায় ছিলাম আমার পরবর্তী পিরিয়ডের জন্য। আমি নিশ্চিত হতে চাই ধর্ষকের সত্ত্বা আমার ভেতরে বাস করছে না।
২০১৬ এর সেপ্টেম্বরে ইউকে-তে ফিরে আসি। পরে বছরখানেকের মধ্যে আয়ারল্যান্ড ফিরিনি। ওখানে গেলে সেই স্মৃতি আর বইতে পারবো না বলে ভয় ছিল। ধর্ষণের ঘটনা রিপোর্ট করেছি বছর দুয়েক আগে। আর দেড় বছর হবে থেরাপি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
২০১৮ সালে চতুর্থ দফায় থেরাপি নিতে শুরু করি। গ্র্যাজুয়েশনের ডেজার্টেশন স্বল্প পরিসরে করছিলাম। তখন আমি লস অ্যাঞ্জেলসে। গত আট মাস আমি পালিয়ে বেরিয়েছি ইউকে এবং আয়ারল্যান্ড থেকে। ধর্ষক এবং আমার মাঝে যতটা সম্ভব ভৌগলিক দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করতাম। এখন পর্যন্ত আমি এ বিষয়ে পুলিশের সাথে কথা বলতে নারাজ।
মানসিকভাবে আমার অবস্থা ছিল বিপর্যস্ত। ওজন কমে যাচ্ছিল, ঘুম নিয়েছিল বিদায় আর চোখের পানি বিসর্জনেও নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না। তবে আমি ভাগ্যবতী ছিলাম। যখন আমার থেরাপি অতি জরুরি হয়ে পড়লে তখন যেন ঈশ্বর একজন থেরাপিস্ট পাঠালেন আমার জন্যে। আসলে একটা পয়েন্টের ভিত্তিতে আমি যেকোনো থেরাপিস্টের থেকে দূরে থাকার জন্যে রীতিমতো পাগলাটে ছিলাম। আমি তাদের কণ্ঠ, কথা বলার সুর, তাদের চাহনি আর ভেতরটাকে বিষাক্ত করে তোলার নিরলস প্রচেষ্টা থেকে দূরে থাকতাম।
২০১৮ সালে আমার লেখা একটি নিবন্ধ ভাইরাল হয়। সেখানে আমি বলেছি ধর্ষণের ঘটনা কেন পুলিশের কাছে রিপোর্ট করিনি। পাঠকের সাড়া অবিশ্বাস্য। দুই বছর পরও আমি অনেকের কাছ থেকে ইমেইল পেয়েছি। এদের অনেকেই ধর্ষণের শিকার নারী। তারা আমাকে কণ্ঠ তোলার জন্যে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এমন একটা গল্প ইন্টারনেটে বলার বিষয়ে আমার ভয় ছিল। সেখানে অনেকেরই পরিচয় গোপন রেখে কুরুচিকর মন্তব্য করার কুপ্রবৃত্তি রয়েছে। তবুও অসংখ্যা মানুষ আমার পাশে দাঁড়ালেন। আমাকে অভিযোগ দায়েরের পরামর্শ দিলেন।
পাশে ছিলেন আমার থেরাপিস্ট। অবশেষে ২০১৮ এর মে মাসে আমি লস অ্যাঞ্জেলস পুলিশ বিভাগে অভিযোগ দিলাম। আমাকে বলা হলো, আমার মামলাটা গার্ডা (আইরিশ পুলিশ ফোর্স) এর কাছে স্থানান্তর করা হবে। কিন্তু যেহেতু আমার ঘটনা ব্রিটেনে ঘটেছে, এটা ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসের অধীনেই যাবে।
অভিযোগ দায়েরের এক মাস পরই ইউকে গেলাম গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার জন্য। লন্ডন-ভিত্তিক রেপ ক্রাইসিস সেন্টারে কাউন্সেলিংয়ের জন্যে আবেদন করলাম। আমাকে বলা হলো, সেখানে সুযোগ পেতে ১০ মাসের অপেক্ষমানদের তালিকা পেরোতে হবে। পরে আমি কখনোই সেখানে কাউন্সেলিং পাওয়ার সুযোগ পাইনি। বছরখানেক পর ২০১৯ এর জুনে সেখানে আমি আবার আবেদন করি। তখন বলা হলো, আমার আগে ৮ মাসের অপেক্ষমান তালিকা রয়েছে। তবে সেখানে দলবদ্ধ থেরাপির সুযোগ মিললেও আমাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হলো। কারণ, আমি অভিযোগ দায়ের করেছি এবং তদন্ত চলমান রয়েছে।
এখন আমার থেরাপিস্টের সাহায্যে এই ক্ষত সারাইয়ের চেষ্টা করছি। একই বছরের সেপ্টেম্বরে তৃতীয়বারের মতো সেখানে আবেদন করি। তখন আমাকে বলা হলো, আমার মামলা চলমান থাকলেও একজন থেরাপিস্টের সাথে কথা বলা যাবে। তবে তার সাথে আমি আমার ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে কোনো কথা বলতে পারবো না।
অক্টোবরের শুরুর দিকে আমার কাছে আসা একটি ইমেইলে একজন লিখেছেন, থেরাপির এমন বিধিনিষেধের বিষয়ে আমি জানি যা তোমার কাছে নতুন মনে হবে। এটা খুবই হতাশাজনক।
ধর্ষণ কোনো স্বাদ বর্ধনকারী বিষয় নয়। আমি বিশ্বাস করি এর জন্যে প্রয়োজনীয় আলাপচারিতার দরকার আছে। আমি এমনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করবো না যা কিনা ঘটেনি। আমি আমার ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা প্রিয় কারো কাছে বলতে চাইবো না।
আমি আমার মা কিংবা বোনের ঘাড়ে এ বোঝা চাপাবো না। আমার খুব কাছের এক বন্ধুর সাথে এক রুমে থাকতাম। সেখানেই এ ঘটনা ঘটেছে। আমার প্রেমিক আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমার সেই বন্ধু ঘরের ভেঙে যাওয়া কাচ আর ধর্ষণে ব্যবহৃত কনডম ফেলে ঘর পরিষ্কার করেছে। আমার ট্রমা তাদের সাথে ভাগাভাগি করেছি। তারা আমার সেই সময়টাতে শক্ত কাঠামো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই মানুষগুলোকে আমার স্মৃতির বোঝা বহন করতে বলাটা মোটেও সমীচীন নয়।
এসব ঘটনা লাইসেন্সপ্রাপ্ত পেশাদারদের সাথেই শেয়ার করা উচিত। আমি তখন থেকেই সুস্থ হতে শুরু করলাম যখন নিরাপদ জায়গায় আমার অভিজ্ঞতার কথা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে যাওয়ার সুযোগ পেলাম। এমন অভিজ্ঞতা নিয়ে চুপ থাকাটা কেবল হতাশাজনকই নয়, রীতিমতো পাগল হওয়ার অবস্থা। আর অ্যানড্রাদের মতো নারীদের ক্ষেত্রে তা প্রাণবিনাশী হতে পারে।
করোনাভাইরাসের মহামারি শুরু হওয়ার কিছুদিন বাদেই আয়ারল্যান্ড থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করলেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। মাস দুয়েক আগে আমি এই গোয়েন্দার কাছে আমার মানসিক অবস্থার কথা লিখেছিলাম। তিনি জানালেন, ইউকে’র পুলিশ মোটেও আন্তরিক নয়। তিনি তদন্ত এগিয়ে নিতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে এ বিষয়ে কোনো কথা আমাকে দিতে পারছেন না।
তিনি আমাকে বললেন, এই বিষয়গুলো খুব ধীরগতিতে এগোয়। ধর্ষণের অভিযোগ দায়েরের দু’বছর হতে চললো। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এখনো এই তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার মূল্য আছে কি না।
যখন আপনি ন্যায়বিচার অন্বেষণ করছেন, তখন সেখানে কোনো জয় নেই। এক্ষেত্রে মনে হবে, যে বিষয়গুলো আপনাকে বাঁচিয়ে রেখেছে সেখান থেকে বঞ্চিত, অথবা একজন অপরাধীকে তার কৃতকর্মের জন্যে আপনি পুরস্কৃত করবেন যেন আপনার জীবনটা আরো কিছু দিন সময় পায়। ধর্ষকদের ক্ষমা করে দেয়ার প্রবণতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা প্রাচীন পদ্ধতি কখনো ধর্ষিতার জীবনের এই ঘটনাকে মুছে ফেলতে পারে না।
এই ঘটনা যখন লিখছি তখন পর্যন্ত আমার মামলা চলছে এবং আমাকে পূর্ণমাত্রায় থেরাপি গ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়নি।
অনিশ্চয়তার মাঝে খোদাই করা পাপমোচনের মাঝে আমি বাস করছি। আমার একটা অংশ চার বছর আগেই মরে গেছে। ডাবলিনের ছোট্ট একটা ঘরে যেখানে একজন পুরুষ এক নারীর দেহকে তার যৌনচাহিদা পূরণের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিল। তার এ চাহিদা আমার অধিকার, আমার সম্মতি এবং আমার ভবিষ্যতের চেয়ে অনেক বেশি কিছু ছিল।
আমার আত্মার মূলে যে পচনব্যাধী বাসা বেঁধেছিল তার চিকিৎসা আমি সাহায্য চাওয়ার আগ পর্যন্ত শুরু হয়নি।
আমার মামলার এখন দুটো উপায়ে সমাপ্তি ঘটতে পারে। যৌক্তিত সন্দেহ থাকার পরও যথাযথ প্রমাণের অভাবে মামলা ঝুলে যেতে পারে। অথবা বিচারব্যবস্থা এগিয়ে আসতে পারে।
সূত্র: আল জাজিরা