আসামের নাগরিকত্ব সমস্যা বাংলাদেশের জন্য সতর্কবার্তা

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: ভারতের আসামে সম্প্রতি প্রকাশিত নাগরিকত্বের খসড়া তালিকা অনুযায়ী সম্ভবত ৪০ লাখের বেশি মানুষ তাঁদের ভারতীয় নাগরিকত্ব হারাতে যাচ্ছেন। এই নাগরিকত্ব নিবন্ধন হালনাগাদের উদ্দেশ্য ছিল আসামে বসবাসরত ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ চিহ্নিত করে তাঁদের নাগরিকত্ব বাতিল করা। খসড়া তালিকা প্রস্তুতের সময় এই ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ কারা, এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না বলা হলেও, এ বিষয়ে যাবতীয় বিতর্ক ও বিশ্লেষণে বারবারই বাংলাদেশিদেরই ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

২.
বিদেশি নাগরিকদের অবৈধ অনুপ্রবেশের বিষয়টি আসামের অনেক বছর ধরে চলে আসা একটি অন্যতম রাজনৈতিক ইস্যু। অনেক ভারতীয় সমালোচকের মতে, আসামের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ভোটব্যাংক বাড়ানোর জন্যই বহু বাংলাদেশিকে জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে আসামে প্রবেশের পথ সুগম করে দিয়েছে। এ রকম একটি ভীতি থেকেই আসামে টানা ছয় বছর ধরে চলে ছাত্র আন্দোলন, যার ইতি টানা হয় ১৯৮৫ সালে ‘আসাম চুক্তি’ স্বাক্ষরের মাধ্যমে। তৎকালীন সরকারের সঙ্গে আন্দোলনকারী ছাত্রসংগঠনের করা এই আসাম চুক্তির অন্যতম প্রধান দিক ছিল একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা ঠিক করে দেওয়া এবং সেই সময়ের পরে যেসব ব্যক্তি আসামে প্রবেশ করেছেন, তাঁদের আসামের নাগরিক হিসেবে বিবেচনা না করা। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ তারিখকে সেই সময়সীমা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। এই আসাম চুক্তির আলোকে ১৯৫৫ সালের ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনে সংযোজিত হয় ধারা ৬ এ; যাতে বলা হয় যে আসামে বসবাসরত কোনো ব্যক্তিকে ‘বিদেশি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে যদি সেই ব্যক্তি ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পর সেখানে অনুপ্রবেশ করে থাকেন।

৩.
২০১২ সালে ৬এ ধারাটিকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে এবং ধারাটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়েছিল। এই রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, সুপ্রিম কোর্টের দুজন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত একটি বেঞ্চ ২০১৪ সালে রায় ঘোষণা করেন। এই দুজন বিচারকের একজন আবার ঘটনাচক্রে ছিলেন অসমিয়া। এই সিদ্ধান্তে ধারা ৬ এ-এর বৈধতার প্রশ্নটিকে একটি যথাযথ বিচারিক বেঞ্চের কাছে উত্থাপন করার প্রস্তাব করা হয়। তবে একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে আসামে নাগরিকত্ব নিবন্ধন হালনাগাদের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেন। এবং সেখানে এ-ও বলা হয় যে এই পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে সুপ্রিম কোর্টের সরাসরি তত্ত্বাবধানে। আসামের অবৈধ অনুপ্রবেশের বিতর্কটি সব সময় রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবেই আলোচিত হয়ে আসলেও, ২০১৪ সালের সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্তের কারণে বর্তমানের এই নাগরিকত্ব নিবন্ধন হালনাগাদের বিষয়টিকে বিজেপি সরকার একটি রাজনীতি-বহির্ভূত প্রক্রিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে।

৪.
২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় নরেন্দ্র মোদি একটি সভায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, আসাম থেকে তিনি ‘বাংলাদেশিদের তল্পিতল্পাসহ বিতাড়িত’ করবেন। ২০১৪ সালের সিদ্ধান্তটিতে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টও বাংলাদেশিদেরই ‘অবৈধ অভিবাসী’ বলে আখ্যা দেন এবং বিভিন্ন সরকারি তথ্য-উপাত্ত ও প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে একইভাবে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে বাংলাদেশিদেরই চিহ্নিত করা হয়েছে।

২০১৪ সালের সিদ্ধান্তটি বিস্তারিতভাবে এ-ও আলোচনা করে যে, কী করে ভারত-বাংলাদেশের সীমানাকে আরও সুরক্ষিত করা যায়, যাতে করে আসামে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করা যায়। খসড়া নাগরিকত্ব নিবন্ধন প্রকাশের পর বিজেপির অনেক নেতা, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, এমনকি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমেও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলতে বাংলাদেশিদেরই বোঝাচ্ছে, যাদের চিহ্নিত করাই আপাতদৃষ্টিতে এই তালিকা প্রস্তুতের লক্ষ্য।

৫.
অন্যদিকে, ভারতীয় সমালোচকেরা বলেছেন, এই অবৈধ অনুপ্রবেশের বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় সরকার কখনো বাংলাদেশের কাছে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তোলেনি এবং কোনো কূটনৈতিক দ্বিপক্ষীয় আলোচনাতেও এ বিষয়টি কখনো উঠে আসেনি। তবে, অনানুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেওয়া বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধিদের বক্তব্যের মাধ্যমে এ বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থানটি পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, বাংলাদেশ মনে করে আসামের অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা বাংলাদেশি নয়। কেননা ১৯৭১-এর পরে বাংলাদেশ থেকে আসামে আর কোনো অবৈধ অভিবাসন ঘটেনি। একই সঙ্গে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই দিকটিতেও জোর দেওয়া হয়েছে যে, আরও অনেক দ্বিপক্ষীয় ইস্যু আলোচনা হলেও ভারত সরকার কখনোই আসামে অবৈধ অনুপ্রবেশের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন ওঠায়নি।

৬.
যেহেতু ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো অভিযোগ জানায়নি, তাই এ বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য না জানানোই যুক্তিযুক্ত বলা যায়। তবে, ভারতের উচ্চ আদালতসহ বিভিন্ন জাতীয় ফোরামে যেভাবে বারবার আসামে এই অবৈধ অভিবাসীদের ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ সরকার এই ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া পুনর্বিবেচনা করে দেখতে পারে। বাংলাদেশের উদ্বেগ প্রকাশ করে এমন একটি বার্তা দেওয়াই যেতে পারে যে সম্ভাব্য একটি বড় জনগোষ্ঠীকে ভারতীয় নাগরিকত্ব থেকে বাদ দেওয়ার যে প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হচ্ছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতকে খেয়াল রাখতে হবে যেন তাদের নিজস্ব এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটি কোনোভাবেই দ্বিপক্ষীয় এবং আঞ্চলিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব না ফেলতে পারে।

৭.
অবৈধ অনুপ্রবেশকারী আখ্যা পাওয়া ছাড়াও, বাংলাদেশের জন্য আরও উদ্বেগের বিষয় হলো আসামের এই সম্ভাব্য রাষ্ট্রহীন ব্যক্তিদের ভবিষ্যৎ সমাধান কী হবে-এই প্রশ্নে ভারতের বিভিন্ন ফোরামে তাঁদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়টিই আলোচিত হচ্ছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে নাগরিকত্ব নিবন্ধন প্রস্তুতের দায়িত্বে থাকা আসামের মন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বাস শর্মা ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে স্পষ্ট বক্তব্য দেন, আসামে বসবাসরত ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ চিহ্নিত করাই এই প্রক্রিয়ার প্রধান উদ্দেশ্য এবং যাঁদের নাম এই তালিকায় থাকবে না, তাঁদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও শঙ্কার উদ্রেক করে-ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ভাষ্যমতে, হেমন্ত বিশ্বাস শর্মার এই বক্তব্যকে উল্লেখ করে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার ২০১৮ সালের জুন মাসে নাগরিকত্বের চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ যাওয়া ব্যক্তিদের কী হবে জানতে চেয়ে চিঠি লেখেন ভারতের পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে।

৮.
এমনকি, ২০১৪ সালের উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তটিতেও সরকারকে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে বাদ যাওয়া ব্যক্তিদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াটি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যথাযথ আলোচনা শুরু করতে। তবে অনেকে যুক্তি দিয়ে থাকেন যে বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সুসম্পর্ককে মাথায় রেখে, ভারতীয় সরকার হয়তো কখনোই ফেরত পাঠানোর বিষয়টি বাংলাদেশের কাছে উত্থাপন করবে না। তবে, আসামের নাগরিকত্ব হালনাগাদকে ঘিরে সব বিতর্ক আর বিশ্লেষণগুলো যেভাবে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করছে, তাতে বিপদের বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দেওয়াও ঠিক হবে না।

৯.
অতীতের মানবিক-সংকট মোকাবিলায় ভারতের ইতিবাচক ভূমিকাকে মাথায় রেখে ভারত সরকার তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার মাধ্যমে নাগরিকত্বের এ বিতর্কটির সমাধান করবে-এমনটিই কাম্য; যাতে করে তা আঞ্চলিক শান্তি ও সুরক্ষায় ভবিষ্যতে কোনো সংকট না তৈরি করে।

Advertisement