।। ইমরান আহমেদ চৌধুরী।।
ওর পোরসে নিয়ে বেরিয়ে পরলাম দ্রুত গতিতে সকাল সর্বসাকুল্যেকেবল ৭ – ৪৫, রাস্তায় লেক বারচেয এ থামলাম – কোভোলো পাহাড়েরএবং সংলগ্ন সকল পাহাড়ের নিঃসৃত জলরাশি জমে জমেই সৃষ্টি করেছেএই বিশাল লেকের । ওটার পাস দিয়েই আগের আমলের পাহাড় খুঁড়েসুড়ঙ্গএর ভিতর দিয়ে ওল্ড রোড দেখলাম ; কি বিশাল কাজ– কি ওদেরপ্রকৌশলীদের মেধা – আর শ্রমিক দের সাহস , হাতুড়ী, কোদাল, বেলচা, সাবল দিয়ে খুদে খুদে বানিয়েছে প্রায় ৫ মাইল দীর্ঘ সুড়ঙ্গ রাস্তা – একপাশে পাহাড়ের ছাদ আর দেওয়াল আর অন্য পাশে ৩ হাজার ফুট বিশালপাহাড়ের খাদ – বিশাল সেই খাদ – তাকালেই গা শিউরে উঠে । ঐ ভ্যালীবা কানিওন এর মাঝেই জন্ম নিয়েছে ইতালির অন্যতম প্রধান নদী – যাপারদোনোনা হয়ে কিছু জায়গা শুকিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও প্রবাহিত হয়েছেএড্রিয়াটিক সাগরে । লেকের পাড়েই মাছ এর পোনা ঘুর ঘুর করছে ঝাঁকেঝাঁকে ; কেউ কণিজাল বা বড়শি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে না ঐ সব বালি মাছজাতিয় মাছ গুলোকে। পাহাড়ের বিশাল গহ্বর এর উপর দিয়ে দুটো পাহাড়কে জোড়া লাগিয়েছে একটা দড়ির ঝুলন্ত ব্রিজ দিয়ে – সেই ২ হাজার ফুটউপড়ে এবং এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ের মধ্যে তফাত ২৫০ – ৩০০ফুট । ঐ ঝুলন্ত ব্রিজ টা পাড় হলাম একা একা হেঁটে হেঁটে কোমরে সেফটিবেল্ট বেধে আর বেল্টের শেষে ক্লিপ গুল দড়িতে লাগিয়ে দেওয়ার জন্যযাতে পা পিছলে পরে গেলোও যাতে একদম দুই হাজার ফুট নীচে যাতে নাপরে যায় কেই । হাজার হাজার পর্যটক চতুর্দিকে ; কেউ এসেছে গাড়ী নিয়ে, কেউ কেউ এসেছে হেঁটে হেঁটে তারা হেঁটে হেঁটেই ভ্রমণ করবে ছয় সাত সপ্তাহইতালিতে এসেছে ফিনল্যান্ড থেকে, নিউজিল্যান্ড থেকে, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রাঞ্চবা রাশিয়া থেকে, কেউ বা এই খানেই তাঁবু তে কিংবা মোটর হোম এইথাকবে কয়েক সপ্তাহ আবার অন্যরা এসেছে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে কোচভড়ে ভড়ে। গরমের যত বৃদ্ধি পাচ্ছে পরিধেয় কাপড় ও তত সংকীর্ণ হচ্ছে। কেউ কারোর দিকে তাকাবার সময় নাই ।
ঘাসের মধ্যেই প্রেমিকপ্রেমিকারা বিকিনি এবং হ্যাফ পেন্ট পরে কড়া রোডে শরীরের চামড়াঝলসানোর জন্য শুয়ে আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা । সাইকেলের পিছনেবেয়ারিং এর গাড়ীর মত ট্রেয়াইলার এ বসিয়ে মা বা বাবা দিব্বি সাইকেলচালিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে । লোকে লোকারণ্য । অগাস্ট মাসে ইউরোপ জুড়েচলে বাৎসরিক ছুটির মাস ঐ মাসে বাচ্চাদের স্কুল , কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সব ৬ থেকে ১২ সপ্তাহের জন্য বন্ধ থাকে । হোটেল, মোটেল, বেড এন্ডব্রেকফাস্ট , হোস্টেল কোথাও কোন জায়গা পাওয়া সম্ভব নয় । সারা দিনঘুরে বেড়ায় সব পর্যটক রা আর রাতের বেলা সবাই ভালো দামি কাপড়চোপড় পরে শহরে বেরিয়ে পরে সবাই রেস্টুরেন্ট এ খাবার খেতে, বার বাপাব এ যাবে মদ্য পান ও অন্যান্য দের সাথে সামাজিক আড্ডা মারা এবংগান শুনবে, ডার্ট খেলবে বা কারাওকি তে গান গাবে আর বিয়ার, ওয়াইন, বা স্পিরিট পান করবে – আর যুবক যুবতি রা দল বেধে বেধে শহরেরডিস্কো তে নেচে গেয়ে মদ্য পান করে সেই গভীর রাতে যার যার ঘুমাবারস্থানে ফিরে যাবে আবার সকালে শুরু করে দিবে তাদের ভ্রমণ কার্যক্রম ।এক অদ্ভুত সংস্কৃতি আমাদের কাছে হয়ত মনে হয় বা হবে । এই অগাস্টমাসের জন্য চাতক পাখির মত অধীর আগ্রহে বসে থাকে ইউরোপের সবভ্রমণ করার মত প্রসিদ্ধ বা নৈসর্গিক স্থান গুলো এবং সমুদ্র সৈকত গুলো – বছরে এক দশমিক চার বিলিয়ন পর্যটক রা পর্যটন এ বের হয়ে যায় এইমহাদেশে । একেক টা পরিবার কম করে হলেও তিন থেকে ছয় পাউন্ড ব্যয়করে এই সময় টাতে। মনে হয় গোটা ইউরোপে বসেছে এক বিরাটমিনাবাজার । বাৎসরিক এই হলি ডে কালচার সম্পূর্ণ ইউরোপের জন্যএোর মিলনমেলা । ইস শুধু যদি এই রকম একটা কিছু করা যেতোআমাদের দেশে – বাচ্চাদের স্কুল ছুটির সময় ; তবে আমাদের মত বিশালদেশে দেশের ভিতরে এত গুল ভ্রমণ কেন্দ্র নাই যা নাকি সবাই কে স্থানদিতে পারবে একত্রে । যদিও বর্তমানে দেশের মানুষ দেশের ভিতরে এবংবহির্বিশ্বেও ভ্রমণ বিলাসী হয়ে উঠছে ক্রমশ ।এইসব অসংলগ্ন অনেকহাবিজাবি ভাবতে ভাবতে কখন যে ইতালির অন্যতম ইউ নেস কোঅনুমোদিত হেরিটেয ( ঐতিহ্য ) নগরী অ্যাঁকিলা তে এসে পরলাম তাবুঝতেই পারিনাই । বন্ধু বলল চলেন হুজুর আমারা পৌঁছে গেছি আমাদেরপরবর্তী গন্তব্যে ; রোমান আমলের এক বিশাল সমুদ্র বন্দর এই শহর টিছিল ; আজ যা আছে তার অর্ধেক ই পুরাকীর্তি এবং পুনঃখনন করতঃআবিষ্কৃত নমুনা সমূহ ; এইডরিআটিক সমুদ্র থেকে নদী দিয়ে চ্যানেল এরমত করে এই বন্দরে মালামাল আমদানি ও রফতানি করত সেই আজথেকে ২৩০০ – ২৪০০ বছর আগে । একটা চালু রোমান ক্যাথলিক গির্জাআছে এখানে এখনও – বিশাল একটা বেল টাওয়ার এখনোও প্রতি ঘণ্টারআগমনী শুনিয়ে দেয় বিশাল ঘণ্টার আওায়াজে । পাশেই একটা জাদুঘরচোখ জুড়ানো সব সমাহার সেই দুই – থেকে তিন হাজার বছর পুরানো সবপ্রত্নতাত্তকিক সম্ভার দেখার মত, সেই ২ হাজার বছর পুরানা মোজাইক – ভাবতে আশ্চর্য লাগে ; সহস্র বছর পুরানো পুরাকীর্তির সমাহার দেখতেযেয়ে প্রায় ৩ ঘণ্টা পাড় করে দিলাম তা ভাবতেই পারি নাই । সেই ঐআমলের হাড়ি বাসন, বিভিন্ন ধরনের মূর্তি, অস্ত্র সস্র, কারুকার্য খচিতআসবাব পত্র, বাক্স পেরটা, রাজবংসের নিদর্শন সমূহ ; চোখ ধাদানো সবসংগ্রহ । হেঁটে চলে গেলাম সেই নদীর পারে । মনের অজান্তে ঐ শুকনোনদীটির পাড়ে বসে ভাবতে লাগলাম – একদা এটা ছিল প্রাচীন রোমসাম্রাজ্যের অন্যতম প্রধান বন্দর – কি জানি ? এই বন্দর দিয়েই হয়ত সেই২৪ – ৩০ খ্রিস্টাব্দে বাংলা থেকে খাদি আর খদ্দর কাপড়ের থান গুলোআসতো কি ? প্লটমি এর বইতে অনেক বছর আগে এটা পড়েছিলাম আরখুবই গর্ব বোধ করেছিলাম যে, ঐ আমলে আজ থেকে ২০০০ বছর আগেআমাদের পূর্ব পুরুষেরা বাংলায় উৎপাদিত খাদি কাপড় রোমের সিনেটেরসিনেটর এবং তাঁদের অর্ধাঙ্গিনী ও তাঁদের রাজপ্রাসাদের রক্ষিতা পরিধানকরতো । এবং কেন ঐ অপরিচিত বাংলায় কেন এত স্বর্ণমুদ্রা প্রেরণ করাহয় তা নিয়ে রোমের সিনেটে অনেক বাক বিতণ্ডা হতো তা ও পড়েছিলাম – তখন রোমের সম্রাট ছিল – কুখ্যাত নিড়ো সম্রাটের পালক পিতা অগাস্থাস। ভাবতেই আনন্দে আর গর্বে বুক টা উঁচু হয়ে গেলো – দুই ই দুই ওমিলানোর চেষ্টা করলাম কারন – আকিলা থেকে ভেনিস বেশী দুরে না – কারণ মার্কও পলো তার ভ্রমণের বইতেও লিখেছে যে সে, দামাস্কাস এবংরোম ও ভেনিসে ও ঐ সময় ( ১৩ শতাব্দী) বাংলার বানানো মসলিনকাপড় এসব জায়গায় বেচা কেনা হতে দেখেছে ।
রোমান দের মনস্তত্ত্ব নিয়ে অনেক ক্ষণ ভাবলাম – ওরা যে কি বিশালএকেক জন চিন্তাবিদ ছিল তা আমরা ২০০০ বছর পরেও ঠিক মত বুঝেউঠতে পারছিনা ; ওদের প্রকৌশলী এবং ওদের সুদূর প্রসারী পরিকল্পনানিয়ে ভাবতে গেলে মাথা তা কেন জানি ভো ভো করে ঘুরতে থাকে ; এতবড় বিশাল বিশাল খাল কেটে প্রধান সমুদ্র থেকে চ্যানেল করে ফ্রেসওয়াটার পোর্ট বানানো – সব পাল তোলা জাহাজ গুলোকে নিরাপদ স্থানেএনে মাল উঠানো আর নামানো শান্তি মতে কড়া এবং সঙ্গে সঙ্গে অন্যত্রপ্রেরন করে দেওয়া – পোর্টের আসে পাশে গুদাম গুলো বানানো – মদ এবংঅন্যান্য সামগ্রী যাতে নষ্ট তার জন্য তাপ নিয়ন্ত্রণ করা গুদাম । বিশালসোজা রাস্তা বানানো সেই আক্যিলা থেকে সুদূর রোম পর্যন্ত – এক বিশালব্যাপার । সমুদ্রের বিশাল ঢেউ এ যাতে করে পালতোলা নৌকা জাতীয়কাঠের বানানো গুলো আছড়ে আছড়ে ভেঙ্গে না যায় তাই মনে হয়রোমানরা খাল কেটে এই কর্ণফুলী নদিতে যেমন চিটাগাং বন্দর কম ঢেঊওয়ালা নদিতে বানিয়েছে ওরকম এটা – কি জানি পর্তুগিজ রা চিটাগাংবন্দর বানানোর ধারনাটা হয়ত রোমান দের কাছ থেকেই নিয়েছি কিনা কেজানে । বন্দরে নদীর পাশ পাড় ঘেঁষে লাগান অলিভ গাছ আর পরিতাক্তজাহাজের কাঠ আর ডিজাইন দেখতে লাগলাম নয়ন ভড়ে।
https://britbangla24.com/news/93323/
দুপুরে একটা কাফে’ তে ঢুঁকে বাফোলো পিজ্জা সাথে গারলিক ব্রেড, একটা বিশাল গ্লাসে পরিবেশিত আইরান দই ড্রিঙ্ক যা নাকি আমাদেরকুমিল্লার জগত বাজারে সকালে বিক্রিত মাঠা র মত স্বাদে অনেকটা ।ভরপুট খেয়ে চেপে বসলাম বাঁশে ট্রিএসট যাবার ফেরি ধরতে ; কি সুন্দরবাস – ঠাণ্ডা, নেই কোন কোলাহল, নেই বাসের কোনও বাসের কন্ডাক্টারআওয়াজ বা বাসের গাঁয়ে ঘন ঘন থাপ্পড় মারার বিকট শব্দ ; ড্রাইভার কেতো দেখলে মনে হবে যেন অফিস ফেরত কোন বড় কর্মকর্তা ; আপন মনেগান গাচ্ছে আরে অটোমেটিক বাস তা দিব্বি আরামেই চালিয়ে যাচ্ছে – বিশাল ৪ লেনের মোটর ওয়ে । ভিড় নাই তেমন , বাম হাত চালিত ; আমাদের মত ডান হাত চালিত নয়। ফেরির কাছের শহর এ গাড়িপারকিং পাওয়া বড়ই কঠিন তাই আক্যিলার নিকট এর বড় ট্রেন স্টেশনেগাড়ি রেখে বাসে চরলাম আমরা দুজন।
https://britbangla24.com/news/93829/
ত্রিশ পঁয়ত্রিশ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে – সমুদ্র সৈকত শহরগ্রাডো তে ; নেমেই বাস স্টপের পিছন দিকেই শহর ঢুঁকে পরলাম। আইফোনে তাকিয়ে দেখি ৩৮ ডিগ্রি গরম – দুস্তর মত ঘামতে লাগলাম ।আমাদের লন্ডনে সচরাচর ইন্দে চান্দে ৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রা পৌঁছায় ক্বচিৎ। টাউন সেন্টার দিয়ে হেঁটেই পৌঁছে গেলাম সমুদ্র তীরে – ও মা গো, তটেআমার চক্ষু চড়ক গাছে , সমুদ্রের পাড়ে নগ্নপ্রায়, অর্ধ নগ্ন আবাল বৃদ্ধবনিতা বালক বালিকা , কিশোর এবং শিশু মিলিয়ে শুয়ে শুয়ে রৌদ্র স্নানেমগ্ন কম করে হলেও এক ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার মানুষ । তিল ধারণেরজায়গা নাই – কেউ সাঁতার কাটছে, কেই শামুক কুরাচ্ছে, কেই ওয়াটার স্কিমটর স্কুটার চাল্লাছে, কেই গ্লাইডিং করছে, আবার কেই কেউ ছোট্ট ডিঙ্গিবিয়ে বেয়ে চলে যাচ্ছে তীর থেকে বেশ মাইল খানেক গভীর সমুদ্রের দিকেআর বাকিরা চিৎপটাং হয়ে বা উব্বুত হয়ে শুয়ে শুয়ে শরীর কে রোদখাওয়াচ্ছে সাদা গাঁয়ের চামড়া কে রোডের আগুণের মত গরম তাপেপুড়িয়ে তামাটে চামড়া করার জন্য – যখন সারা ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশএর মানুষ রা গাঁয়ের রং ফরসা করার জন্য পাগল তখন ওর চাচ্ছে গাঁয়েরতামাটে রঙের মত করে একটু আমাদের মত গাঁয়ের কড়ারা প্রয়াসে ব্যাস্ত ; আজব একটা জগত এটা ; একটা বেঞ্চি তে বসে বসে একটা ভ্যানিলাআইস ক্রিম খেয়ে একটু ঠাণ্ডা হতে চেষ্টা করলাম ।
গ্রাডো শহর থেকে ফেরি তে করে ২৫ মিনিট – ৩৫ মিনিট এ পৌছাযায় – ট্রিএস্ট শহরে – একে বারে ক্রোয়েশিয়া দেশের পাদদেশে । বেশজায়গা হেঁটে এসে পৌঁছে গেলাম ফেরি ঘাটে । বিরাট এক লম্বা লাইন ; প্রচণ্ড গরম ; দুস্তর মত সিলেটের পুরানা রং মহল সিনেমা হলে বসেসিনেমা দেখার সময় যে রকম ভ্যাপসা এক ধরনের গরম – আইফোন এদেখলাম ৩৯.৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা ; ঘাড়ের উপর থেকে হাভ্যারস্যাক টানামিয়ে আরেকটা নতুন পানির বোতল বের করে পানি পান করতেলাগলাম – কড়কড়া রোদ…….
গ্রাডো শহর টা আসলেই একটা অপূর্ব শহর একপাশে সমুদ্র সৈকতএ কোলাহল এবং ব্যাস্ততা আর জাহাজ ঘাটের পাশের এলাকা টা একদমচুপচাপ । লাইন লাইন সাড়ি সাড়ি বাড়ি গুলো একটার গা ঘেঁষেআরেকটা বাড়ি দুই টা বাড়ির একটা কমন ওয়াল ; বাংলাদেশের শহরেরমেস জাতীয় টেরাস এর মত । দেখেই বুঝা যায় ১৭স খ্রিস্টাব্দে কিংবাতারও আগে এই বাড়ি গুলো বানানো কোনটা
সাদা রং করা, কোনটা নীল, বাড়ির রং গোলাপি আবার কোনটাকালো, দরজার সামনে ঢুকার প্যাসেজে তিমি মাছের মূর্তি, কোন কোনবাড়ির সামনে মৎস্য কন্যার মূর্তি, বাড়ি গুলোর নাম গুলোও বেশ সুন্দরপেস্কাটাউরে ( জেলে দের ) হাউস, বারকা ঘর ( নৌকা ), পেইসে ( মাছ), আরও অনেক মৎস্যজীবী জাতীয় নাম ওদের বাসা গুলোর । সব খালিপ্রায় সবাই ই চলে গেছে গ্রীষ্ম কালীন হলিডে করতে – প্রসঙ্গ ক্রমে বলতেহয় এই যে , ১৫ ই অগাস্ট ইতালির সবচে বড় আউটিং করার দিন, ঐ দিনকেই ই ঘরে থাকে না – বার বি কিউ, সাইকেল চড়ে গুড়ে বেড়ানো, আল্পাইন পর্বত এ উটা , কিংবা স্পিড বোটে করে ওয়াটার স্কি করা, বা একশহর থেকে আরেক শহরে চল্লিশ বা তারও অধিক মাইল হেঁটে হেঁটে ভ্রমণকরার জন্য বেরিয়ে পরা ওদের রেওয়াজ । অনেক গুলো বাড়ির সাড়ি পেরহয়ে গুগল ম্যাপ ধরে ধরে লঞ্চ ঘাটে এসে পৌঁছলাম ; মনে পরে গেল সেইগোয়ালন্দ ঘাট এর স্মৃতি, মনে পরে গেল ছোট বেলা মায়ের সাথে ছুটিকাটাতে আসতাম মামার বাড়িতে খুলনা থেকে প্যাডেল স্টিমারে করেআস্তে হত নারায়ণগঞ্জে – তৎকালীন সময়ে নারায়ণগঞ্জে লঞ্চ ঘাটেইয়েলো ট্যাক্সি পাওয়া যেত, আর ঐ ট্যাক্সি তে করে আসতাম নারায়ণগঞ্জথেকে ঢাকা আজিমপুর কলোনিতে ; সারা রাস্তা তখন থাকত নিয়নবাতির আলোয় প্রজ্বলিত – পিছনের সিটের জানালা দিয়ে মাথা উঁচু করেসাইনবোর্ড গুলো পড়তাম – নিওন সাইন গুলোর উজ্জ্বল আলো গুলোআজও আমাকে সেই আগের মতই উদ্বেলিত করে – কিন্তু ইতালির লঞ্চঘাট অন্য রকম, এখানের স্টিমার বা লঞ্চ ঘাটে কেবল দেখতে পেলাম গতি, চাঞ্চল্য ও বেগ কিন্তু দেখতে বা উপলব্ধি করতে পারলাম না কোনআবেগ ! সেই ছোট বেলায় বানী চিরন্তনী বইতে পড়েছিলাম, আধুনিকসভ্যতা দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ – এখানে এসে তাবোধগম্য হলো হাড়েহাড়ে। জাহাজ ঘাটে প্রায় ১০০ মানুষ নীরবে নিশ্তব্দভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে পরবর্তী জাহাজ কখন ভিড়বে – সবাই উঠেচড়ে বসবে জাহাজে । কারোর সাথে কারোর কোন কোথা নাই , নীরবসবাই, স্যুটকেস, রাক্সাক, বাচ্চাদের প্রাম, দড়ি বাধা বাচ্চা কাচ্চা যাতেদৌড়ে যেয়ে কোথাও পড়ে না যায় , বা কোন এক্সিডেন্ট আবার ঘটিয়েবসে, আস্থে আস্তে দেখতে পেলাম একটা কেটামেরান – এক ধরনেরজাহাজের পাদদেশ (হাল) – যা কিনা সহজেই পানি কেটে এগিয়ে যেতেপারে অন্যান্য বোটের ডেকের ( তলদেশ) মত এটা সম্পূর্ণ পানি স্পর্শকরে না – এই জাতীয় হাল (পাদদেশ) ওরা নকল করেছে আমাদেরই পূর্বপুরুষ দ্রাভিদিয়ান তামিল দের কাছ থেকে ; এন্থ্রপোলোজী এর মতেআমরা বাঙ্গালিরা এরিয়ান ( পারশ্য থেকে উত্তর ভারত হয়ে এসেছিলবাংলায় ) এবং বে অফ বেঙ্গল এঁর দক্ষিণ প্রান্ত থেকে নৌকা বা জাহাজেএসেছিল দ্রাভিদিয়ান – তামিল রা এবং এদের সংমিশ্রণের ফসল ইআমাদের ডি এন এ তে প্রাবাহিত ক্রোমোজম –তা তে একটু হলেওআনন্দিত হলাম যাক সুদূর ইতালিতে এ এরা আমার পূর্বসূরিদেরআবিষ্কৃত জাহাজের ডিজাইন ব্যবহার করছে । হয়ত বা তামিল দেরলেগাছি আমরা এখনো বহন করছি আমাদের ভাসায় – যেমন; আম্মা ( একটি তামিল শব্দ ), আব্বা ( ওরা বলে আপ্পা), যেমন আমরা এবং ওরাবলি লুঙ্গি কে লুঙ্গি, ওরা বলে নদিতে কে নতি আর আমরা বলি নদী , ওরা বলে চুরুট আমারও বলি চুরুট, ওরাও আমাদের মত বলে নক্ষত্র কেনক্ষত্র, ওরা চাউল কে বলে ওদানা আমরা ও বলি দানা । এই সব কি সবঅসংলগ্ন অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে পাড়ে ভিড়ল তরী – মনে পড়ল, মাএঁর আবৃতি করে কয়েকটা পংতি ,’’ ঠাই নেই , ঠাই নেই ছোট এ তরীআমারি সোনার ধানে গিয়াছে ভরি ।’’
ভিড় ক্রমশ কমে যাওয়ার পর উঠলাম জাহাজে – জীবনেও কোনব্যাপারে তাড়া ছিল না আর আজো নাই তেমনটা ; উঠে প্রথমে ডেকেরভিতর ছায়ায় বসলাম ; রোঁদের তাণ্ডবটা ঠেকে বাঁচার জন্য । বসেই দুটোঠাণ্ডা পানীয় এবং দুটো শ্যালমণ মাছের পেটী দিয়ে বানানো স্যআন্ডুউূইচ অর্ডার করলাম অপেক্ষা করতে করতে পেতে জানি কেমন ক্ষুদা লাগতেলাগল – অন্য সময় হলে হয়ত কখনই এভাবে খেতাম না – শরীরের ওজনএবং বয়স অনুযায়ী রক্ত চাপ, বহুমূত্র জাতীয় অসুখ বিশুখ থেকে দূরেথাকার একমাত্র উপায়ই হল খাওয়ার লোভ এবং অহরহ যেখানে সেখানেযা পেলাম তা না খাওয়া । আর ভাবলাম এই অবকাশ( হলিডে ) থেকেযেয়ে কয়দিন বেশ কয়েক বেশি করে হাঁটবো তা হলেই সব আবার জায়গামত চলে আসবে । মানুষের সব সমস্যার সমাধান কেবল সেই করতেপাড়ে ; সেলফ হেল্প হল সবচে বড় হেল্প ।
ইতিমধ্যে ঠাণ্ডা পানিও এবং টাটকা ধরা মাছের স্যআন্ডুউূইচ এসেগেল – বেশ রিলাক্স করেই বসে বসে খেলাম আর দূর এ দেখতে পেলামগ্রাডো শহর ফেলে চলে যাচ্ছি দূরে বহু দূরে , প্রচণ্ড দ্রুত গতি সম্পন্ন এইজাহাজ খানা – একটা লোওার ডেক আর উপড়ে খোলা আকাশের নিচেখোলা বসার চেয়ার । প্রায় ৬০ – ৭০ জন যাত্রী আর সাইকেল হবে ত্রিশটা । লোওার ডেকের সামনেই ছোট একটা বো এরিয়া ওখানে বেশ দুটোবেঞ্চ এ বসার জায়গা ; ফ্রেডি বলল চলেন সামনে গিয়ে বসি – খাওয়াশেষ করে স্টারবোর্ড সাইডে যেয়ে একটু ফার ব্যাঙ্ক তা অবলোকন করলাম– জাহাজে দুই টা সাইড থাকে একটা হল পোর্টসাইড যেটা ছেড়ে আসাপোর্টের সাইড আর একটা হল স্টারবোর্ড সাইড যেটা আগেরটার বিপরীতসাইড – দূরের সমুদ্র দেখার সাইড ।
অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ধাবমান এই কাটাম্যারান – সমুদ্রের বুকে মসৃণপানি ভাটির সময় পোর্টে দেখেছিলাম জোওার আসার কথা বেলাবিকাল ৫ টা ত্রিশ এর পর। দূরে এক চিলতে মিষ্টি কুমড়ার ফালির মতএকটা ফালি তুল্য অংস টুকু ইতালির সীমানার ভিতর কলসির বাবোতলের গলার মত ঢুকে বাসে আছে ক্রোইয়েশিয়া – ঠিক আমাদেরদেশের যেমন আছে শিলিগুড়ি করিডোর ঠিক তেমনি । জাহাজ টা ঐদিকেই ধাবিত হছে – শিপের বো তে গিয়ে ঐখান থেকেই আইফোনএ একটা তিন চার মিনিটের ফেছবুক লাইভ দিলাম – আমার স্যোসালমিডিয়ার ৪০০০ বন্ধু এবং ৩০০০ হাজার ফলোয়ার দের জানিয়ে দিলামআমি কোথায়, কি করছি, কোন দেশে , কোন সাগরের উপর দিয়ে ধাবিতহচ্ছে আমার এই সোনার তরি …… ! চলবে ….
লেখক : বাংলাদেশের সাবেক সেনা সদস্য ও ইতিহাসবিদ, ব্যবসায়ী এবং কমিউনিটি এক্টিভিস্ট। নর্থাম্পনশায়ার।