ইসলামে মৃত্যুর প্রস্তুতি

                     ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী
পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন সত্য হলো মৃত্যু। প্রত্যেক মানুষকেই মৃত্যুর স্বাধ গ্রহণ করতে হবে। ধন -সম্পদ, জ্ঞান – গরিমা কিংবা বুদ্ধি -মত্তার জন্য মানুষ অনেক কিছু থেকে রেহাই পেতে পারে, তবে মৃত্যু থেকে রেহাই পাবার কোন সুযোগ নাই। সকল ধর্মেই মৃত্যুর কথা আছে আর পবিত্ৰ ধর্ম ইসলামে মৃত্যুকে সার্বক্ষণিক স্মরণ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তারপরও আমরা কি সেই কঠিন সত্যকে জানার কিংবা মনে রাখার চেষ্টা করি?
আমার শ্বশুর বাড়ি অস্টারশায়ার, লন্ডন থেকে প্রায় ১৫০ মাইল দূরে। আমার শ্বশুরের বয়স হয়েছিলো প্রায় ৮০ বছর, বেশ কিছুদিন থেকে ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। গত শুক্রবার খবর আসলো উনার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। লক ডাউনের মধ্যেও চিন্তা করলাম শেষ বারের মতো একবার দেখে আসবো। ১৮ তারিখ শনিবার দুপুর বেলা উনাকে দেখতে গেলাম, দেখে মনে হলো উনার সময় একেবারে শেষ প্রান্তে। ঘরে মাকে একা রেখে গিয়েছিলাম, তাই রাতে আবার চলে আসতে হলো। লন্ডনে ফেরার ৩ ঘন্টার মধ্যে খবর আসলো উনি ইন্তেকাল করেছেন। সাথে সাথে আবার রওয়ানা হলাম অস্টারশাইর। রাত তখন ১২টা ৪০ মিনিট, মোটর ওয়ের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম জীবন নিয়ে। আমাদের জীবন কতো ছোট আর এই ছোট্ট জীবনে কতজনকে পেলাম আর কতজনকে হারালাম। এই ছোট্ট জীবনে বাবা, চাচা, ফুফু, বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়-স্বজন কতজনকে হারিয়েছি, সময়ের আবর্তে তারা আজ কেবলই স্মৃতি। যাদেরকে একসময় পরম মমতায় আগলিয়ে রাখতাম, তাদেরকেই একদিন সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে গর্ত করে রেখে আসতে হয়েছে। যে সন্তানকে জীবনের সব কিছু উজাড় করে লালন-পালন করবেন, সেই সন্তানই একদিন আপনাকে পরম মমতা দিয়ে মাটির নিচে কবরে শুইয়ে দিয়ে আসবে। তার হাজারো ইচ্ছা থাকলেও এর ব্যতিক্রম করার কোন উপায় নাই। এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কি হতে পারে? তারপরও আমরা সেই কঠিন সত্য মৃত্যুকে নিয়ে ভাবিনা।
তবে আমি নির্ধিদায় বলতে পারি, বর্তমান মহামারী মৃত্যু সম্পর্কে আমাদের মধ্যে বেশ সচেতনতা তৈরী করেছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেকেই ভুল-ভ্রান্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। অনেকেই বলছেন, যদি আমার মৃত্যু হয় তাহলে ক্ষমা করে দিবেন। আমার মনে হয় হাজার বছর ধরে ধর্মীয় জ্ঞান যা এতদিন করতে পারেনি, করোনা ভাইরাস তা সফল ভাবে করতে পেরেছে। অর্থাৎ আমাদেরকে মৃত্যু সম্পর্কে সজাগ করেছে এবং মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিতে বলছে। মানুষের এই সচেতনতা এবং অনুভূতিকে আমি সাধুবাদ জানাই। কিন্তু প্রশ্ন হলো – শুধু কি ভুলের ক্ষমা প্রার্থনাই যথেষ্ট নাকি ধর্মীয় দৃষ্টি কোন থেকে আমাদের আর কিছু করার আছে? আমার মনে হয় ভুল ভ্রান্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনার পাশাপাশি আমাদের আরো কিছু বিষয় করা দরকার।
তওবা করা: মৃত্যুর প্রস্তুতি হিসাবে আমাদের অতীত ভুলের জন্য বেশি বেশি করে তওবা করা প্রয়োজন। আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যদি কেউ দৃঢ় বিশ্বাস এবং আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর কাছে তওবা করে, তাহলে আল্লাহ তার তওবাকে কবুল করেন। এই মহামারীর সময় অতীত ভুলের জন্য আমাদের বেশি বেশি তওবা করা প্রয়োজন।
সদকা বা দান: আল্লাহর কাছে অতীত গুনাহ মাফ চাওয়ার পাশাপাশি দান-খয়রাত করা প্রয়োজন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, পানি যেমন আগুন নেভায় সদকা বা দান ও ঠিক সেভাবে আমাদের পাপ মোচন করে। মহামারীর কারণে ঘোটা বিশ্বে আজ অভাব অনটন তৈরী হয়েছে। অনেক মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। অনেকেই আমাদের হাতের দিকে চেয়ে আছে। সদকা বা দান খয়রাত করার এখনই উপযুক্ত সময়। মনে রাখতে হবে দান করলে সম্পদ কমেনা বরং বৃদ্ধি পায়। সুতরাং আমাদের উচিত যার যতটুকু সম্পদ আছে তা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো।
বেশি বেশি করে আল্লাহকে স্মরণ করা: পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা, রোজা রাখা এবং নফল এবাদতি করা এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা। আল্লাহর কাছে সবসময় আত্মসমর্পন করার পাশাপাশি ভালো কাজ করা এবং ভালো কাজের সাথে নিজেকে যুক্ত করার জন্য প্রার্থনা করা।
পাওনা পরিশোধ করা: জীবিত থাকা অবস্থায় পাওনা পরিশোধ করা। আর মৃত্যু হলে – হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, একজন মুমিনের আত্মা অস্থির থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত তার ঋণ পরিশোধ না করা হয়। সুতরাং মৃত্যুর আগে অপরের হক অথবা পাওনা পরিশোধ করা একান্ত কর্তব্য।
ক্ষমা চাওয়া: জেনে শুনে কাউকে আঘাত বা কষ্ট দিলে তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। অন্যতায় কেয়ামতের দিন সে আল্লাহর কাছে আপনার কৃত কর্মের ন্যায় বিচার দাবি করবে।
সুতরাং অনলাইনে বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নেয়া আর ভুল ভ্রান্তির জন্য ক্ষমা চাওয়ার পাশাপাশি আমাদের আত্মশুদ্বিরও প্রয়োজন। অতীতের কৃত কর্মের অনুশোচনার সাথে ভবিষ্যৎ জীবনকে সুন্দর ভাবে সাজানোর পরিকল্পনা গ্রহণেরও দরকার। অহংকার, গৌরব আর ক্ষমতা কিছুই দীর্ঘস্থায়ী নয়। আপনি যত বড় ক্ষমতাবান লোক হোন মৃত্যুর কাছ থেকে আপনি বাঁচতে পারবেননা। আর মৃত্যুর পর আপনার মান-সম্মান, ধন-সম্পদ কিছুই সঙ্গী হবেনা, সঙ্গী হবে শুধু আপনার ভালো কাজ। আসুন আজ থেকে প্রতিজ্ঞা করি – কোন মন্দ কাজ করবোনা, ভালো কাজ করবো, অপরের হক আদায় করবো, মানুষের পাওনা পরিশোধ করবো আর জেনেশুনে কোন মানুষকে কষ্ট দিবোনা অথবা কোন মানুষের কষ্টের কোন কারণ হবোনা।
উপরের উল্লেখিত বিষয় ছাড়াও আরো অনেক বিষয় আছে যা আমল করা আমাদের একান্ত প্রয়োজন। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে কোন ইসলামিক স্কলার নই। তবে আমি যতটুকু জেনেছি আপনাদের সাথে শুধু শেয়ার করার চেষ্টা করেছি। সবশেষে দোয়া করি মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। করোনা ভাইরাসের মহামারী থেকে আমাদের রক্ষা করুন এবং আমাদের নেক আমল করার তৌফিক দান করুন।

লেখক:
ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী
কন্ট্রিবিউটর, ব্রিট বাংলা২৪ এবং প্রিন্সিপাল সলিসিটার, কেসি সলিসিটর্স, লন্ডন।

Advertisement