ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: নির্বাচন কমিশনের মামলায় ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য মুজিবর রহমান চৌধুরী নিক্সনের আগাম জামিন বহাল রেখেছে আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত। তাকে হাইকোর্টের দেয়া ৮ সপ্তাহের আগাম জামিন স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্র পক্ষ। সেই আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতের বিচারপতি মুহাম্মদ নুরুজ্জামান হাইকোর্টের দেয়া জামিন বহাল রাখেন।
আদালতে নিক্সন চৌধুরীর পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট আব্দুল বাসেদ মজুমদার ও সাইদ আহমেদ রাজা এবং রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুল ইসলাম শুনানি করেন।
এর আগে মঙ্গলবার (২০ অক্টোবর) হাইকোর্টে হাজির হয়ে আগাম জামিন চান নিক্সন চৌধুরী। উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি কেএম জাহিদ সারোয়ারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ আট সপ্তাহের আগাম জামিন মঞ্জুর করেন।
আদালতের আদেশে বলা হয়েছে, নিক্সন চৌধুরী মহান জাতীয় সংসদের একজন সংসদ সদস্য। জামিন আবেদনের স্বপক্ষে তার আইনজীবী যে বক্তব্য তুলে ধরেছেন তা বিবেচনার যোগ্য বলে আমরা মনে করি। এ কারণে সীমিত সময়ের জন্য শর্তসাপেক্ষে তাকে জামিন দেওয়া হলে তা ন্যয় সঙ্গত হবে।
এদিকে আদালতের আদেশের পর নিক্সন চৌধুরী বলেন, ‘আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এটা নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের একটি মামলা। ওই মামলায় আদালত আমাকে আগাম জামিন দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমি বারবার বলে এসেছি, আমার ফোনালাপের রেকর্ডিংয়ে যতটুকু কথা আছে, ততটুকু তো ফরিদপুর জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কাছেই আছে। কিন্তু উনার মাধ্যমে এটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিভাবে আসলো, সেই প্রশ্ন আমি তুলে আসছি এবং এটারও বিচার হওয়া উচিৎ। উনাকে (ডিসি) তো বলতে হবে এটা কিভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গেল। এটাও তো আইনত অপরাধ। সরকারই উনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, সে আশা আমি করছি এবং জনগণ করছে। জেলা প্রশাসক সেটা যখন দেবেন সরকারকে, তদন্ত হবে, তখনই প্রমাণ হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে ইনশাল্লাহ তা আদালতেই মোকাবেলা করব। আর আমি তো প্রথম থেকেই বলেছি, এটা অসত্য জিনিস, এটা এডিটিং করে বানানো হয়েছে।’
গত ১০ অক্টোবর চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে গত ১৫ অক্টোবর ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা-সদরপুর-চরভদ্রাসন) আসনের সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন ফরিদপুরের জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা নওয়াবুল ইসলাম। মামলা দায়েরের পর তা মিথ্যা ও বানোয়াট আখ্যায়িত করে এমপি নিক্সন চৌধুরীর নেতাকর্মীরা তিন উপজেলাতেই বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এ ছাড়া ঢাকায় দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সব সভা-সমাবেশ থেকে নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ইসির মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে।
ইসির মামলায় গত রবিবার হাইকোর্টে আগাম জামিন চেয়ে আবেদন করেন নিক্সন চৌধুরী। মঙ্গলবার শুনানির জন্য দিন ধার্য করে আদালত। সেই মোতাবেক সকালে হাইকোর্টে হাজির হন স্বতন্ত্র এই সংসদ সদস্য। হাজির হন তার নির্বাচনী এলাকার কয়েকশত নেতাকর্মী। বেলা দেড়টায় জামিন আবেদনের উপর শুনানি শুরু হয়। এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন নিক্সন চৌধুরী।
জামিন শুনানিতে তার আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে চিঠিপত্র এবং সকল নাগরিকের যোগাযোগের গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১ এ বলা হয়েছে, সরকার জাতীয় নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার স্বার্থে টেলিফোন কোম্পানিকে রেকর্ড (কোন ব্যক্তির কথোপকথন) করার আদেশ দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে রেকর্ড করার আদেশটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর আদেশক্রমে হবে। কিন্তু নিক্সন চৌধুরীর ফোনালাপ রেকর্ডের ক্ষেত্রে সে ধরনের কোনো আদেশ দেওয়া হয়নি। তাই তার ফোনালাপ বেআইনিভাবে রেকর্ড করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করায় সংবিধানের লঙ্ঘন হয়েছে। আর ওই ভাইরাল হওয়া অডিও রেকর্ড দিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে ইসি। এ কারণে উক্ত মামলা প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি বলেন, সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চের রায়ে নাগরিকের ফোনালাপ ফাঁস নিয়ে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে। ওই রায়ে বলা হয়েছে, সংবিধানেই নাগরিকের গোপনীয়তা রক্ষার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। চাইলেই নাগরিকের সাংবিধানিক এই অধিকারকে লঙ্ঘন করা যায় না। সেই রায়ের আলোকে এই অডিও রেকর্ড ফাঁস সংবিধান ও রায়ের লঙ্ঘন।
তিনি বলেন, জামিন আবেদনকারীর বিরুদ্ধে নির্বাচনের পরে সভা-সমাবেশ করে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু মামলার এজাহারে নিক্সন চৌধুরী ছাড়া অন্য কারো নাম নাই। নেই অজ্ঞাতনামাও। কারণ একজন মানুষের পক্ষে একা সভা-সমাবেশ করা কখনই সম্ভব নয়।
জামিনের বিরোধিতা করে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জান্নাতুল ফেরদৌসি রূপা বলেন, একজন সংসদ সদস্য নির্বাচনের পরে মিছিল ও শোডাউন করে আইন ভঙ্গ করেছেন। এতে শপথের লঙ্ঘন হয়েছে। এ পর্যায়ে আদালত বলেন, একজন ব্যক্তির পক্ষে কি মিছিল-শোডাউন করা সম্ভব? ডিএজি বলেন, একজন করেননি, আরো অনেকেই ছিল। আদালত বলেন, এজাহারে তো একজনকে আসামি করা হয়েছে, অজ্ঞাতনামাও নেই। তাহলে একজন ব্যক্তি কিভাবে মিছিল-শোডাউন করল?
জামিনের বিরোধিতার জবাবে ড. শাহদীন মালিক বলেন, মেম্বারস অব পার্লামেন্ট ডিটারমিনিশেন অব ডিসপিউটেড অ্যাক্ট, ১৯৮০-তে বলা হয়েছে যে, কোনো সংসদ সদস্য যদি শপথ ভঙ্গ করেন তাহলে তা দেখার এখতিয়ার জাতীয় সংসদের স্পিকারের। এটা দেখার দায়িত্ব কোনো থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) নেই। শুনানিকালে ড. শাহদীন মালিককে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট মনজুর আলম। শুনানি শেষে আগাম জামিন মঞ্জুরের পাশাপাশি মামলার তদন্তে সহযোগিতা করা ও সাক্ষীদের প্রভাবিত না করার জন্যও বলেছে হাইকোর্ট।