।। এম.হাসানুল হক উজ্জ্বল।।
শিক্ষক জাতি গঠনের অন্যতম কারিগর। সমাজ বদলাতে শিক্ষকদের ভুমিকা অপরিসীম। এজন্য শিক্ষক হওয়া চাই আদর্শবান। একজন নীতিবাদ শিক্ষকের আদর্শ অনুস্মরণ ও তাঁর দেয়া শিক্ষাকে লালন করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ভালো কাজে আত্মনিয়োগ করতে পিছপা হওয়ার কথা নয়। শিক্ষকরাই ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ শেখাতে উৎসাহিত করেন। সুশিক্ষার মাধ্যমে কিভাবে জাতিকে উন্নত শিখরে নিয়ে যেতে হয়, সে পথ দেখান শিক্ষক।
বর্তমান সমাজে শিক্ষকতা পেশা নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। কতিপয় শিক্ষকরা নোংরা রাজনীতির সাথে জড়িয়ে মহৎ এই পেশাকে কলুষিত করছেন। ইদানিং একজন শিক্ষকের শিক্ষকতা ছেড়ে রাজনীতিতে যোগদান করার মন্তব্য দেশ বিদেশে আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ওই শিক্ষক বলেছিলেন যুবলীগের দায়িত্ব পেলে নাকি তিনি তাঁর পদ ছেড়ে দিবেন! এ ঘোষণা আসার পর থেকে দেশ জুড়ে শুরু হয় নানা আলোচনা সমালোচনার। যদিও তিনি পরে এর ব্যাখা দিয়েছিলেন।
আমাদের সমাজ ঘুণে ধরেছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। যাদের কাছ থেকে সুশিক্ষা গ্রহণ করার কথা রয়েছে। তারা আজ রাজনীতির সাথে জড়িয়ে ছাত্রদের সাথে সমান তালে রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। নিজের নীতি নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে কতিপয় শিক্ষক কি-না করছেন এ দেশে? তারপরও এ দেশে শিক্ষকদের কদর গুনীজন থেকে শুরু করে সকলের কাছে উচ্চ আসনেই রয়েছে। যা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
যাক যে প্রসঙ্গ নিয়ে আজ লেখাটির সূত্রপাত সেই প্রসঙ্গে চলে আসি। প্রতিটি মানুষের জীবনে একটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। আর এই লক্ষ্য আর উদ্দেশ্যকে সফল বাস্তবায়ন ঘটাতে নিজের কর্মগুনকে সরল রেখার সাথে মিলিয়ে ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলার ক্ষমতা রাখতে হয়। আজ এমন একজন মানুষ নিয়ে আলোকপাত করবো; তিনি আর কেউ নন, একজন সাধারণ মানুষ। মানুষ গড়ার কারিগর। যিনি গ্রামের মেঠো পথ বেয়ে নিজ এলাকা ছেড়ে অনেক দুরে গিয়ে জাতি গঠনে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন।
তিনি আর কেউ নয়, তিনি হচ্ছেন হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রয়াত শিক্ষক তজম্মুল আলী। সকলে তাকে টি আলী স্যার হিসেবে চিনেন। এই শিক্ষকের জীবন ও কর্ম পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সমাজে এ রকম আদর্শবান মানুষের জন্ম হয়েছিল বলেই তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে সমাজ উন্নয়নের হাতিয়ার হয়ে অনেকে উচ্চতার শিখরে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন।
তজম্মুল আলী স্যারকে হবিগঞ্জের মানুষজন টি আলী স্যার অথবা সিলেটি স্যার হিসেবে চিনতেন। গুনী এই মানুষ গড়ার কারিগর তার কর্মের মাধ্যমে হবিগঞ্জবাসীর হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর ছাত্ররাই সে সময় হবিগঞ্জকে গুণী এই শিক্ষকের বাড়ী মনে করতেন।
টি আলী স্যারের প্রতি শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা আর স্যারের কর্মগুনে সকল শ্রেনী ও পেশার মানুষকে আপণ করে নেয়ার কারণে তিনি দাপটের সাথেই তাঁর কর্মজীবন কাটিয়েছেন। কাউকে তিনি বুঝতে দিতেন না যে তিনি অন্য জেলা থেকে হবিগঞ্জ গিয়ে শিক্ষকতা করছেন। স্কুলে নিয়মিত উপস্থিতি, হলে ছাত্রদের নিজ সন্তানদের মতো করে দেখভাল করাসহ তাঁর কর্মকান্ডই সকলকেই ভুলিয়ে দিয়েছিল যে, তিনি অন্য জেলার বাসিন্দা হিসেবে তাঁকে নিয়ে কল্পনা করার বিষয়টি।
টি আলী স্যার হবিগঞ্জে শিক্ষকতা করার কারণে হবিগঞ্জবাসী তাঁকে তাদের হৃদয়ে ধারণ করে রেখেছেন। কিন্তুু নিজের উপজেলা বিয়ানীবাজারবাসীর কাছে তিনি রয়েছেন আড়ালে। বিয়ানীবাজারের অনেকেই এই কৃতি মানুষ গড়ার কারিগরকে ভালো করে জানেন না। তাই অনেকে এই শিক্ষকের গুনাবলির মর্যাদা দিতে পারছেন না।
গুনী এই মানুষগড়ার কারিগর তজম্মুল আলী প্রকাশ টি আলী স্যারের বাড়ী সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলায়। তিনি লাউতা ইউনিয়নের কালাইউরা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ৩ ভাই ২ বোনের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ তজম্মুল আলী জন্ম গ্রহণ করেন ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে। মরহুম আনজু মিয়ার পুত্র তজম্মুল আলী শিক্ষা জীবন শুরু করেন তৎকালীন জলঢুপ মধ্যবঙ্গ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। পরবর্তীতে ভারতের শিলচরে একটি বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা জীবন শেষে করেই শিক্ষকতা পেশায় জড়িয়ে পড়েন। নিজ এলাকাকে আলোকিত করার লক্ষ্য নিয়ে তিনি ১৯৩৫ সালে বড়লেখার সুজাউল মাদ্রাসায় যোগদান করে কর্ম জীবনের সূচনা ঘটান। সেখান থেকে তিনি চলে আসেন বিয়ানীবাজারের মাথিউরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ৫ বছর প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে চলে যান ভারতের বদরপুরের ভাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৪২ সালে এই বিদ্যালয়ে যোগদান করলেও ২ বছর পর ১৯৪৪ সালে করিমগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন। করিমগঞ্জে ১ বছর শিক্ষকতা করার পর আবারও চলে আসেন সুনামগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৪৫ সালে যোগদান করলেও ১৯৪৬ সালে আবার তাকে শিলং সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করতে হয়। সেখান থেকে বদলী হয়ে হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। আর সেখানে ৩১ বছর শিক্ষকতা পেশার সাথে যুক্ত থাকার পাশাপাশি তিনি প্রায় দেড় যুগেরও বেশি সময় স্কুলের মুসলিম ছাত্রাবাসের হল সুপারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
শিক্ষকতা জীবনের সাথে যুক্ত হওয়ার পর থেকে টি আলী স্যার পরিবার থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তা কিন্তুু ভিন্ন কোন কারণে নয়; শিক্ষকতা মহান পেশাকে নেশা হিসেবে গ্রহণ করে নেয়ার কারণে তা হয়েছে। একদিকে যোগাযোগ ব্যবস্থার দুরাবস্থা অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠায় বাস্তবতা তাকে অন্য জগতে নিয়ে গিয়েছিল। নিজের স্ত্রী, সন্তান-সন্ততির কথা বিবেচনায় না এনেই তিনি তার কর্মজীবনকেই প্রাধান্য দিয়ে যেতেন।
টি আলী স্যার সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে এই মানুষ গড়ার কারিগর সম্পর্কে তৎকালীন সময়ের তাঁর ছাত্ররা গুনাবলী সম্পর্কে অনেক তথ্য উপস্থাপন করেন। এই গুণী শিক্ষক তাঁর কর্মগুণে তৈরী করে গেছেন একঝাঁক আদর্শ দেশপ্রেমিক। তাঁরা তার কাছ থেকে সুশিক্ষা গ্রহণ করে সমাজের উচ্চ শিখরে পৌছেছেন। নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশ-বিদেশের উচ্চ আসনে। টি আলী স্যার সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে তাঁরই ছাত্র কাজী তোফায়েল আহমদ জানালেন, স্যারের গঠন আকৃতি অনেকটা খাঁটো হলেও তাঁর মেধা মননশীলতা, কণ্ঠস্বর ও সাহস ছাত্রদেরকে সব সময় ভয়ের মধ্যে থাকতে হতো। স্যারের মন যেমন কঠিন ছিল তেমনি ছিল নরম। শিক্ষক হিসেবে তাঁর তুলনা নেই উল্লেখ করে বলেন, স্যার ন্যায়পরায়ন ছিলেন। তাই স্যারকে সবাই ভালো চোঁখে দেখতেন। ভালো কাজের জন্য তাঁর সহযোগিতা নিতেন। টি আলী স্যারের সাহসের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে কাজী তোফায়েল আহমেদ জানান, হবিগঞ্জ শহরে তুমুল মারামারি চলছে, কোন মতেই থামানো যাচ্ছে না। স্যারের কাছে খবর এলো তার স্কুলের ছাত্ররা শহরে মারামারিতে লিপ্ত। ভয়াবহ অবস্থা, কেউ সাহস করে থামাতে যাচ্ছেন না। স্যার একটি বেত হাতে নিয়ে সংঘর্ষের মধ্যখানে হাজির হয়ে ছাত্রদেরকে ধাওয়া করলেন। মুহুর্তের মধ্যে ছাত্ররা মাথা নিচু করে দৌড়াতে শুরু করলো। আর এরই মধ্য দিয়ে হবিগঞ্জবাসী রক্ষা পেল একটি অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা থেকে।
টি আলী স্যার সত্যিই সৎ সাহসী ও মেধাশীল ব্যক্তি ছিলেন। যার কারণে তিনি এক সাথে দীর্ঘ ৩১ বছর একই স্থানে চাকুরী করতে পেরেছেন। এই শিক্ষকের প্রতি ছিল সকলের অকৃত্রিম ভালোবাসা। আর এই ভালোবাসার প্রতি আকৃষ্ঠ হয়ে তিনি তাঁর পরিবার পরিজনকে অনেকটা ভুলে গিয়েছিলেন। সন্তানদের জন্মগ্রহণ কিংবা মৃত সন্তানের জানাজার সংবাদও সঠিক সময়ে নিতে পারেননি। শিক্ষকতা জীবনে তাঁর ছয় সন্তান মৃত্যু বরণ করেন। তখন তিনি হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি হলের সুপারের দায়িত্ব পালন করতেন। বাড়ী থেকে প্রতিবারই খবর পৌছাতো প্রিয় সন্তানদের পৃথিবীর আলো ছেড়ে পরপারে চলে যাওয়ার কথা। জানানো হতো জানাজার সময়গুলো। কিন্তুু সন্তানের চেয়ে হলে থাকা সন্তানদের দায়িত্ব তাঁর কাছে ছিল অনেক বড়। তাই নিজের ঔরসজাত সন্তানের জানাজায় অংশ না নিয়ে হলের সন্তানদের দায়িত্ব পালন করেছেন সফল ভাবে। এ নিয়ে গুণী এই শিক্ষকের পরিবারে আক্ষেপ থাকলে স্যারের মধ্যে এর রেশ মাত্র কিছু ছিল না।
১৯৭৮ সালে টি আলী স্যার তাঁর কর্ম জীবণ শেষ করে চলে আসেন পৈতৃক নিবাস বিয়ানীবাজারে। জলঢুপ পাড়িয়াবহরে পরিবার পরিজন নিয়ে শুরু করেন বসবাস। এলাকায় শিক্ষা বিস্তারে কাজ করেন নিরলস ভাবে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি হবিগঞ্জ তাঁর পুরনো কর্মস্থলের কথা ভুলতেন না। হবিগঞ্জের সাথে তাঁর আত্মার সম্পর্ক তাই তিনি প্রতিনিয়ত ছাত্রদের খোঁজ খবর নিতেন।
২০০১ ইং সালের ২৮ ডিসেম্বর এই গুনী শিক্ষক ইহকালের মায়া ত্যাগ করে পরকালে পাড়ি জমান। আর এই শিক্ষকের মৃত্যুই শিক্ষকের প্রতি হবিগঞ্জবাসীর ভালোবাসা আরো বাড়িয়ে দেয়। প্রতি বছর তাঁর মৃত্যু বার্ষিকী পালন থেকে শুরু করে হবিগঞ্জসহ দেশ বিদেশে বসবাসরত তার ছাত্র আর শুভাকাঙ্খিরা নানা কর্মসূচী পালন করে আসছেন। ছাত্র ও শুভাকাঙ্খিদের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষকের পরিবারের পক্ষ থেকেও গুণী শিক্ষকদের সম্মাননা প্রদান করে আসছেন।
টি আলী স্যারকে এতোটুকু স্মরণ করেই যেন কিসে কমতি রয়ে গেছে মনে করতেন হবিগঞ্জবাসী। তাই তাকে আজীবন বুকে লালন করতে তারা স্থায়ী কিছু একটা করার চিন্তা মাথায় নেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেন স্যারের নামে হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের কাছের ক্রস রোডটির নাম ‘টি আলী স্যার সড়ক’ নামে নাম করণের। যেমন সিদ্ধান্ত তেমনই কাজ। বাস্তবায়ন কমিটি বর্তমান সরকারের সংসদ সদস্য এডভোকেট আবু জাহির এর সহায়তা চান। তিনিও কৃতজ্ঞচিত্তে এই শিক্ষকের নামে সড়কটির নাম করণের পক্ষে মত দেন। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সম্প্রতি হবিগঞ্জবাসীর দাবী বাস্তবায়নে সরকার মত দিয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের ক্রস সড়কটির নাম পরিবর্তন করে ‘টি আলী স্যার’ সড়ক নাম করণের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং তা বাস্তবায়নে হবিগঞ্জ পৌরসভাকে পত্র প্রেরণ করে।
আজ শুক্রবার হবিগঞ্জ শহরে তৎকালীন ছাত্রদের প্রিয় সিলেটি স্যারের নামে ‘টি আলী স্যার’ সড়কের উদ্বোধন করবেন স্থানীয় সংসদ সদস্য এডভোকেট আবু জাহির এম.পি। আর এই সড়কটি’র নামকরণের মধ্য দিয়ে হবিগঞ্জবাসী একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রতি তাদের ভালোবাসার জানান দিয়েছেন।
সকল শিক্ষকগণ টি আলী স্যারের মতো সততা নিষ্ঠা ও আদর্শবান হয়ে শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে স্থান করে স্বীয় পেশার মর্যাদাকে উচ্চ আসনে স্থান করতে যেন পিছপা না হন সেই প্রত্যাশা রইল।