ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে জাপানের দোদুল্যমানতা নতুন নয়। একদিকে মিয়ানমারের সম্পদ আর প্রভাবের আকর্ষণ, অন্যদিকে মানবতার যে বার্তা জাপান শুনিয়ে আসছে—এই দুইয়ের মধ্যে অগ্রাধিকার নির্ধারণে লাভ–ক্ষতির হিসাবে মিয়ানমারের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়ছে জাপান। এর পেছনে আছে অর্থনীতি আর রাজনীতির সূক্ষ্ম কিছু হিসাব। অর্থনৈতিক দিক থেকে বলা যায়, মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়ণ শুরু হওয়ার আগে থেকেই সেই দেশটিতে জাপানের বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ শুরু হয়, তা আরও বেশি ত্বরান্বিত হয়েছে নির্বাচনে জয়ী অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির সরকার গঠনের পর। দীর্ঘকাল কারারুদ্ধ থাকা এই জননেত্রীর বিজয় বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষের মনে স্বস্তি এনে দিয়েছিল এবং সবাই মনে করেছিলেন নিজের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা তাঁকে হয়তো আরও বেশি মানবিক করে তুলবে এবং অন্যের কষ্ট তিনি সহজেই অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন।
তবে রোহিঙ্গা সমস্যা মনে হয় বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে যে রাজনীতিবিদদের প্রতি কখনোই খুব বেশি আস্থা রাখতে নেই। এঁদের সবাই নেলসন ম্যান্ডেলা হয়ে উঠতে পারেন না। কেবল হাতে গোনা কয়েকজনই পারেন এবং যাঁরা পারেন রাজনীতিবিদের চাইতে সন্তসুলভ গুণাবলি তাঁদের মধ্যে থাকে অনেক বেশি। অং সান সু চি সেই মাপকাঠিতে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছেন। কিন্তু তারপরও জাপান তাঁর সঙ্গ ছাড়েনি, সে প্রমাণ দেখা গেছে মিয়ানমারের নেত্রীর সাম্প্রতিক টোকিও সফরকালে।
রাজনৈতিক হিসাবের দিক থেকে বলা যায়, চীনকে সামাল দেওয়ার বাসনা জাপানের নেতৃত্বের সামনে সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেশি প্রবল হয়ে ওঠে। জাপান হয়তো ভেবেছিল মিয়ানমারের বাড়াবাড়িতে চুপ করে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু রোহিঙ্গা শরণার্থী-সংকট জাপানকে কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলেছিল। কেননা মানবিক এই সংকটের সামনে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকলে জাপানের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকেই তা কলঙ্কিত করে তুলতে পারে। ফলে রোহিঙ্গা সংকটে জাপানকে একটু হলেও নড়েচড়ে বসতে দেখা গেছে। তবে সমস্যা সমাধান করার জন্য মিয়ানমারের প্রতি অনুরোধ জানানোর বাইরে জাপান বেশি কিছু করেনি।
গত কয়েক দশকে মিয়ানমারে চীনের প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় জাপান কিছুটা দুশ্চিন্তায় পড়ে। সম্ভবত সে কারণেই মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর চীনের প্রভাববলয় থেকে দেশটিকে বের করে আনার বাসনায় জাপানের ব্যাপক আর্থিক সহায়তা ও বিনিয়োগ মিয়ানমারের দিকে ধাবিত হতে দেখা গেছে। ২০১৭ সালে মিয়ানমারে জাপানি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৪৮ কোটি মার্কিন ডলার।
গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য মিয়ানমারের নতুন সরকারের বিরুদ্ধে পশ্চিমের দেশগুলোতে জোর সমালোচনার হাওয়া বইতে থাকলেও এই বিষয়গুলো নিয়ে জাপান প্রায় নিশ্চুপ থেকে গেছে। তবে এখন মনে হয় সেই নীরবতা ভেঙে বেরিয়ে এসে রোহিঙ্গাদের পাশে নয়, বরং আরও শক্তভাবে মিয়ানমারের পাশে জাপানের দাঁড়িয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত আমরা পাচ্ছি। মিয়ানমারে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূতের সেই দেশের একটি দৈনিক পত্রিকাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকার হয়তো সে কথাই বলছে।
সম্প্রতি মিয়ানমারের দৈনিক ইরাবতীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রদূত ইচিরো মারুইয়ামা বলেন, কিছু কিছু দেশ যে রোহিঙ্গা সমস্যার সূত্র ধরে মিয়ানমারের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাঁয়তারা করছে, জাপান তার সম্পূর্ণ বিরোধী। জাপান মনে করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে সংকটের সমাধান হবে না, বরং মিয়ানমারের জনসাধারণের জীবনে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।
আমাদের অবাক হয়ে ভাবতে হয়, বাংলাদেশে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে যে অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে কাটাতে হচ্ছে, রাষ্ট্রদূত সেটাকে হিসাবের মধ্যে রাখছেন কি না। তাঁর বক্তব্য বলছে সে রকম কোনো হিসাবে যেতে তিনি নারাজ। কেননা একই সঙ্গে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাবকে বালখিল্য আখ্যায়িত করে তিনি বলেছেন যে নিষেধাজ্ঞা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মিয়ানমারকে অস্থিতিশীল করে তুললে এর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশটির শ্রমিকশ্রেণি। এই বক্তব্যেও জায়গা নেই হতভাগ্য রোহিঙ্গাদের। রাষ্ট্রদূতের মন উতলা হচ্ছে মিয়ানমারের শ্রমিকদের সম্ভাব্য দুর্দশার কথা ভেবে। ফলে নিষেধাজ্ঞার ঘোরতর বিরোধিতা তিনি করছেন।
এবার দেখা যাক মিয়ানমারের নেতাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটানোর অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে এঁদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবি নিয়ে কী ভাবছেন মিয়ানমারে জাপানের রাষ্ট্রদূত। উল্লেখ্য, জাতিসংঘের একটি তথ্যানুসন্ধানী মিশন ‘গণহত্যার উদ্দেশ্য’ নিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনে জড়িত হওয়ার অভিযোগে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রধান ও তাঁর অধস্তনদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সোপর্দের সুপারিশ করেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ আদালতের বিচারকাজে ব্যবহার করা যেতে পারে এমন সাক্ষ্য–প্রমাণ প্রস্তুতের কাজ করার জন্য একটি কার্যালয় গঠনের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। ফলে মিয়ানমারের নেতৃত্ব কোণঠাসা হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছে; মিয়ানমার সরকার ঘোষণা করেছে যে তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের এখতিয়ার মেনে নিতে বাধ্য নয়।
এ বিষয়ে মিয়ানমারে জাপানের রাষ্ট্রদূত মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের আহ্বানে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি মনে করেন, বিচার করা হলে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের প্রয়াস ভেস্তে যাবে। তাই তিনি চাইছেন সমস্যার তড়িঘড়ি সমাধানের পথে না গিয়ে স্থায়ী একটি সমাধান খুঁজে পাওয়ার জন্য সব পক্ষ যেন সময় নিয়ে কাজ করে।
জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠন যেন মিয়ানমার সরকারের অবস্থান বুঝতে সক্ষম হয়, সে জন্য সেই সব প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করা জাপান অব্যাহত রাখবে, কেননা জাপান মনে করে কেবল সেই পথে ধরে এগিয়ে গেলেই সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে।
মিয়ানমারে জাপানের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য থেকে বুঝে ওঠা কঠিন কথাগুলো অন্য একটি দেশের প্রতিনিধির মুখ থেকে আসছে, নাকি মিয়ানমার সরকারের বক্তব্য সেটা। কেননা সংকটের সমাধান খুঁজে পাওয়ার পথে না গিয়ে কালক্ষেপণের পথ ধরে এক বছরের বেশি সময় ধরে অং সান সু চিসহ মিয়ানমারের সামরিক ও বেসামরিক নেতারা এত দিন ধরে যা বলে আসছেন, জাপানের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের সঙ্গে তার কোনো অমিল নেই।