ওয়াজ মেহফিল ; কোন পথে ধাবিত হচ্ছে?

।। ইমরান আহমেদ চৌধুরী ।। কেন জানি বারবার মনে পরছে আমার প্রিয়  বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই কবিতার পংতিগুলো অবচেতনমনে

দুর্গম গিরি কান্তারমরু দুস্তর পারাবার

লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার!

দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভূলিতেছে মাঝি পথ,

ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?

কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যত।

তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার!!

শাশ্বত কাল যাবত বাংলার জনগণ এর একমাত্র আনন্দউপাদান হল রাত ভর উজাগরি করে দল বেঁধে গান, জারি, পুঁথি, যাত্রা, নাটক, সিনেমা, পূজা, কীর্তন,  কিংবা ধর্মীও জাতিওসমাবেশে  যাওয়া সেই মুঘল আমলেরও আগে থেকেই এইধরনের বিনোদন গ্রামের জনগণের সারা দিনের অকালন্ত পরিশ্রমের পর এই গুলোই ছিল বাঙ্গালির প্রধান আকর্ষণ । গ্রাম, গঞ্জ , বন্দর এবং মফঃস্বল শহর গুলোতে আজ থেকে কয়েক দশক আগে ছিল একটি অন্যরকম পরিবেশ এবং বিনোদন ছিল সার্বজনীন শিক্ষা এবং সংস্কৃতি ছিল একেবারে ভিন্ন ; গ্রাম গুল ছিল গুচ্ছ এবং বাস করত সকল ধর্মের সদস্যরা পাসাপাসি এক জনের বাড়ি ঘেঁষে আরেক ধর্মেরবাড়িগুলো সন্নিবেশিত ছিল ; যেন কোন শিল্পীর রং তুলি দিয়ে আঁকা কোন তৈল চিত্রের মত। গ্রাম গুলোর পাস দিয়ে বয়ে যেত ছোট্ট একটা নদী আর এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় যেতে হতো কোষা নৌকা বেয়ে বর্ষা কালে কি অপূর্ব ছিল সেই ধর্মনিরিপেক্ষ বসবাস

আমি নিজে ২৪ টি জায়গায় বসবাস করেছি বাংলাদেশে পিতা এবং মাতার চাকরির কারণে মেট্রিক পাস করার জন্য সর্বমোট ১৪ টি স্কুলে পড়তে হয়েছে। তাই বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সম্পর্কে আমার নিজের ধারনা আছে বিশাল ঐ অভিজ্ঞতার আলোকেই বলতে চাই আজ কি সুন্দর ছিল আমাদের সেই দিন গুলো  শিশু থেকে শৈশব পার হয়ে বেড়ে উঠলাম যুবকে সকালে হজরত শাহজালালের মাজারের মক্তবে ধর্ম শিক্ষাসারাদিন স্কুলে কাটিয়েছি আলম ( শিয়ামুসলিম ) অলক( ব্যাপ্টিস্ট খ্রিস্টান ), ফারুকি ( আহম্মদীমুসল্মান ) এবং প্রদীপের ( কায়েস্তহিন্দু ) এবং অন্যান্য মুসলিম বন্ধুদের সাথে বিকালে পুলিস লাইন মাঠে ফুটবল খেলতাম বিজু ভাই ( মণিপুরি ব্রাহ্মণ ), জুম্মন লুসাই ( বুদ্ধউপজাতি ) ছুটির দিনে সারা শহর সাইকেল চষে বেড়াতাম সম্পূর্ণ সিলেট শহর আমি  আমার প্রিয় বন্ধু রাজা দত্ত এটা তো কেবল তুলে ধরলাম সিলেটের দিনগুলো বাকী শহরগুলো নিয়ে লিখতে গেলে কয়েক শত পৃষ্ঠা তেও কুলাবে কি না জানিনা

যেমন আনন্দ করতাম ওদের সবাই কি নিয়ে আমাদের ঈদেসবাই বন্ধুরা মিলে চুটিয়ে আড্ডা মারতাম আমাদের বাসার সামনের বাগানে আর বাসার বাবুর্চি দারু মিয়া সেবন করতো মুখরোচক খাদ্য একের পর এক আইটেম  ঠিক তেমনি বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে যেয়ে অপেক্ষা করতাম রত যাত্রা দেখার জন্য সিলেটের অতি ও প্রশিদ্ধ বর্ষাকালে ; তারপর দুর্গা পূজার সময় চৌহাট্টতে সপরিবারে চলে যেতাম পূজা মণ্ডপে ইস্টার কিংবা বড়দিনে যেতাম নয়াসড়কের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের পারিবারিক বন্ধুদের বাড়িতে লুকিয়ে চলে  যেতাম বিজু ভাইদের ব্লু বার্ড স্কুল সংলগ্ন বাড়িতে রথ যাত্রার প্রসাদ খাবার জন্য মাসিমা কাকা আমাদের মন ভরে আপ্পায়ন করতেন  

তিন তিনটি বছর পড়েছি হযরত শাহজালাল মাজার সংলগ্ন  মক্তবে তৎকালীন প্রিন্সিপাল এবং অন্যান্য সকল মিয়াসাবদের কাঁছে পরিচিত ছিলাম একজন ভালো ছাত্র হিসেবে মক্তবের নিকট আজীবন কৃতজ্ঞ আমি আমার ধর্মীয় আচার আচরণআকিদা শিক্ষা দেওয়ার জন্য  দরগার ওরসের সময় পাড়ার সব ছেলেরা রাত অব্ধি কাটিয়ে দিতাম দরগা চত্বরে সেই চার দশক পর সব স্মৃতিগুলোর কথা লেখতে যেয়ে চোখ গুলো ছলছল হয়ে যাচ্ছে বারবার

কিন্তু, আজ কেন জানি আমি  একটু শঙ্কিত –  একটু ভাবান্বিত –  বাংলাদেশের গজে উঠা ভুঁইফোড় নব্য মৌলানাদের আদিখ্যেতা দেখে বাংলাদেশে উদ্ভাসিত হয়েছে এক নতুনধর্মীও প্রচারক দলের এরা কারা? কি চায় এরা কি এদের পরিচয়? এদের এই সব অপপ্রচার না কি দিন দিন দেশের আবাল বৃদ্ধ দের কে করে তুলছে অস্থির?  এরা  কি নেমেছে মাঠে এক ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে? এই সব নব্য প্রচারক দল দিনের পর দিন চালিয়ে যাচ্ছে অপপ্রচার করে যাচ্ছে ধর্মের নামে হিংসা উদ্রেকের উপাদান বাড়িয়ে দিচ্ছে অন্য সব ধর্ম এর অনুসারীদের প্রতি অসুহিষ্ণুতা  বদলে দিচ্ছে বাংলার ধর্মপ্রাণদের লালিত অনাদিকালের ধর্মীয় আচারআচরণ অনুমোদন ব্যতিত এদের এই সব বক্তৃতা বদলে দিচ্ছে দেশের দেশের ধর্মীয় ভূদৃশ্য সেই ১২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রচারিত সূফী ইসলাম আজ কি তাহলে অপ্রচলি?  নাকি এটা আরও কোন ধরনের কৌশল যা দিয়ে এরা করতে যাচ্ছে অন্যকোন ধরনের  নতুন বীজ বপন?

মিথ্যা উপমা দিয়ে মতিভ্রষ্ট করছে হাজার হাজার নিষ্পাপ ও সরল মানুষদেরকে ! ধর্ম এর মোড়কে সাজিয়ে কি এরা করছেঅন্য কোন কোনও কিছুর প্রচার ? লক্ষ লক্ষ নিরীহ, নিষ্পাপ, সরল মতি মানুষদের কি এরা  রুপান্তারিত করতে চাচ্ছেমৌলবাদের দীক্ষায় দীক্ষিত ?

নিরদ্ধিধায় করে যাচ্ছে যৌন সুড়সুড়ি দেওয়া বক্তব্য, সস্তাকৌতুক এর মাধ্যমে দিচ্ছে বিনোদন কিন্তু একবারো কেউ কিছুই বলছে না যে কর্ম দিবসের সময় সারা রাত কিংবা অধিকাংশরাতের প্রহর না ঘুমিয়ে এই  সব স্রোতারা নষ্ট করছে দেশের উৎপাদন এর ধারা দেশের এই উন্নয়নের মহা সড়কের যাত্রীদের কি এরা ধর্মীও প্রচারণার নামে সরিয়ে আনতে চাচ্ছে  সেইমধ্য আয়ের স্বপ্ন দেখা বা স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ থেকে ?

আবার কোন কোন প্রচারক খুব চতুরতার সাথে তাদের দর্শক স্রোতা দের নিকট উন্মোচন করছে সব ধর্ম ব্যবসায়ী রাজনৈতিক দলের তথাকথিত ধর্ম প্রচারকদের নাম যারা কোনোদিনই চায়নি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যারা নিক্ষেপিত হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুরে কারা এই সব নব্য ধর্ম প্রচারক? কোথায় নিতে চায় এরা দেশকে এবং দেশের ভক্তিমূলকজনগোষ্ঠীকে?

একজন সচেতন সমাজ কর্মী, একজন স্বাধীনতা যুদ্ধের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধারঅনুজ এবং নিজে একজন বালক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জাতির কাছে জানতে চাইওয়াজ মেহফিল ; কোন পথে ধাবিত হচ্ছে?

ইমরান আহমেদ চৌধুরী : লেখক এবং কলামিস্ট

Advertisement