॥ ওয়াহিদ মুহাম্মাদ মাহবুব ॥
কোরোনাভাইরাসের প্রভাবে বিস্তীর্ণ আকাশ আজ ক্লেদ্ মুক্তসুবিস্তৃত আর শান্ত। বাতাস নির্মল, পরিবেশ হয়েছে দূষণমুক্ত, দিগন্ত জুড়ে মাঠ–ঘাট হয়েছে নয়নাভিরাম, এ যেন কোলাহলমুক্ত এক নান্দনিক পরিবেশ। মুহূর্তেই মন কেড়ে নেয়ার মতো চারধার। তেমনি এই একই কারনে গোটা পৃথিবী আজ স্তব্ধ, এক দেশ থেকে অন্য দেশের যোগাযোগ, ব্যবসা–বাণিজ্য, সামাজিক, রাজনৈতিকসহ কূটনৈতিক সম্পর্কও বন্ধ হয়ে গেছে, ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশই মরনব্যধি কোভিড–১৯ এ ভুগছে, মৃত্যুর হার যেমনি বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে অর্থনৈতিক হতাশা। এর নেতিবাচক প্রভাব ক্রমান্বয়ই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে বিশ্ববাসির সামনে।
ইতিমধ্যে US Stock Market এর প্রভাব পরিলক্ষিত, যা তাদের বিগত বৎসরগুলর ফেব্রুয়ারি মাসের লাভের তুলনায় ২০% এর কম। বিশ্বব্যাপী তেলের দাম পড়ে গেছে, খেলাধুলার ইভেন্টগুলো বন্ধ হয়েছে, জাপান অলিম্পিকবন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, দেশী–বিদেশী সব ধরনের ব্যবসায়ীক ছোট বড় সর্বজনীন ইভেন্টগুলি বাতিল করা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ইতিহাস থেকে এটিও জানি যে ১৩৪০ সালের ব্ল্যাক ডেথ, পরবর্তীতে ১৯৩০ সালের মহামন্দার প্রভাব দু–এক বছরের মধ্যে কিন্তু কাটেনি। সবাই এক মত যে কোথায়, কিভাবে এবং কখন কোভিড–১৯র প্রভাব শেষ হবে তা এই মুহূর্তেই বলা মুশকিল। তারপরেও বিশ্ব নেতৃত্ব, আন্তর্জাতিক সংস্থা, প্রথিতজশা সাংবাদিক, লেখক, কলামিস্ট, রাইটার, analysts, forecaster, predictors এবং experts এর কিছু কথা বিভিন্ন মহলে ইতিমধ্যে চাউর হয়েছে।
সর্বপ্রথম যে বিষয়টি সামনে চলে এসেছে তা হল Global Growth। আমরা সবাই জানি দুনিয়া চলে তেলের উপরভর করে। যার কাছে তেল যত বেশী মজুদ আছে, তার দাপট বেশী। এজন্য পশ্চিমা বিশ্ব তেলের উপর করায়ত্ত ও আধিপত্য বজায় রাখার জন্য নানান ফন্দি ফিকির করতে সবসময় ব্যতিব্যস্ত । কোভিড –১৯র কারনে ইতিমধ্যে তেলের দাম পড়ে গেছে, যা কিনা ওয়ার্ল্ড জিডিপিতে দারুনভাবে প্রভাব ফেলবে। পাশাপাশি একচেটিয়া বাণিজ্য ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও বেড়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে, গোটাবিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছে বিশ্ব মোড়লরা কিভাবে মুনাফা অর্জন ও বিশ্ব বাজার ধরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমেরিকা দাবি করেছে আমরাই প্রথম যারা কোভিড–১৯র টিকা আবিষ্কার ও বাজারজাত করতে সক্ষম।অন্যদিকে চীনতো আরও একধাপ এগিয়ে, তারা বলছে, এইবছরের শেষের দিকে টীকা বাজারজাত করতে পারবে।যুক্তরাজ্যও কিন্তু বসে নেই। তারাও ইতিমধ্যে টীকার প্রাথমিক পরীক্ষা কার্যক্রম শেষ করেছে। এই ক্ষেত্রে যারাই প্রথম টীকা আবিষ্কার ও বাজারজাত করতে পারবে, তারা কিন্তু বাজারকে একচেটিয়া শাসন ও শোষণ করে বৈদেশিকমুদ্রা অর্জন করবে। আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন Forbse এরমতে, এক্ষেত্রে মার্কিনীরাই কিছুটা বেশী লাভবান হবে, তাদের Global Growth হতে পারে ৬% যেখানে চায়নাদের হতে পারে ৪%।এই অবস্থা দেখে মনে পড়ে মার্কিন লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক Noam Chomsky এর Who Rules the World বইতে উল্লেখিত Economic Elite Domination Theory এর কথা। এ থেকে বলা যায় যাদের অর্থবৃত্ত, কূটবুদ্ধি ও ক্ষমতা আছে তারই কেবল লাভবান হবেন। পোস্ট কোভিড–১৯ এর ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হবে না বলেই মনে হচ্ছে।
কোভিড–১৯র কারনে বিশ্ব ভ্রমণ, Travel & Tourism, Airlines business মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তা আবার পুনরায় চালু হবে কিন্তু মাঝখান থেকে বলির পাঠা হবে ভ্রমণ পিপাসু মানুষজন। গবেষণা বলছে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে কয়েক গুনে।
Leftwing politics বা বিরোধী রাজনীতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত দেশগুলোর বিরোধীদলসমুহ কোভিড–১৯ মোকাবেলায় সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে রাজনীতিতে আন্দোলন সংগ্রাম করে মাঠ গরম করতে পারেন। তবে বিশেষজ্ঞ মতে, পশ্চিমা বিশ্বের চেয়ে তৃতীয়বিশ্ব, বিশেষ করে যেখানে গণতন্ত্র ভঙ্গুর; সেখানে এই চিত্র বেশি পরিলক্ষিত হতে পারে।
বেকারত্ব, কর্মহীনতা, migration হতে পারে চোখে পড়ার মতো। উন্নত দেশে হতে পারে moving to smaller towns and countryside settlements offering cheaper property and higher quality life এর জন্য, আর অনুন্নত দেশে ও নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে হতে পারে বিদেশ ফেরত কর্মী বাহিনী ও শ্রমিকদের ফেরত আসার মাধ্যমে।তৃতীয় বিশ্বের দেশ সমুহে কোভিড–১৯ ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বাধাগ্রস্থ হতে পারে ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশী ভয়াবহতার সাথে। ইতিমধ্যে আমাদের নজরে এসেছে কি পরিমাণ লোক চাকুরিচ্যুত হয়ে মধ্য এশিয়ার দেশ কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ওমান থেকে remittance যোদ্ধারা দেশে ফিরে গেছেন বা যাওয়ার জন্য প্রহর গুনছেন। তখনকার বাস্তবতা হবে ব্যাপক বেকারত্ব ও কর্মহীনতা। অন্যান্য দেশ থেকেও লাখ লাখ প্রবাসী চাকরিহারা হয়ে দেশে ফিরে আসবেন। বেসরকারীখাতের অনেক ব্যবসা ও শিল্পোদ্যোগ এর মধ্যে রুগ্ন হয়ে প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার পথে। কৃষক ও খামারিদের উৎপাদন ঘাটতির ক্ষতির জন্য আর্থিক সহায়তা না পেলে সেগুলোকে আর সচল করতে পারবে না। গরিব দেশ ও গরিব মানুষের জন্য কোভিড–১৯ মহামারী হবে এক মহাসঙ্কট যা থেকে পরিত্রাণ পেতে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
করোনাভাইরাসের কারণে মানুষ আজ ঘরে বসেই কাজ করতে অভ্যস্ত হচ্ছে। করোনা পরবর্তী সময়ে ন্যাশনাল, মালটি ন্যাশনাল কোম্পানিগুলো তাদের cost minimizeএর জন্য তাদের কর্মী বাহিনীকে তাদের বাসা থেকেই কাজকরতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে যাকে বলা হয় “Declining Cost of Distance”. Macro Trends Group, New Yorkএর ডিরেক্টর Karen Harris বলেছেন – more companies are establishing system that enable staffs to work from home, and more workers are getting accustomed to it. These are habits that are likely to persist.
করোনা মহামারীর কারণে ডাকা লকডাউনে চলতি বছরে আয় তলানিতে ঠেকেছে জার্মানির ক্রীড়াপোশাক বিক্রয় প্রতিষ্ঠান এ্যাডিডাসের। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে আয় কমেছে ৯০ শতাংশ। বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে অন্তত ৪০ শতাংশ পতন হবে বলে এক ভবিষ্যদ্বাণীতে জানিয়েছে এ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ retail company যেমন M&S, John Lewis, সহ আরো অনেক কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের ২৪.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্ডার বাতিল করেছে। ব্রিটিশ লেবার এমপি রূশানারা আলী ইতিমধ্যে তার উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, মানুষ করোনার জন্য যত না মারা যাবে, তার চেয়ে বেশী মারা যাবে ক্ষুধার কারনে।
বিশেষজ্ঞগণের ভাষ্য মতে করোনা পরবর্তী সময়ে বিশ্বে নির্মাণশিল্প মুখ থুবড়ে পড়বে। ব্যক্তিগত সক্ষমতা হ্রাসের কারণে বাজারের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে যাবে, রেমিট্যান্স আয়ে ধস নামবে, স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বাড়বে। সামগ্রিকভাবে সমাজের তথা জনগণের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কমে যাবে।আইএমএফ এখনো আশাবাদী থাকলেও ২০২০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হওয়ার ধারণা সঠিক হবে বলে মনে হয় না। পাশাপাশি বৃহৎ ঋণ দাতা সংস্থা যেমন IDB, ADM, IMF উচ্চ সুদে দরিদ্র, নিম্ন ও নিম্নমধ্য আয়ের দেশগুলোকে ঋণ দিয়ে অধিক মুনাফা অর্জন বা অর্থ আয়ের চেষ্টা করবে। আর যদি ওই সমস্ত দেশগুলো ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সংস্থাগুলো তাদের নিম্নমানের পণ্য তাদের কাছে রপ্তানি করে তাদের সে কাঙ্ক্ষিত অর্থ উপার্জন করবে।
বিশ্বব্যাপী মন্দার কারণে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তহবিল অথবা চীন বা জাপানের সহায়তা কোনোটাই আগের মাত্রায় থাকবে না। ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিয়েছে তারা WHO কে আর সহায়তা করবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন ঘোষনায় চটেছেন বয়োবৃদ্ধ রাজনৈতিক বিশ্লেষক Noam Chomsky। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন …The World Health Organization works all over the world, mostly in poorer countries, on mothers’ health, diarrhoea deaths and so on. তিনি ট্রাম্প প্রশাসনকে আরো এক হাত নিয়েছেন এ বলে যে, ডিসেম্বর মাসে কোভিড–১৯ এর জন্ম হলো অথচ তারা কোনো কার্যকরী পদক্ষেপই নেয়নি, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে হয়তো ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমানো যেত, এজন্য তিনি এটাকে it’s another colossal failure of the neoliberal version of capitalism, massive failure বলে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে, জাতিসংঘ মহাসচিব Antonio Guterres, করোনাভাইরাসকে “the biggest challenge since World War II” দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে ঘোষণা করেছেন।
রয়টার্স দ্বারা পরিচালিত ৫০টিরও বেশি অর্থনীতিবিদদের এক জরিপে দেখা যায় ২০২০ সালে বিশ্ব অর্থনীতি ৬% সঙ্কুচিত হবে। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে যে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি ৩% হ্রাস পাবে এবং এর প্রভাব হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী। তারা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে ২০২২ সালের আগে উন্নত, অনুন্নত, উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন আয়ের কোন দেশই কোভিড–১৯ পূর্বের অবস্থায় যেতে পারবে না বা এর চেয়ে বেশী সময়ও লাগতে পারে। সব দেশই এই global rescission মধ্যে পরবে। গ্রেট ডিপ্রেশনের পড়ে সবচেয়ে বড় ধাক্কা হবে করোনাভাইরাসের আঘাত। কেউ কেউ একে global pain আখ্যায়িত করেছেন।
অন্যদিকে আইএনজি রিসার্চ–এর ম্যাক্রোর গ্লোবাল প্রধান কার্স্টেন ব্রজেস্কি কোভিড–১৯ পরবর্তী অর্থনীতিকে “a virus-driven ice age” বা ভাইরাসচালিত বরফ যুগ বলে অভিহিত করেছেন। এরই মধ্যে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম অনেকগুলো প্রভাবের মধ্যে শিশুশ্রম বৃদ্ধি পাওয়া নিয়ে আশংকা প্রকাশ করেছেন, তারা সতর্কও করেছেন যে কোভিড–১৯ এর কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় এক দিকে শিশুরা যেমন পড়াশুনা থেকে দূরে সরে যাবে তেমনি পুনরায় পড়ালেখায় ফিরতে অনেক শিশু নাও চাইতে পারে।ফলশ্রুতিতে বিরাট সংখক শিশু স্কুল ড্রপ-আউট হতে পারে যা পরবর্তীতে শিশুশ্রমের দিকে ধাবিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে হতাশাজনক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি প্রায়শই শিশুশ্রমের দিকে পরিচালিত করে। তবে বাচ্চাদের কাজে লাগানো চরম দারিদ্র্যের সমাধান নয়।আসলে, গবেষণা প্রমান করে যে শিশুশ্রম দারিদ্র্যতাকে স্থায়ী করে। অনেক শিশু যারা কাজ করে তাদের পড়াশোনা বাদ দিয়ে দেয় এবং বড় হয়ে অন্য প্রাপ্ত বয়স্কদের মতো ভাল বেতনের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা আরও কমে যায়। World Day Against Child Labour আমাদের প্রতি বৎসর শিশু শ্রমের ভয়াবহতা মনে করিয়ে দেয়। তবে উন্নত বিশ্বেএর সম্ভাবনা কিছুটা কম হবে বলে মনে হয়।
লকডাউনের কারণে যে সমস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছিল তা পুনরায় সচল হতে বেশ বেগ পেতে হবে বলে অর্থনীতিবিদগণ মনে করছেন। যার লক্ষন দেখা যাচ্ছে চায়নাতে। চীন হলো বিশ্বের বৃহত্তম পণ্য রফতানিকারক দেশ, যে কিনা বিশ্বব্যাপী উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশ তৈরি করে। চীন লক ডাউন তুলে নিয়ে পুনরায় ব্যবসা–বাণিজ্যে মনোযোগ দিলেও তাদের উৎপাদন, বিক্রয় এবং বিনিয়োগ ইতিমধ্যে অন্যান্য বছরের এই সময়কার তুলনায় অনেকাংশে কমে গেছে।
সংক্ষেপে Oxford University অর্থনৈতিক বিশ্লেষকগন কোভিড–১৯ এর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রভাবকে প্রত্যক্ষ খরচ এবং পরোক্ষ খরচ দুই ভাগে ভাগ করেছেন। প্রত্যক্ষ খরচের মধ্যে রয়েছে হাসপাতালে ভর্তি বাবদ ব্যয়, চিকিত্সা ব্যয়, রোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যয় এবং স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের বেতনব্যয়ের পাশাপাশি ওষুধ, চিকিৎসা, পরীক্ষা–নিরীক্ষা, এবং যোগাযোগের ব্যয় অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও ভ্যাকসিন, দ্রুত ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা এবং অ্যান্টিবডি পরীক্ষার ব্যয়, এবং ভ্যাকসিন গবেষণা ও বিকাশের ব্যয়ও অন্তর্ভুক্ত ।
অপ্রত্যক্ষ ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে অসুস্থ হওয়া বা সংক্রামিত হওয়া এড়ানোর জন্য গৃহিত সমস্ত পদক্ষেপ যা অতিরিক্ত ব্যয় করতে বাধ্য করছে এবং এটি অর্থনৈতিক প্রভাবের সাথেও যুক্ত। যেমন শ্রমিকদের কর্মহীনতা এবং মৃত্যুহারের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার ক্ষতি, সরকার বা প্রতিষ্ঠানদ্বারা কর্ম বিরতির ক্ষতি, বেতনের ক্ষতি এবং সুযোগ–ব্যয়ের ক্ষতি যার প্রভাব সরবরাহ এবং চাহিদা উভয়কে প্রভাবিত করেছে বিশেষ করে ব্যবসা বন্ধ হওয়া, হোটেল–রেস্তোঁরা এবং অন্যান্য ব্যবসাকে বন্ধ করা, যার দৃশ্যমান প্রভাব পড়েছে ভ্রমণ, পরিবহন এবং অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় ব্যয় তথা বিনোদন সংক্রান্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উপর। কোভিড–১৯ মহামারী প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব দেশীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে তারা মনে করছেন।
তবে কিছুটা আশার বানী শুনিয়ে ইম্পেরিয়াল কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর অধ্যাপক ডেভিড মাইলস বলেছেন, মহামারী দ্বারা সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটকে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ বেড়ে যায়। এর ফলে সরকারি দায়বদ্ধতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, ঠিক যেমনটি নেপোলিয়োনিক যুদ্ধ, প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে অনেক দেশেরই বেড়েছিল। তবে এই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার পরে জাতীয় আয়ের এই দায়বদ্ধতার সঙ্কটকে আমরা আবারও নিয়ন্ত্রনে আনতে পারবো যেমন ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে যুদ্ধের পরেও দেশগুলো করতে পেরেছিল।
আইএমএফ কোভিড–১৯ পরবর্তী অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য ৪টি দিক নির্দেশনা দিয়েছে। ১। স্বাস্থ্য সেবার উন্নতির জন্য স্বাস্থ্য খাতে আরও বেশী অর্থ বরাদ্দ, ২। শ্রমিক ও ব্যাবসায়ীদের আর্থিক সহায়তা, ৩। অব্যাহতভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং ৪।অবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য একটি সুস্পষ্ট রিকোভারি পরিকল্পনা গ্রহন করা।
কোনও কিছুর পূর্বাভাস শতভাগ অনুমানযোগ্য নয় সত্যি,কিন্তু এই কোভিড –১৯ পরবর্তী অবস্থা ভালভাবেই ইতিহাসের আলোকে অনুমান যোগ্য। আমাদের দুরদর্শিতা ব্যবহার করে, অভিজ্ঞদের দক্ষতার উপরনির্ভর করে এবং সতর্কতার সাথে পরিকল্পনা করে পরবর্তী প্রতিক্রিয়াগুলির জন্য প্রস্তুত হওয়া এখন সময়ের দাবি। তৈরি করতে হবে সম্ভাব্য সমাধান, প্রয়োজনীয় দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহন, অনুশীলন এবং সম্ভাব্য ক্ষতি প্রতিরোধে নিযুক্ত হতে হবে আমদের প্রত্যেককে। বিকল্প কিন্তু গনমানুষের জন্য কোন পথে কল্যাণ সেই উদার ধারা খুঁজে পেতে হবে।
যদিও মহামারী শেষ না হওয়া অবধি কোভিড–১৯ এর আসল অর্থনৈতিক প্রভাব পুরোপুরি মূল্যায়ন করা কঠিন কিন্তু অর্থনৈতিক ধ্বংস থেকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর সুরক্ষার জন্য, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য সাহসী কার্যকর নীতি গ্রহন, সরকারি প্রতিটি বিভাগের মধ্যে সমন্নয় সাধন পূর্বক সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহন এখনই প্রয়োজন। একই সাথে, দেশগুলির নিজেদের সুরক্ষায় ভবিষ্যতের নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য তাদের নিজেদের তদারকি ও পরিকল্পনা শক্তিশালীকরণকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন।
করোনাভাইরাস কোন গজব নয়, বরং এটি একটি পরীক্ষা, এই পরীক্ষায় সফলভাবে উন্নতির জন্য তাই আসুন ঘরে থাকার এই সময়টাকে আমরা পারিবারিক বন্ধন বাড়াতে কাজে লাগাই, সুস্থ থাকি, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাই, আমাদের দায়িত্তভুক্ত কাজগুলি আমরা ঠিকভাবে করি আর আমাদের দোষ-ত্রুটির জন্য পরিপূর্ণভাবে বারবার আল্লাহপাকের কাছে তওবা করতে থাকি যাতে করে তিনি আমাদেরকে কোভিড–১৯ এর পরবর্তী অর্থনৈতিক প্রভাবকে দ্রুত কাটিয়ে উঠতে সক্ষম করে তুলেন।
লেখক : ওয়াহিদ মুহাম্মাদ মাহবুব, সলিসিটর, ইংল্যান্ডঅ্যান্ড ওয়েলস।