:: ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী ::
করোনার মহামারীতে সারাবিশ্ব এক আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। তবে এই মহামারী একদিকে যেমন জনমনে আতংক তৈরী করেছে অন্যদিকে তেমনি মানুষকে কাছে থেকে জানার ও বুঝার সুযোগ তৈরী করেছে। করোনা ব্রিটেনে জন্ম দিয়েছে ক্যাপ্টেন ফার্স আর বাংলাদেশে জন্ম দিয়েছে ফকির নাজিম উদ্দিন। ক্যাপ্টেন টম মোর করোনা রোগীদের জন্য ১০০০ পাউন্ড উত্তোলন করতে গিয়ে তুলেছেন ২৭ মিলিয়ন পাউন্ড। মানুষের মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মানুষ দুই হাত উজাড় করে দিয়েছে। আর বাংলাদেশের ফকির এর চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে। ভিক্ষা করে সারাজীবনের সঞ্চিত ১০,০০০ টাকা সরকারি ফান্ডে জমা দিয়ে তৈরী করেছেন আরেক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। প্রমান করেছেন মানুষ মানুষের জন্য। আর ব্রিটেনে করোনা রোগীদের সেবার জন্য এনএইচএস সারাদেশে ২৫০,০০০ স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগের চিন্তা করে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলো আর উত্তরে সাড়া দিয়েছেন ৭৫০,০০০ স্বেচ্ছাসেবী। জনগণের এই অভুতপূর্ব সাড়া দেখে আবেগ আপ্লোত হয়ে পড়েছিলো খোদ এনএইচএস এর কর্তা ব্যক্তিরা।
ইদানিং বাংলাদেশে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে যোগাযোগ হয় খুব ঘন ঘন। টেলিফোনে আর ফেসবুক মেসেন্জারের বদৌলতে আমেরিকা, কানাডা, বাংলাদেশ আর মধ্যপ্রাচ্য সব বন্ধুদের সাথেই কথা হয়। আজ কথা হলো বাংলাদেশে বন্ধু আমিনুলের সাথে। আর প্রসঙ্গ ছিলো করোনা। জানতে চাইলাম করোনার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে। যা শুনলাম তা রীতিমত ভয়ঙ্কর। তার ভাষ্যমতে, লক ডাউনে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হলেও মানুষের জমায়েত বন্ধ হয়নি। প্রতিটি জায়গায় মাইকিং করে বলা হচ্ছে বাহির থেকে কেউ এলাকায় এলে জানানোর জন্য। রাস্তা বেরিকেড দিয়ে পাহারা বসানো হয়েছে। যাতে বাহির থেকে কেউ না আসতে পারে। ভাবলাম লক ডাউনের অর্থটা কি? লক ডাউনের মানে কি রাস্তায় বেরিকেড দিয়ে বাঁশ ফেলে করোনা ঠেকানো? আর এভাবে রাস্তায় বাঁশ ফেলে কি করোনা ভাইরাস মোকাবেলা সম্ভব?
কিছুদিন আগে আমি লিখেছিলাম বিয়ানীবাজারের করোনা আক্রান্ত আকবর হোসেনকে নিয়ে। ভদ্রলোক অসুস্থ হওয়ার পর যেভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার ছবি প্রকাশ, তাকে গালিগালাজ এবং ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে তা কোন সভ্য সমাজে পরে না। এমনকি বিয়ানীবাজারের কর্তা ব্যক্তিরা ও গ্রূপ নিয়ে ছবি তুলেছেন আতংকিত মানুষটির সাথে। ছবিগুলো দেখে মনে হয়েছিল কোন এক ভয়ানক এবং দুর্ধর্ষ অপরাধীকে তারা শেষ পর্যন্ত ধরতে পেরেছিলেন! আর তার গুরুতর অপরাধ ছিলো লকডাউন ভেঙে বাহিরে যাওয়া। কেউ একবার জিজ্ঞেস করলোনা কেন এবং কি প্রয়োজনে তিনি সেই লকডাউন ভঙ্গ করে সেদিন টাঙ্গাইল গিয়েছিলেন। তার চোখের দিকে তাকিয়ে সেদিন মনে হলো করোনার চাইতে বেশি ভয় পেয়েছে করোনা খুজা মানুষগুলোকে।
আমার মনে হয় লকডাউন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে একটি নেতিবাচক ধারণা হয়েছে। ব্রিটেনে লোক ডাউন বলতে যা বুঝানো হয়েছে – জরুরি ট্রাভেল করা যাবে, ঘরের জরুরি কেনাকাটা করা যাবে, দিনে একবার শারীরিক চর্চার জন্য বাহিরে যাওয়া যাবে, কাজে যাওয়া যাবে যদি না ঘরে বসে কাজ না করা যায়। লকডাউন এবং কার্ফ্যুর মধ্যে একটি পার্থক্য রয়েছে। লকডাউন বলতে যাতায়াত বন্দ বুঝায় না বরং জমায়েত বন্দকে বুঝায়। যাতায়াত বন্দ করে যদি জমায়েত চলে। তাহলে সামাজিক দূরত্ব কিভাবে রক্ষা করা হলো?
আর করোনায় কেউ আক্রান্ত হলে তাকে সামাজিক হেয় প্রতিপন্ন করা খুবই আপত্তিকর এবং অসুস্থ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। ব্রিটেনে করোনা সম্পর্কে বলা হয়েছে “যে কারো হতে পারে এবং যে কেউ ছড়াতে পারে”. আর করোনা রোগীদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানসিক শক্তি। আমরা যদি করোনায় আক্রান্তকে গুলি করে মারতে বলি কিংবা ক্রস ফায়ারে দিতে বলি তাহলে একবার চিন্তা করে দেখুন এই আক্রান্ত ব্যক্তির মানসিক অবস্থাটি কি হতে পারে। সখীপুরে মধ্যরাতে করোনা সন্দেহে মাকে জঙ্গলে ফেলে আসা সন্তান কিংবা হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত স্ত্রীর লাশ ফেলে যাওয়া স্বামীর কষ্টের কথা একবার ভেবে দেখুন। মৃত মানুষের লাশ করোনা ছড়াতে না পারলেও, করোনায় মৃত স্বজনের লাশ দাফনে গ্রামবাসীর দা কুড়াল নিয়ে রাস্তা অবরোধ নিঃসন্দেহে আমাদের জাহিলিয়াতের যুগের কথা মনে করিয়ে দেয়। সুতরাং এই বিষয়গুলি নিয়ে আমাদের ভাবা এখনই উপযুক্ত সময়।
ব্রিটেনে করোনার প্রাদুর্ভাব যখন শুরু হয় তখন আমরা কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব মিলে চিন্তা করলাম আমরা নিজেদের মধ্যে একটি ভলান্টারি নেটওয়ার্ক করবো যাতে আমরা আমাদের কমিউনিটির মানুষকে সাহায্য করতে পারি। ধীরে ধীরে আমাদের সংখ্যাও বাড়তে লাগলো বর্তমানে সারা ইউকেতে আমাদের সদস্য সংখ্যা ১৬ জন। “ভলান্টিয়ার ম্যাটার্” নামে এই সংগঠনে যারা রয়েছেন – লন্ডনে শিমু, দেলু, মোজাহিদ, ইমরান, সাব্বির এবং মিসবা, নিউক্যাসল আলম, কার্ডিফ কাইয়ুম খান, ওস্টারে নজরুল হক, ম্যানচেস্টারে গোলাম মোস্তফা, বার্মিংহামে মারুফ, ব্রমউইচ ফাজ, কেন্টে সিরাজ, ওল্ভারহ্যাম্পটনে মোহাম্মদ খান এবং এসেক্সে কামরুল। প্রতিদিনই আমাদের গ্রূপের সদস্যরা করোনা আক্রান্তদের সাহায্য করছেন। আমাদের কার্যক্রম মূলত করোনা আক্রান্ত ব্যাক্তি অথবা তার পরিবারের জরুরি খরচ করে দেয়া, ঔষধ সরবরাহ করা এবং কুশলাদি জানা। আমাদের মতো আরো অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আছে যারা আমাদের মতো সরকারের পাশাপাশি কাজ করছেন। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো করোনা আক্রান্তদের সেবা প্রদান। কারণ করোনা কোন অভিশাপ নয় এটি একটি রোগ এবং এই রোগে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারেন। এটি আসলে এক ধরণের ইতিবাচক ক্যাম্পেইন।
আজ বন্ধু আমিনুলের সাথে যখন কথা বলছিলাম তখন আমাদের সাথে ছিলো আমেরিকা থেকে উজ্জ্বল, কানাডা থেকে রিপন আর দুবাই থেকে জসিম। আমরা সবাই একমত যেভাবে আমরা করোনার ভয়ে করোনা আক্রান্তদের সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করছি তাতে যদি এই রোগ বিস্তার লাভ করে তাহলে আমাদের সামাজিক বন্ধন আর ধর্মীয় রীতি কিছুই বিদ্যমান থাকবে না। তাই এখনই প্রয়োজন করোনাকে নিয়ে একটি পজেটিভ ক্যাম্পেইন শুরু করার। আজ বন্ধু আমিনুলকে বলেছি করোনা আক্রান্তদের পাশে দাঁড়াতে এবং একটি ইতিবাচক ক্যাম্পেইন শুরু করতে। আর প্রবাস থেকে আমরা সেই ক্যাম্পাইনে সার্বিক সহযোগিতা করবো। সেই সাথে সবার প্রতি বিনীত অনুরোধ করোনা আক্রান্তদের নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য থেকে বিরত থাকুন। তাদের ছবি এবং ব্যাক্তিগত তথ্য প্রকাশ করে তাদের মানসিক কষ্টের মধ্যে ফেলবেন না। তাদের ঘৃণা নয় বরং তাদের পাশে দাঁড়ান এবং সাহায্যের হাত প্রসারিত করুন। কারণ করোনা কোন অভিশাপ নয় বরং একটি ব্যাধি। যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে এবং যেকেউ ছড়াতে পারে।
পরিশেষে সবাই ভালো থাকবেন এবং সুস্থ থাকবেন।
লেখক:
ব্যারিস্টার আবুল কালাম চৌধুরী
কন্ট্রিবিউটর, ব্রিট বাংলা২৪ এবং প্রিন্সিপাল সলিসিটার, কেসি সলিসিটর্স, লন্ডন।