ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: গত বছরের অক্টোবর মাসে ভোলা দ্বীপে একটি নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের পর বাংলাদেশ জাতীয় পেট্রোলিয়াম অনুসন্ধানী কোম্পানি বাপেক্স এ বছরের অক্টোবর মাসে কুমিল্লা জেলার কসবায় খননকৃত অনুসন্ধান কূপে পুনরায় গ্যাসের সন্ধান পেয়েছে। ১০ অক্টোবর সম্পাদিত ড্রিল স্টেম টেস্টের (ডিএসটি) মাধ্যমে একটি গ্যাসস্তর থেকে অনবরত ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিনব্যাপী গ্যাসের প্রবাহ ঘটিয়ে চূড়ান্তভাবে গ্যাসের অস্তিত্ব প্রমাণ করা হয়। এখানে দুটি গ্যাসস্তর শনাক্ত করা হয়, যেগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে যথাক্রমে প্রায় ২ হাজার ৪৬০ মিটার ও ২ হাজার ৫২৭ মিটার গভীরতায় অবস্থিত। এই গ্যাসস্তর দুটি তুলনামূলকভাবে অল্প পুরুত্বের। দুটি গ্যাসস্তর থেকেই পরীক্ষামূলক গ্যাসপ্রবাহ প্রমাণ করা হয়। তবে এই গ্যাসস্তর দুটি কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী এই অর্থে যে এখানে যে বেলেপাথরের স্তরে গ্যাস রয়েছে, তা অতি ঘন বা আঁটসাঁট প্রকৃতির, যাকে ভূতাত্ত্বিক ভাষায় ‘টাইট গ্যাস স্যান্ড’ নামে অভিহিত করা হয়।
এ ধরনের গ্যাসস্তর থেকে গ্যাসপ্রবাহ সহজভাবে হয় না, বরং স্তরটি ঘন বা আঁটসাঁট প্রকৃতির হওয়ার কারণে গ্যাসের সহজ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। তাই এ ধরনের গ্যাসস্তর থেকে বাণিজ্যিকভাবে গ্যাস উৎপাদনের জন্য স্তরটিতে হাইড্রোলিক ফ্র্যাকচারিং (সংক্ষেপে ফ্র্যাকিং) পদ্ধতির মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে ফাটল ঘটিয়ে গ্যাসপ্রবাহ বাধাহীন ও সহজতর করা হয়। ফ্র্যাকিং পদ্ধতিতে ওপর থেকে কূপের মাধ্যমে উচ্চ চাপে তরল পদার্থ গ্যাসস্তরে ঢোকানো হয়, যার ফলে গ্যাসস্তরে অসংখ্যÿ ক্ষুদ্র ফাটল সৃষ্টি হয় ও তা গ্যাসপ্রবাহ বাড়িয়ে দেয়।
বিশ্বের বহু দেশে ‘টাইট গ্যাস স্যান্ড’ থেকে হাইড্রোলিক ফ্র্যাকচারিং পদ্ধতির মাধ্যমে গ্যাস উৎপাদন চলমান রয়েছে। বাপেক্সের কাছে ফ্র্যাকচারিং করার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ বা যন্ত্রপাতি নেই। এ দেশে কর্মরত একাধিক বিদেশি পেট্রোলিয়াম সার্ভিস কোম্পানির কাছে এই ফ্র্যাকচারিং করার কারিগরি উপকরণ ও দক্ষতা রয়েছে। তবে বাংলাদেশের কোনো কূপে আজ পর্যন্ত এই পদ্ধতি অবলম্বন করে গ্যাস উৎপাদন করা হয়নি। বাপেক্স এই মুহূর্তে কসবা কূপে উৎপাদন শুরু করবে না বলে জানিয়েছে। বরং আরও নিবিড় পরীক্ষা চালানোর পর কোনো সার্ভিস কোম্পানির সহায়তায় ফ্র্যাকচারিং পদ্ধতি অবলম্বন করে উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হবে বলে জানিয়েছে বাপেক্স।
একটি রক্ষণশীল প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, কসবাকে একটি খুব ছোট গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে গণ্য করা যায়। দুটি গ্যাসস্তরের ওপরেরটি ২ হাজার ৪৬০ মিটার গভীরতায় অবস্থিত এবং তা প্রায় ১০ মিটার পুরু। এটিতে যে গ্যাসপ্রবাহ হয়েছে, তা প্রথম দিকে উচ্চ চাপে প্রবাহিত হলেও সময়ের সঙ্গে চাপ কমে যায় (২০০ পিএসআই) এবং তখন গ্যাসপ্রবাহও নগণ্য পর্যায়ে নেমে যায়। কিন্তু কূপ বন্ধ রাখলে চাপ (শাট ইন প্রেশার) আবার বৃদ্ধি পেয়ে ২৬০০ পিএসআই পর্যন্ত ওঠে, যা কিনা গ্যাসপ্রবাহের জন্য যথার্থ। গ্যাসস্তরের এহেন প্রকৃতি ‘টাইট গ্যাস স্যান্ড’–এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাই এটি থেকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য ফ্র্যাকচারিং পদ্ধতি আবশ্যক।
অপর গ্যাসস্তরটি আরও নিচে, প্রায় ২ হাজার ৫৩০ মিটার গভীরতায় এবং তা প্রায় ৮ মিটার পুরু। এটি যথেষ্ট চাপে গ্যাসপ্রবাহ ঘটায় এবং প্রতিদিন ৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসপ্রবাহে স্থিতিশীল থাকে। এই দুটি গ্যাসস্তর হাইড্রোলিক ফ্র্যাকচারিংয়ের মাধ্যমে উৎপাদনে নিলে বর্ধিত হারে গ্যাসপ্রবাহ ও উৎপাদন সম্ভব হবে এবং তা জাতীয় গ্যাস গ্রিডে যোগ দেওয়া যাবে বলে মনে করা হয়। অন্তত স্থানীয় গ্যাসের চাহিদা মেটাতে এটি সক্ষম হবে। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের বর্তমান নিজস্ব গ্যাসের চরম সংকট বিবেচনায় নিলে অল্প মজুত হলেও তা মূল্যবান বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয়।
উল্লেখ্য, কেবল কসবাতেই নয়, বাংলাদেশে খননকৃত অনেক কূপেই টাইট গ্যাস স্যান্ড শনাক্ত করা গেছে; যেমন বেগমগঞ্জ-৩, সুন্দলপুর-১, মুলাদী–১ ও ২, রশিদপুর–৯ ও ১৯, বাখরাবাদ-১০ এবং আরও বেশ কিছু কূপে। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই এসব টাইট গ্যাস স্যান্ডকে উৎপাদনে নিয়ে আসার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফ্র্যাকচারিং পদ্ধতি অবলম্বনে এগুলোকে উৎপাদনে নিয়ে এলে তা দেশীয় গ্যাস সরবরাহে উল্লেখযোগ্য জোগান দিতে পারত। বাংলাদেশ এযাবৎ তার গ্যাস অনুসন্ধানকে কেবল সহজ ও সনাতন প্রথানির্ভর করে রেখেছে। এ দেশে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে আধুনিকতর প্রযুক্তি ব্যবহারের অভাবের ফলে এখানে গ্যাস কার্যক্রম রয়ে গেছে অপরিপক্ব ও অনেকটা পশ্চাৎপদ। সহজ ও সনাতন পদ্ধতির বাইরে অপেক্ষাকৃত জটিল ও অধিকতর আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর অনুসন্ধান প্রক্রিয়া কাজে না লাগালে অনেক গ্যাসই মাটির নিচে রয়ে যাবে।
টাইট গ্যাস স্যান্ড ছাড়াও আরও অনেক অসনাতন গ্যাস সম্ভাবনাকে বাংলাদেশে অনুসন্ধান কার্যক্রমের আওতায় আনা হয় না, যেমন ‘থিন বেড প্রসপেক্ট’, ‘সিনক্লাইনাল প্রসপেক্ট’ ইত্যাদি। কোনো কোনো মহল বাংলাদেশে মাটির নিচে গ্যাস শেষ হয়ে গেছে বা যাচ্ছে—এ ধরনের একটি বিভ্রান্তি জনমনে সৃষ্টি করে বিকল্প হিসেবে অতি ব্যয়বহুল জ্বালানি আমদানি করার যৌক্তিকতা দেখানোর প্রয়াস পায়। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে বাংলাদেশের মাটির নিচে এখনো অনেক গ্যাস রয়েছে, যেগুলো নতুন আধুনিকতর প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শনাক্ত ও উত্তোলন করা যায়।
বাংলাদেশের কসবা শহরের গা ঘেঁষে খননকৃত কসবা কূপটি বৃহত্তর রোখিয়া নামক ভূতাত্ত্বিক কাঠামোর উত্তর প্রান্ত বরাবর অবস্থিত। এই ভূতাত্ত্বিক কাঠামো বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সালদা নদীসহ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বড় আকারে বিস্তৃত। ভারতীয় সীমানার মধ্যে এই কাঠামোতে অনেক কূপ খননের মাধ্যমে গ্যাস উৎপাদন করে চলেছে ভারতের জাতীয় কোম্পানি। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ সীমানার ভেতর সালদা নদী গ্যাসক্ষেত্রে মাত্র দুটি বা তিনটি কূপে সামান্য গ্যাস উত্তোলন করা হয়।
কসবা কূপ পয়েন্ট থেকে ভারতীয় সীমান্ত অল্প দূরত্বে বিদ্যমান এবং সীমান্তের ওপারে অল্প দূরত্বেই উৎপাদন কূপ লক্ষ করা যায়। ভূবিজ্ঞানীদের মতে, যখন একটি ভূতাত্ত্বিক কাঠামো দুটি দেশের সীমান্ত পেরিয়ে অবস্থান করে, তখন উভয় দেশেরই গ্যাসের ওপর অধিকার থেকে থাকে। অধিকতর কূপ খননের মাধ্যমে অধিকতর গ্যাস উৎপাদক দেশ এ ক্ষেত্রে লাভবান হয় বেশি, যেহেতু গ্যাসের অধিকতর প্রবাহ সেই দেশের দিকেই চলে যায় এবং এটি আইনসংগতও বটে, যতক্ষণ কূপগুলো খাড়াভাবে করা হয় এবং তা ভূগর্ভে বাঁকাভাবে (ডেভিয়েটেড কূপ) করে সীমান্তরেখা পার না হয়। সে হিসেবে রোখিয়া ভূতাত্ত্বিক কাঠামোটি থেকে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েই আইনসংগতভাবেই গ্যাস উত্তোলন করছে, যদিও অধিকতর গ্যাসকূপ খননকারী ভারত লাভবান হচ্ছে বেশি। বাংলাদেশ তার ভূখণ্ডে কূপের সংখ্যা বৃদ্ধি করে গ্যাসের সমীকরণটি তার নিজের দিকে নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন সে এলাকায় ব্যাপক আকারে কূপ খননের কর্মযজ্ঞ।
বিগত প্রায় এক দশকে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রশংসনীয়ভাবে এগিয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ ও শিল্পে দৃশ্যমান ও পরিকল্পিত অবকাঠামো দেশের শিল্পায়নের দৃশ্যপটকে দারুণভাবে পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এটির জন্য অত্যাবশ্যক উপাদান হলো, এই অবকাঠামো চলমান রাখতে সাশ্রয়ী জ্বালানি সরবরাহের নিশ্চয়তা। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে মূলত নিজস্ব সাশ্রয়ী গ্যাস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ ও শিল্প উন্নয়ন চালু রেখেছিল। কিন্তু নিজস্ব গ্যাসসম্পদ নিঃশেষ হওয়ার আশঙ্কা থেকে বর্তমানে উচ্চ মূল্যের এলএনজি জ্বালানি আমদানির মাধ্যমে জ্বালানি নিশ্চয়তার উপায় খুঁজছে বাংলাদেশ।
এক হিসাবমতে, বাংলাদেশ ২০৩০ সাল নাগাদ জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ৯২ শতাংশ আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভর হয়ে পড়তে পারে। ভূবিজ্ঞানীরা এ মত পোষণ করেন যে বাংলাদেশের মাটির নিচে (সমুদ্রবক্ষসহ) এখনো যথেষ্ট গ্যাস লুক্কায়িত আছে। পর্যাপ্ত ও জোরালো অনুসন্ধান ও আধুনিক প্রযুক্তির সর্বাত্মক প্রয়োগ দেশের গ্যাসসম্পদকে খুঁজে বের করতে পারে। তা না করে দেশের ভবিষ্যৎ জ্বালানি সরবরাহের পরিকল্পনা ও নীতিনির্ধারণ মূলত আমদানিনির্ভর করে তোলা সঠিক হবে না।