ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: কাশ্মীরের আকাশে ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধবিমানের সংঘর্ষ হয়েছে দুই বছর পার হয়েছে। আর বৃহস্পতিবার অকস্মাৎ দুই দেশের অস্ত্রবিরতি পুনঃকার্যকর হয়েছে। ইসলামাবাদ বা নয়াদিল্লি — কারও পক্ষ থেকেই এই বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। এই কারণে দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই চিরশত্রু ঠিক কোন প্রেক্ষাপটে দুই দেশের সীমান্তে (লাইন অব কন্ট্রোল বা এলওসি) সংঘাত থামাতে সম্মত হয়েছে, তা নিয়ে রহস্য দানা বাঁধছে। অথচ, গত কয়েক বছরে কয়েক হাজার বার এই এলওসি’তে দুই দেশের বাহিনীর মধ্যে গুলি বিনিময় হয়েছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুই দেশের বিমান বাহিনী একে-অপরের ওপর গোলাবর্ষণ করেছে।
ভারত ও চীনের মধ্যে লাদাখ অঞ্চলে মুখোমুখি সামরিক অবস্থানের অবসান ঘটাতে ১১ ফেব্রুয়ারি একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর ঠিক পরপরই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অস্ত্রবিরতি পুনঃস্থাপিত হয়েছে। এ কারণে ইঙ্গিত মিলছে যে, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের এই অস্ত্রবিরতি পুনঃকার্যকারের নেপথ্য কারিগর হয়তো চীন।
এলওসিতে অস্ত্রবিরতি পুনঃকার্যকরের সিদ্ধান্ত যেদিন এসেছে, ঠিক একই দিন ভারত ও চীনও দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী-দ্বয়ের মধ্যে হটলাইন স্থাপনের সিদ্ধান্তের কথা জানায়। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, “সময় মতো যোগাযোগ ও বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময়” নিশ্চিতে এই হটলাইন স্থাপন করেছে দুই দেশ।
বিশ্লেষকরা আরও মনে করেন, এই পুরো আয়োজনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নয়া প্রশাসন সক্রিয়ভাবে অংশ না নিলেও, অন্তত তাদেরকে অবগত করা হয়েছে। জো বাইডেন প্রশাসনও চায়, আফগানিস্তানে রাজনৈতিক সমাধানে সম্মত হতে নিজেদের তালিবান মিত্রদের রাজি করানোর কাজে আত্মনিয়োগ করুক পাকিস্তান। বাইডেনের পূর্বসুরি ডনাল্ড ট্রাম্পও তেমনটিই চেয়েছিলেন।
ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক প্রবীন স্বামী বলেন, “এই সমস্ত বিষয়াদি নিয়ে চার দেশ যদি আলোচনা না করতো, তাহলেই বরং আশ্চর্য্যের বিষয় ছিল। ট্রাম্পের সেই বহুল আলোচিত বিবৃতির পর থেকেই বিভিন্নভাবেই এই আলোচনা চলছিল।” তারপরও বিশ্লেষকরা বলছেন যে, দক্ষিণ এশিয়ার নয়া ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই এলওসিতে অস্ত্রবিরতি পুনঃকার্যকরের এই সিদ্ধান্ত নিতে সম্মত হয়েছে ভারত ও পাকিস্তান।
বিবদমান সীমান্ত থেকে ভারত ও চীনের সেনা প্রত্যাহার সত্ত্বেও বেইজিং-এর সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনা নিয়ে চিন্তিত ভারত। কেননা, চীন পাকিস্তানের চেয়েও বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিংকট্যাংক উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক জ্যেষ্ঠ অ্যাসোসিয়েট মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, “ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে বলা যায়, দেশটির জন্য ইসলামাবাদের সঙ্গে উত্তেজনা হ্রাস করে চীন ইস্যুতে বেশি নজর দেওয়াই বেশি সমীচীন।” তিনি আরও বলেন, “তার মানে কি দ্বিপক্ষীয় উদ্বেগের বদলে সম্পূর্ণ আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক ঘটনাবলীর কারণেই কেবল এই অস্ত্রবিরতি ঘটেছে? তেমনটাই হয়েছে, তা নয়। তবে সামগ্রিকভাবে এই অঞ্চলে যেই পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তার কারণেই উত্তেজনা নিরসনে উৎসাহিত হয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। এর ফলে অন্তত এখনকার জন্য হলেও আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা কিছুটা কমবে।”
সীমান্ত অঞ্চলে কর্মরত ভারতীয় ও পাকিস্তানি জেনারেলরা নিজ নিজ দেশের হয়ে বিবৃতি জারির মাধ্যমে এই অস্ত্রবিরতি কার্যকর করেছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে এক টুইটে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন।
২০০৩ সালে মূলত এই অস্ত্রবিরতি প্রথম রচিত হয়। দুই দেশ এটি পুনঃস্থাপন করেছে কেবল। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ইসলামাবাদের মূল ইস্যুগুলোও খোলাসা করেছেন। তিনি বলেন, “এই বিষয়ে আরও অগ্রগতি সাধনের অনুকূল পরিবেশ তৈরির দায় ভারতের। কাশ্মীরী জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি ও অধিকার পূরণে ভারতকে অবশ্যই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।”
অপরদিকে ভারতের জন্য মূল ইস্যু হলো পাকিস্তানি জঙ্গিদের হামলা। দেশটির দাবি, ইসলামাবাদের গোপন মদদে এসব জঙ্গিরা ভারতীয় সেনাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। দুই বছর আগে দুই দেশের বিমানবাহিনীর মধ্যে যেই লড়াই হয়েছিল, তা শুরু হয়েছিল মূলত পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলের বালাকোটে জইশ-ই-মোহাম্মদ নামে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ শিবিরে ভারতের প্রতিশোধমূলক হামলার মধ্য দিয়ে। নয়াদিল্লির দাবি, ওই জঙ্গিগোষ্ঠীই কাশ্মীরের একটি সামরিক বহরের উপর আত্মঘাতি হামলা চালায়, যাতে নিহত হয় ৪০ জন সেনা।
এরপর থেকেই সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে ভারত ও পাকিস্তানি সেনাদের সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করে। ভারত, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্লেষকরা একমত যে, এই যুদ্ধবিরতি পুনঃকার্যকর সম্ভব হয়েছে মোদির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের গোপন কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কারণে। তবে পাকিস্তানে তার সমমর্যাদার কর্মকর্তা মইদ ইউসুফ এই আলোচনায় ছিলেন না বলে জানান। তাই পাকিস্তানের পক্ষে কে এসব আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে এ নিয়ে সন্দেহ নেই যে, এতে সামরিক নেতৃবৃন্দের সায় ছিল। পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ইস্যুতে সামরিক বাহিনীর ভেটো দেওয়ার এখতিয়ার আছে পাকিস্তানে।
দুই দেশের উত্তেজনা হ্রাসের প্রথম লক্ষণ পাওয়া যায় ২রা ফেব্রুয়ারি দেওয়া পাক সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাবেদ বাজওয়ার এক বক্তৃতা থেকে। পাকিস্তানের এয়ার ফোর্স ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে দেওয়া এক ভাষণে তিনি বলেন, “সময় এসেছে সব দিকেই শান্তির হাত বাড়ানোর।” তিনি বলেন, “পাকিস্তান একটি শান্তিপ্রিয় দেশ। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শান্তির জন্য দেশটি অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতি আমরা দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।” ইসলামাবাদ ও দিল্লি ১৮ মাস যোগাযোগবিহীন অবস্থায় কাটানোর পর ওই বক্তব্য দেন তিনি। নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা ভারত বাতিল করার পর সম্পর্কে অবনতি ঘটে দুই দেশের। স্যামরনফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড কো-অপারেশনে পোস্টডক্টরাল ফেলো আসফান্দার মির বলেন, “এই অস্ত্রবিরতি চুক্তি দক্ষিণ এশিয়ায় একটি বড় ঘটনা। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক খুবই বৈরী, বিশেষ করে ২০১৯ সালের আগস্টের পর থেকে। ২০২০ সালে সীমান্ত সংঘাত ছিল বেশ তীব্র। এর ফলে উভয় দেশের সেনাবাহিনী ও জনগণের নিদারুণ ক্ষতি হয়েছে।”
তিনি বলেন, বেশ কিছুদিন ধরেই পাকিস্তান চাপে ছিল। সীমান্তে অস্ত্রবিরতি লঙ্ঘণ থামাতে চাচ্ছিল দেশটি। অপরদিকে ভারত কয়েক বছর ধরে সীমান্তে সহিংসতা কমাতে অত আগ্রহী ছিল না। মির বলেন, ভারতের নীতি ছিল উচ্চমাত্রায় ক্ষতি সাধন করে পাকিস্তানের নীতির পরিবর্তন ঘটানো। তিনি বলেন, “তাই আসল প্রশ্ন হলো, ভারত এখন এসে অস্ত্রবিরতিতে রাজি হলো কেন? এলওসিতে সংঘাত কমে এসেছে, আর পাকিস্তানও একটি বড় জিহাদি গ্রুপের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছে। অতএব, এমনটা সম্ভব যে, ভারত ভাবছে তাদের অর্জন কিছুটা পূরণ হয়েছে। তাই এখন তীব্রতা কিছুটা কমানো যায়।”