ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: কিছুদিন আগেও কথা বলার জন্য রাজনীতিকদের খুঁজে পাওয়া যেত না। ব্যস্ততার কারণে কথা বলার সময় হতো না তাঁদের। এখন রাজনীতিকেরা সাধারণ মানুষ তথা সংবাদকর্মীদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন। দেশ, রাজনীতি ও নির্বাচনের হালহকিকত সম্পর্কে জানতে চাইছেন। বিশেষ করে মধ্যম পর্যায়ের নেতারা ভীষণ উদ্বেগে আছেন মনোনয়ন পাওয়া, না পাওয়া নিয়ে। সরকারি ও বিরোধী দুই মহলেই নতুন করে জোট-ভোটের হিসাব শুরু হয়েছে।
মধ্য সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে মাঝেমধ্যে বৃষ্টি ঝরলেও রাজনীতির মাঠ ক্রমেই গরম হয়ে উঠছে, যা গণভবন থেকে নাজিমুদ্দিন রোডের জেলখানায় অবস্থিত অস্থায়ী আদালত পর্যন্ত প্রসারিত হচ্ছে। সরকার মুখে তরুণদের স্বার্থ ও অধিকারের কথা বললেও শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের ন্যায্য আন্দোলনকে শেষ পর্যন্ত অন্যায্য পথেই মোকাবিলা করল। সরকারের দাবি অনুযায়ী যদি অান্দোলনে ‘অনুপ্রবেশকারী’ ঢুকেও থাকে, তাতে শিক্ষার্থীদের কোনো দোষ ছিল না। সরকার তাদের ওপর কেন খড়্গহস্ত হলো?
অন্যদিকে পদ্মার ভাঙনে যে দালানকোঠা, ঘরবাড়িসহ শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল তলিয়ে গেল, তা নিয়েও আমাদের সরকার বা রাজনীতিকদের উদ্বেগ আছে বলে মনে হয় না। পানিসম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু একদিন উপদ্রুত এলাকা ঘুরে এসে ‘পানি কমলে নদীশাসনের কাজ শুরু হবে’ বলে বিপন্নজনকে যে আশ্বাসবাণী শুনিয়েছেন, তা অনেকটা পরিহাসের মতো শোনাচ্ছে। যেখানে সাত বছর ধরে এলাকাটি নদীর রোষে ভাঙছে, সেখানে কীভাবে সরকার নীরব দর্শক হয়ে থাকল? পানি উন্নয়ন বোর্ডের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) চার মাস আগেই পূর্বাভাস দিয়েছিল নড়িয়ায় ভাঙন দেখা দেবে। তারপরও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি বিরোধী দলের যে নেতারা ‘গণতন্ত্র উদ্ধারে’ সদা ব্যাকুল, তাঁরাও কষ্ট করে নড়িয়ার নদীভাঙা মানুষের পাশে দাঁড়াননি। গত সাত বছরে নড়িয়ার ১৩ বর্গকিলোমিটার পদ্মাগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
ভাঙন শুধু নদীতে নয়, রাজনীতিতেও নতুন ধরনের ভাঙন দেখা দিয়েছে। এক দলের নেতা যখন অন্য দলের নেতার বিরুদ্ধে কথা বলেন, তখন আমরা ধরে নিই এর পেছনে নীতি ও আদর্শের সংঘাত আছে। কিন্তু যখন নিজ দলের নেতা ও সাংসদের বিরুদ্ধে কেউ বিষোদ্গার করেন, তখন বুঝতে হবে ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। ’ গত কয়েক দিনে আওয়ামী লীগের অন্তত অর্ধডজন সাংসদের বিরুদ্ধে স্থানীয় নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে অনাস্থা প্রকাশ করেছেন। এমনকি তাঁরা সাংসদদের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি, মাদক ও সন্ত্রাস লালনের পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াতকে তোষণের গুরুতর অভিযোগ এনেছেন। যেখানে জামায়াতের প্রকাশ্য তৎপরতা নেই এবং বিএনপি নেতা-কর্মীরা দৌড়ের ওপর আছেন, সেখানে এই অভিযোগ কতটা সত্য? আওয়ামী লীগের যে নেতারা বিএনপির অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়া নিয়ে বিচলিত তাঁরা যদি দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটাতে সচেষ্ট হতেন, তাহলে হয়তো বিদ্রোহ ও অনাস্থার ঝড় কিছুটা কমত।
মনোনয়ন নিয়ে সমস্যা আছে বিএনপিতেও। ১২ বছর ধরে ক্ষমতার এবং পাঁচ বছর ধরে সংসদের বাইরে থাকার কারণে দলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কম থাকলেও সেখানেও মনোনয়ন নিয়ে মন-কষাকষি সংঘাতে পরিণত হতে সময় লাগবে না। এখন রাজনীতি মানে একটি নির্বাচনী আসন। যেকোনো মূল্যে সাংসদ হতে পারলে সৌভ্যগ্যের সিংহদুয়ার খুলে যাবে।
নির্বাচনের বাকি মাত্র তিন মাস। কিন্তু এ নিয়ে মানুষের মধ্যে সংশয়-সন্দেহ রয়েই গেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা ক্রমাগত বলে যাচ্ছেন, আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ করতে যা যা করণীয় সবই তাঁরা করবেন। কিন্তু বিগত পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন যেভাবে হলো এবং কমিশন যেভাবে ভোট কারচুপি ও দখলবাজির ঘটনা অস্বীকার করল, তাতে মানুষ তাদের প্রতি ভরসা রাখতে পারছে না। সিলেটে সুষ্ঠু ভোট হওয়ার কৃতিত্ব কমিশন দাবি করলে তাদের পাল্টা প্রশ্ন করতে হয়, বরিশালে বেলা ১১টার আগেই কীভাবে ভোটপর্ব ‘শেষ’ হলো? ভারতে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনেও টিএন সেশন ক্ষমতাসীনদের নাকানিচুবানি খাইয়ে দিয়েছিল। আর বাংলাদেশে সিটি নির্বাচনে এত বড় কেলেঙ্কারির পরও কে এম হুদারা রা করেননি। মনে হচ্ছে তাঁদের হাত-পা ‘অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে’ বঁাধা রয়েছে।
বরাবরের মতো বাংলাদেশের নির্বাচনটি আর বাংলাদেশের সীমানায় নেই। বিএনপির নেতারা ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের সন্ধানে’ জাতিসংঘ মহাসচিবের আমন্ত্রণে এখন নিউইয়র্কে। তাঁরা সহকারী মহাসচিব মিরোস্লাভ ইয়েনকার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিবের বিশেষ দূত ফার্নান্দেজ তারানকো ২০১৩ সালে ঢাকায় এসে দুই দলের সঙ্গে বৈঠক করেও সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন, পারেননি। শেষ পর্যন্ত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন হলো।
এর আগে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতারা ভারতে গিয়ে সেখানকার নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সংগোপনে আরও কেউ কেউ অন্য কোনো দেশে গিয়েছেন কি না, জানা যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের সেলফি তোলা নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে। আগের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা যেখানে বিদায়ী সাক্ষাতের সুযোগই পাননি, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বার্নিকাটের ঘন ঘন দেখা-সাক্ষাৎ হওয়া তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন কেউ কেউ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বরাবরের মতো এবারও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে আসছে। তবে ব্যতিক্রমী বিবৃতি এসেছে চীনের কাছ থেকে। যেই চীন কখনো অন্য দেশের রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় না, সেই চীনও বলেছে, বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হওয়া দরকার।
সম্প্রতি বিএনপির এক নেতার কাছে জানতে চেয়েছিলাম নির্বাচন হবে কি-যিনি একদা বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং পরে জিয়াউর রহমান ও এরশাদের মন্ত্রী ছিলেন, বললেন, সম্ভাবনা কম। তাঁর কাছে পরের প্রশ্ন ছিল, নির্বাচন হলে আপনারা অংশ নেবেন কি না। জবাব দিলেন, সম্ভাবনা কম। তখন বিএনপির ওই নেতাকে পাল্টা প্রশ্ন করি, কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দ্বিতীয় কোনো বিকল্প আছে কি? তিনি বললেন, না, কোনো বিকল্প নেই। তাহলে আপনারা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন না কেন? তাঁর উত্তর, আমরা তো প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছি। কিন্তু সরকারই নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করেছে। তবে তিনি এ-ও বললেন, আগামী মাসে অর্থাৎ অক্টোবরে সবকিছু পরিষ্কার হবে। কী পরিষ্কার হবে, সেই ব্যাখ্যা তিনি দেননি।
ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে অক্টোবর হবে টার্নিং পয়েন্ট বা মোড় ঘোরানোর ক্ষণ। অক্টোবরেই স্পষ্ট হবে সেই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কি নেবে না। নির্বাচন নিয়ে বিএনপিতে দুটি ধারা। এক ধারার নেতারা বলছেন, বর্তমান অবস্থায় নির্বাচন হলে ফলাফল আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকবে। গণরায়ের প্রতিফলন ঘটবে না। সেই ধরনের নির্বাচনে গিয়ে কোনো লাভ হবে না। বরং দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন জোরদার করতে হবে। অন্য ধারার নেতারা মনে করেন, সরকারের ওপর জনগণ ক্ষুব্ধ। তফসিল ঘোষণার পর পরিস্থিতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাবে। নির্বাচনে গেলে বিএনপি সেই সুযোগটি কাজে লাগাতে পারবে। মানুষও মাঠে নামবে। বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ড. কামাল হোসেনদের জোট গঠনকেও তাঁরা দেখছেন ইতিবাচকভাবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাষ্য অনুযায়ী, অক্টোবরের মাঝামাঝি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। সেই সরকারে কে থাকবে, কে থাকবে না তিনি তা পরিষ্কার না করলেও জানিয়ে দিয়েছেন, সেখানে টেকনোক্র্যাট কোটায় কেউ মন্ত্রী থাকবেন না। এর আগে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ অনেকে টেকনোক্র্যাট কোটায় বিএনপি থেকে কয়েকজন মন্ত্রী করার দাবি জানিয়ে বলেছিলেন, সেটি সমঝোতার একটি উপায় হতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, বিএনপি ২০১৪ সালে সমঝোতার ট্রেন মিস করেছে। এখন আর সেই সুযোগ নেই।
দেখা যাক, কী হয় অক্টোবরে।