সাঈম চৌধুরী: বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে বহন করার কারণে হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইটে ২৪ ঘণ্টা বিলম্বের কারণে কোর্টের রায়ে বাংলাদেশি এক পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়েছে বাংলাদেশ বিমান।
পাশাপাশি কোর্টের ব্যয়ও বহন করতে হয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষকে।
ক্ষতিপূরণের দাবিতে যথাসময়ে সাড়া না দেওয়ায় ইউকে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি মীমাংসার জন্য লিভারপুল কোর্টে প্রেরণ করে। সেখান থেকে প্রদত্ত রায়ের প্রেক্ষিতে গত ২৩ অক্টোবর ঐ পরিবারের নয় সদস্যের টিকেটের মূল্য ও মামলার খরচ বাবদ সর্বমোট ৪ হাজার ৬শ ১ পাউন্ডের চেক প্রদান করে বিমান।
ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের বিধান অনুযায়ী কোনো কারণে ফ্লাইটে তিন ঘণ্টা কিংবা তার চাইতে বেশি সময় বিলম্ব হলে যাত্রীরা ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারেন।
এই আইনে ক্ষতিপূরণ পাওয়া পরিবারটি বলছে, এখানে জরিমানার অর্থ নয়, তাদের কাছে বড় হচ্ছে সাধারণ যাত্রীদের সাথে বিমানের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে রায় পাওয়া।
অন্যদিকে বিমানের কান্ট্রি ম্যানেজার শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, কোর্টের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আমরা যথাসময়ে অর্থ প্রদান করেছি। এরকম ক্ষতিপূরণ অতীতেও দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটি নতুন কিছু নয়। আসল কথা হচ্ছে, শিডিউল বিড়ম্বনা বিমানের জন্য নতুন কিছু নয়। কেবল ঢাকা-লন্ডন রুটেই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইটপ্রতি গড় বিলম্ব ৪৫ মিনিটের বেশি। হিথ্রো বিমানবন্দরে কার্যক্রম পরিচালনাকারী এয়ারলাইনসগুলোর সময়ানুবর্তিতার ধারণা পাওয়া যায় ইউকে সিভিল এভিয়েশন অথরিটির (সিএএ) তথ্যে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, সময়ানুবর্তিতায় সবচেয়ে খারাপ এয়ারলাইনসগুলোর তালিকায় বিমানের অবস্থান তৃতীয়। বিমানের ফ্লাইট বিলম্বে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণার শিকার যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাঙালিরা। ঐতিহ্যগতভাবেই ব্রিটেনের বাঙালিরা বাংলাদেশ বিমানের যাত্রী হয়ে দেশে যাওয়া আসায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সেবা নিয়ে তাদের অনেক অভিযোগ থাকলেও যাত্রার সময় ঠিকই তারা টিকেট কাটেন বিমানের। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিমানযাত্রা তাদের জন্য সুখকর হয় না। ফ্লাইট বিলম্বের পাশাপাশি যাত্রী সেবার মানেও তারা অসন্তুষ্ঠ থাকেন। তবে এর প্রতিকার চেয়ে সরব হন খুব কমসংখ্যক মানুষ। সরব হওয়া এই মানুষদের তালিকায় রয়েছেন পূর্ব লন্ডনের বাসিন্দা শাহ সানোয়ার হোসেন। বিমানে করে বাংলাদেশ যাত্রায় তিনি যে যন্ত্রণার শিকার হয়েছিলেন তার বিরু দ্ধে লড়াই করেছেন টানা প্রায় পাঁচ বছর। তারপর পেয়েছেন ক্ষতিপূরণ।
বিমান কর্তৃপক্ষের চিঠি
এ বিষয়ে শাহ সানোয়ার হোসেন বলেন, ২০১২ সালে ২৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিমানের বিজি ০০৬ ফ্লাইটযোগে আমাদের পরিবারের বৃদ্ধা মা ও শিশুরাসহ ১০ সদস্য বাংলাদেশ যাবার কথা ছিলো। কিন্তু কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ঐদিন ফ্লাইটটি বাতিল করে দেয়। নির্ধারিত সময়ের ২৪ ঘণ্টা পরে ফ্লাইট হয়। এতে মারাত্ম ক ভোগান্তির মুখে পড়েন সারওয়ার হোসেনের পরিবারের সদস্যরা। যাত্রাপথে বিমানের স্টাফদের দ্বারাও মানসিক হয়রানির শিকার হন তারা। বাংলাদেশ থেকে ফিরে এসে এই বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে বিমান বরাবরে চিঠি দিলেও কোনো সাড়া পাননি সারওয়ার হোসেন।
পরবর্তীতে ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের বিধান অনুযায়ী, ফ্লাইট বিলম্বের ক্ষতিপূরণ চেয়ে ইউকে সিভিল এভিয়েশন অথোরটির কাছে অভিযোগ দায়ের করেন সারওয়ার হোসেন ও তার স্ত্রী। এ বিষয়ে সারওয়ার হোসেন জানান, সিভিল এভিয়েশন আমাদের ক্লেইমটি বিমান কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করলে বিমান তাতে কর্ণপাত করেনি। ফলে সিভিল এভিয়েশন আমাদের অভিযোগটি লিভারপুল আদালতে পাঠিয়ে দেয়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আদালত তাদের প্রদত্ত রায়ে শাহ সানোয়ার হোসেনওপরিবারের নয়জন যাত্রীকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আইন অনুযায়ী যাত্রীপ্রতি ৪৬৫.৬৯পাউন্ড ক্ষতিপূরণ ও ৪১০ পাউন্ড আদালতের খরচসহ মোট ৪৬০১.২১ পাউন্ড দিতে নির্দেশ দেয়।
বিমান প্রদত্ত চেক
রায় অনুযায়ী বিমান গত ২৩ অক্টোবর ক্ষতিপূরণের চেক প্রদান করে। অবশ্য মামলা চলাকালে বিমান কর্তৃপক্ষ অবশ্য কোর্টের বাইরে বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা করেছিলেন।
ঐ সময়ে বিমানের পক্ষ থেকেও পরিবারের নয়জন হোসেনের কাছে এক চিঠিতে লেখা হয়, বিমানের নির্দিষ্ট ঐ ফ্লাইটে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মরহুম জিল¬ুর রহমান যাত্রী হওয়ার কারণে সেটি ২৪ ঘণ্টা বিলম্বে ছাড়া হয়।এরজন্য কর্তৃপক্ষ সারওয়ার হোসেনের পরিবারের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে।
এদিকে সানোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, আমরা অর্থের লোভে এই এই ক্ষতিপূরণ দাবি করিনি। আমরা এটি করেছি, বিমানের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সাধারণ যাত্রী হিসেবে প্রতিকার পাবার আশায়। তিনি বলেন, ফ্লাইট বিলম্বে ক্ষতিপূরণ প্রদানের এই আইন সম্পর্কে সাধারণ যাত্রীদের অনেকেই অবগত নন। আর এই সুযোগটিই নেয় বিমান। তারা সাধারণ যাত্রীদের সাথে যা ইচ্ছা তাই ব্যবহার করে। ফ্লাইট বিলম্ব হলে সাধারণ দুঃখ প্রকাশও করে না তারা। তিনি বলেন, সেবার দেশে যাবার পর বিমানে করে ফেরার সময়েও আমাদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহতে হয়। আমরা এই মামলার মাধ্যমে চেয়েছি, সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলতে যাতে করে তারা বিমানের স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হলে অন্তত যেনো অভিযোগ করার সুযোগ পান। এদিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টি সম্পর্কে বিমানের কান্ট্রি ম্যানেজার শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা কোর্টের বাইরে বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা করেছি। সেটি হয়নি। শেষ পর্যন্ত রায় মেনেই ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়েছে। তিনি বলেন, এরকম ক্ষতিপূরণ প্রদানের ঘটনা নতুন কিছু নয়।