ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: মহান স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির ক্ষণ গণনা করছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনে রাষ্ট্রীয়ভাবে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোও নানা কর্মসূচি ইতিমধ্যে পালন করতে শুরু করেছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর হয়ে গেলেও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি, এমনকি দলীয়ভাবে দুঃখও প্রকাশ করেনি। অথচ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে দলটি! এ উপলক্ষ্যে বছরব্যাপী নানা কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে জামায়াত।
স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করতে ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ বহুদিন আন্দোলন করেছে। ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’সহ অনেক সংগঠন বহু বছর ধরে দাবি জানাচ্ছে। তবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন হয়নি, এখন পর্যন্ত কোনো মামলাও হয়নি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনজীবীদের মতে, যুদ্ধাপরাধের জন্য দলটির বিচার করতে আইন সংশোধন করতে হবে। আইন সংশোধনের সেই উদ্যোগেও অগ্রগতি কম। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে একটি আপিল এখনো বিচারাধীন।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) ২০১৮ সালে দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছে। আদালতের আদেশে ইসি জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করায় দলটি কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না, তবে দল হিসেবে এখনো সক্রিয় রয়েছে। ২০০৯ সালের এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে ইসির দেওয়া নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে। রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় লিভ টু আপিল ও আপিল করে দলটি। সাত বছরের বেশি সময় ধরে আপিল শুনানির অপেক্ষায় আছে।
জামায়াতকে নিষিদ্ধের বিষয়ে ২০১৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার জন্য আদালতে একটি মামলা রয়েছে। সেই মামলার রায় যতক্ষণ পর্যন্ত না হবে, ততক্ষণ আমরা কোনো কিছু করতে পারব না।’
প্রসঙ্গত, ১৯৪১ সালের ২৬ অগাস্ট জামায়াতে ইসলামীর সূচনা হয় উপমহাদেশের বিতর্কিত ধর্মীয় রাজনীতিক আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে। তখন এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ। পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর মুসলিম পারিবারিক আইনের বিরোধিতা করায় ১৯৬৪ সালে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলেও পরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন ১১ দফাসহ বিভিন্ন দাবির বিরোধিতা করে জামায়াত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি নামে বিভিন্ন দল গঠন করে জামায়াত এবং দলটির তখনকার ছাত্রসংগঠন ছিল ইসলামী ছাত্র সংঘ (বর্তমানে ইসলামী ছাত্র শিবির)। ১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের মতো ধর্মাশ্রয়ী দলগুলো নিষিদ্ধ হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আবারও রাজনীতিতে ফেরে জামায়াত। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে সর্বোচ্চ আদালতে এ পর্যন্ত জামায়াতের সাত শীর্ষ নেতার সাজা হয়েছে, তাদের মধ্যে পাঁচ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
জামায়াত নিষিদ্ধে আইন সংশোধনের অপেক্ষা
জামায়াতের বিরুদ্ধে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধসহ সাত ধরনের অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ এনে তদন্ত সংস্থা ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলির কার্যালয়ে প্রতিবেদন দেয়। এরপর প্রায় সাত বছর পার হলেও জামায়াতের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলার রায়ে আদালত জামায়াতে ইসলামীকে দল হিসেবে যুদ্ধাপরাধে জড়িত বলে উল্লেখ করেছে। দল হিসেবে জামায়াতের বিচার প্রক্রিয়ার জন্য ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী তৈরি করেছে। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হবে।’
একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করে আদালতের একটি রায়ে বলা হয়েছে, দেশের কোনো সংস্থার শীর্ষ পদে স্বাধীনতাবিরোধীদের থাকা উচিত নয়। আদালত একটি রায়ের সঙ্গে দেওয়া পর্যবেক্ষণে বলেছে, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সরকার চাইলে দল হিসেবে জামায়াতেরও বিচারের উদ্যোগ নিতে পারে। আদালতের সেই পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ব্যক্তির পাশাপাশি দল হিসেবে জামায়াতের যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আইনি কাঠামো তৈরির কাজ সরকার শুরু করলেও সেটির উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। এ ছাড়া জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে ২৫ জন বিশিষ্ট আলেমের করা একটি মামলা এখনো উচ্চ আদালতে বিচারাধীন।
জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে অনেক দিন ধরে দাবি জানাচ্ছেন বর্তমানে ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য এম এ আউয়াল। গতকাল মঙ্গলবার তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে আমরা জামায়াতমুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চাই। একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা না চেয়ে জামায়াত কীভাবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করে এবং দলটির আমির ওয়েবসাইটে বক্তব্য প্রকাশ করেন, তা প্রশাসনের খতিয়ে দেখা উচিত।’
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করছে জামায়াত!
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতও স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করছে। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান গত ১ মার্চ ‘জাতির উদ্দেশে’ বক্তব্যও প্রকাশ করেছেন। তার পুরো বক্তব্যটি জামায়াতের ওয়েবসাইটে আছে। ঐ বক্তব্যে শফিকুর রহমান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে বছরব্যাপী দলের গৃহীত ১০টি কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে—তৃণমূল পর্যায়ে মিছিল-র্যালি; ৫০ বছরের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি এবং দেশ গঠনে জামায়াতের ভূমিকা আলোচনা ও সেমিনারের মাধ্যমে জনগণের সামনে তুলে ধরা; স্মারক ও বুকলেট প্রকাশ; বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উপহার প্রদান এবং অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গৃহসংস্কার ও নির্মাণে সহযোগিতা করা; অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা, সন্তানদের শিক্ষা উপকরণ প্রদান, মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের সহায়তা, রোগীর সেবা, করোনায় মৃত্যুবরণকারীদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা, কন্যাদায়গ্রস্তদের বিয়ে ও আত্মকর্মসংস্থানে সহযোগিতা প্রদান; অসহায়, এতিম, পথশিশু ও দরিদ্রদের মধ্যে খাবার বিতরণ; ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ও রক্তদান কর্মসূচি; বছরব্যাপী রচনা, কিরাত, আজান, হাম্দ-নাত, দেশাত্মবোধক গান ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন; ছাত্র, যুবক, শ্রমিক ও সাংস্কৃতিক বিভাগের মাধ্যমে খেলাধুলা, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন এবং স্বাধীনতায় জীবনদানকারীদের জন্য ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হেফাজতের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করা।
বক্তব্যে যা বলেছেন শফিকুর রহমান
জামায়াতের ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখা যায়, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান তার বক্তব্যে ‘শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ’ করেছেন একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত দলের একসময়ের শীর্ষ নেতাদের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও আতাউল গনি ওসমানীকেও তিনি স্মরণ করেন। তিনি বলেছেন, ‘জামায়াতে ইসলামী দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে। জামায়াতের কর্মীরা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত।’ তিনি আরো বলেন, “বাংলাদেশ আমাদের সকলের। এদেশে যেসব সমস্যা বিরাজমান, সেগুলোর সমাধান সকলে মিলে করতে হবে। এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা আমাদের সকলের দায়িত্ব। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের শপথ হবে ‘বিভেদ নয় ঐক্যের’ মাধ্যমে দেশকে গড়ে তুলতে হবে। তাই ক্ষমতাসীনসহ সকল রাজনৈতিক দল ও মহলের প্রতি আমাদের আহ্বান—আসুন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে দেশের বৃহত্তর কল্যাণে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সুস্থ ও গঠনমূলক রাজনীতির চর্চা করি। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি ভুলে গিয়ে সর্বস্তরের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হই। সুখী-সমৃৃদ্ধিশালী ইনসাফপূর্ণ বাংলাদেশ গঠনে হাতে হাত ধরে এগিয়ে যাই।”
একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চায়নি জামায়াত
জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান ‘জাতির উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে’ একবারের জন্যও একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেননি। ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা, কোনো অনুশোচনাও নেই তার বক্তব্যে। যদিও একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার জন্য দেশের মানুষের কাছে ‘ক্ষমা না চাওয়ায়’ জামায়াতে ইসলামী থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পদত্যাগ করেছিলেন দলটির তত্কালীন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, যিনি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের আইনজীবী দলের নেতৃত্বে ছিলেন।
স্বাধীনতার ৫০ বছরেও জামায়াতের ক্ষমা না চাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমাদের দলের নেতারা বিভিন্ন সময়ে বক্তব্য দিয়েছেন। আমাদের দলের বর্তমান আমিরও জাতির উদ্দেশে বক্তব্য রেখেছেন। এর বাইরে এ ব্যাপারে এখন আর কিছু বলতে চাই না।’ একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা না চেয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা তো উদযাপন করছি, বিভিন্ন কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে।’