ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব এক ইতিহাসের নাম। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতে সুনাম কুড়িয়েছে ঐতিহ্যবাহী দলটি। অথচ এই ক্লাবটি এক যুগের অধিক সময় ধরে ফুটবল লীগে শিরোপাহীন। লীগে এখন রেলিগেশনে টিকতে লড়ে। ক্রিকেট হকিতেও সাফল্য নেই। আর্থিক অজুহাতে হ্যান্ডবল, দাবা লীগে অংশ নিচ্ছে না ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি। যারা খেলাধুলার জন্য সবার বাহবা পাচ্ছিল। এখন এমন তিন ঐতিহ্যবাহী ক্লাবই যেন লাইফ সাপোর্টে বেঁচে আছে। কর্মকর্তাদের একটাই কথা ফান্ডের কারণে এ দুর্দশা নেমে এসেছে। কেউ কেউ আবার একথা বিশ্বাসও করতেন। তা না হলে জনপ্রিয় হওয়ার পরও এসব ক্লাবের বেহালদশা হবে কেন? খেলার বদলে ক্লাবে অন্য খেলা হয় বলেই এমন করুণদশা নেমে এসেছে। দলের পেছনে অর্থ ব্যয় না করে কীভাবে অনৈতিক অবস্থায় কর্মকর্তারা নিজেদের পকেট ভারী করবে সে খেলাতেই মেতে ছিল।
স্পোর্টিং ক্লাবগুলোতে হাউজির প্রচলন বহু বছরের। ক্লাবের দৈনন্দিন খরচ মেটাতে এবং বিভিন্ন খেলায় অংশ নেয়া দলগুলো লালনপালনের খরচ জোগাতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে হাউজি করার অনুমতি নিয়ে আসার চলটাও বেশ পুরনো ক্লাবগুলোর। কিন্তু গত এক দশক হাউজির আড়ালে ক্লাবগুলোয় চলেছে অবৈধ জুয়া, মাদক ব্যবসা। আর অবক্ষয়ের সর্বশেষ সংযোজন ক্যাসিনো স্থাপন। সমপ্রতি ক্লাবপাড়ায় র্যাবের অভিযানে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। এক সময়ের ফুটবলার গড়ার কারখানাখ্যাত ইয়াংমেন্স ফকিরেরপুল ক্লাবে অবৈধ ক্যাসিনোতে অভিযান চালায় র্যাব। আটক করা হয় এই ক্লাবের সভাপতি এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা খালেদ মাহমুদ চৌধুরীকে। এই নেতা তার গডফাদারদের ছত্রছায়ায়, আরো কিছু স্থানীয় ও পাতিনেতার যোগসাজশে গত কয়েক বছর ধরে মতিঝিল, ফকিরেরপুর ক্লাবপাড়ার ৬টি স্পোর্টিং ক্লাবে চালিয়ে এসেছেন অবৈধ ক্যাসিনো। র্যাবের ওই অভিযানে ইয়াংমেন্স এবং ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব এবং গুলিস্তানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রে গড়ে ওঠা ক্যাসিনো সিলগালা করে দেয়া হয়। গতকাল
অভিযান চালানো হয় মোহামেডান, আরামবাগ, দিলকুশা ও ভিক্টোরিয়া ক্লাবে। অভিযানের কথা টের পেয়ে নিজ উদ্যোগে সেদিনই নিজেদের ক্লাবে গড়ে ওঠা ক্যাসিনো বন্ধ করে দেয় মোহামেডান, আরামবাগ, ভিক্টোরিয়া, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব। এখন সেসব ক্লাবের কর্তারাই গা বাঁচাতে দায় দিচ্ছেন রাজনৈতিক প্রভাবে এতদিন ক্যাসিনোগুলোর পরিচালকদের ওপর। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ক্লাবের জায়গা দখল করে নেয়ার কথাটা অসত্য নয়। তবে এজন্য ক্লাবগুলোও এ থেকে প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে মোটা অঙ্কের টাকাই পেত ভাড়া হিসেবে। প্রকাশ্য আয়টা যোগ হতো ক্লাবের কোষাগারে। আর অপ্রকাশ্যটা চালান হয়ে যেত ক্লাবের শীর্ষ কর্তাদের পকেটে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে ছটি ক্লাবের সঙ্গে ক্যাসিনো জড়িয়ে গেছে, এগুলোর কোনোটিই খেলার মাঠে এগিয়ে থাকাদের মধ্যে নেই। এর মধ্যে মোহামেডান ফুটবল ও ক্রিকেটের শীর্ষ লীগে খেললেও শিরোপা জেতার মতো দল হিসেবে এখন আর বিবেচিত হয় না। দৈনিক ভাড়া পাওয়ার পরও আর্থিক সংকটের দোহাই দিয়ে মোহামেডান এখন গড়ে মধ্যমসারির দল। ফুটবল পেশাদার যুগে পা রাখার পর একবারও লীগ শিরোপা জিততে পারেনি মোহামেডান। ক্রিকেটেও ভালো অবস্থায় নেই তারা। তার ওপর দীর্ঘদিন ধরে ক্লাবের নেতৃত্ব নিয়ে চলছে সংকট। অভিমানে অনেক প্রতিষ্ঠিত মোহামেডানের খেলোয়াড়, কর্মকর্তা এখন আর ক্লাবমুখী হন না। তার ওপর ক্লাবের প্রধান ফটকের পাশেই গড়ে ওঠা অডিটোরিয়ামে দিন-রাত ক্যাসিনো চলায় ক্লাবের পরিবেশও এখন আর ক্রীড়াবান্ধব নেই। ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়া অবশ্য এর দায় নিতে রাজি নন, ‘আমাদের জোরপূর্বক ক্যাসিনোকে ভাড়া দিতে বাধ্য করা হয়েছে। এই ক্যাসিনো কারা চালায় সেটা আমি জানি না। লোক মারফত আমাদের ভাড়ার টাকা দিয়ে যাওয়া হতো। এটা বন্ধে প্রশাসন দৃষ্টি দেয়ায় আমরা সত্যি খুশি। কারণ, ভাড়া হিসেবে দৈনিক যা আসত তা নিয়ে দৈনন্দিন খরচ মেটানো সম্ভব হতো না।’ লোকমানের ঠুকনো অজুহাত মানতে নারাজ সাবেক জাতীয় ফুটবলার বাদল রায়। মোহামেডানের সাবেক এই পরিচালক বলেন ‘একদম ফালতু কথা। রাজনৈতিক কোনো চাপ নয়, লোকমান সাহেবই মোহামেডানের বড় চাপ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই বলেছেন, ক্রীড়াঙ্গনের স্বার্থে মোহামেডানের উন্নয়নের কথা। তবু লোকমান সাহেব গুরুত্ব দেননি। অনেক আগেই মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও তিনি দায়িত্বে আছেন। তার কি উচিত ছিল না এজিএম ডেকে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা দেয়া। তাছাড়া লোকমান এখন রাজনৈতিক চাপের কথা বলছেন। যদি তাই হয় তাহলে তিনি বিসিবির পরিচালক হন কীভাবে? তা ছাড়া রাজনৈতিক চাপের কথা সদস্যদের তিনি জানাননি কেন?’ যে ক্লাবটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা, সেই ইয়াংমেন্স ক্লাব নিজেদের খেলাধুলা ফুটবলে সীমাবদ্ধ রেখেছে সব সময়। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লীগ থেকে প্রিমিয়ার লীগে নাম লিখিয়েছিল ক্লাবটি। কিন্তু অর্থের অভাবে দল গড়তে না পারায় তারা শীর্ষ লীগ থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। বর্তমানে ক্লাবটি দ্বিতীয় স্তরেই খেলছে। ইয়াংমেন্স ক্লাবের দীর্ঘদিনের সাধারণ সম্পাদক মনজুর হোসেন মালু নিজের কষ্ট লুকাতে পারেননি, ‘এই ক্লাবটা আমাদের বড় ভাইরা আমাদের বাড়িতে বসেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমি ১৯৭৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দু’বার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। যতদিন ছিলাম ততদিন ক্লাবে কোনো প্রকার অবৈধ কিছু হতে দেয়নি। একটা সময় এই ক্লাবটি পরিচিত ছিল ফুটবলার গড়ার কারখানা হিসেবে। অথচ ভাবতেই লজ্জা লাগে আমাদের প্রাণের ক্লাবে এতদিন এসব অবৈধ কাজ হয়েছে।’
গতকাল অভিযান চালানো চারটি ক্লাবের মধ্যে তিনটির সঙ্গেই সম্পৃক্ত ছিলেন মুমিনুল হক সাঈদ। এর মধ্যে আরামবাগ ও দিলকুশা ক্লাবের সভাপতি ছিলেন তিনি। আর মোহামেডানের কাউন্সিলর হয়ে হকি ফেডারেশনে নির্বাচন করেছেন মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক ও ৯নং ওয়ার্ডের এই কাউন্সিলর। এই সাঈদই নাকি দিলকুশা মোহামেডানের ক্যাসিনো চালিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন ক্লাব দুটির কর্মকর্তারা। ভিক্টোরিয়া ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম তুহিনও দায় এড়ানোর চেষ্টা করলেন। ক্যাসিনোর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা গোপন করার চেষ্টা করে তিনি বলেন, আসলে আমাদের কাছ থেকে জোর করে ভাড়া নিয়ে এখানে ক্যাসিনো বসানো হয়েছে। যদিও কিছুদিন আগে এই প্রতিবেদক ক্লাবে ঢুকতে চাইলে বাধা দিয়ে তুহিন বলেছিলেন ভেতরে গিয়ে কি করবেন ওইখানে জুয়া হচ্ছে। সাবেক তারকা ফুটবলার শেখ মো. আসলামের ক্যারিয়ারটা শুরু হয়েছিল ভিক্টোরিয়া থেকেই। তিনি বলেন, ‘এসব নামি-দামি ক্লাব কেন অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে পারলাম না। হাউজি চলে, কিন্তু ক্যাসিনো কোনোভাবেই মানা যায় না। আমি বলব শুধু রাজনৈতিক নেতা নয়, ক্লাব কর্মকর্তাদেরও রিমান্ডে নেয়া উচিত। এর সঙ্গে তারাও জড়িত।’ সাবেক ফুটবলার আবদুল গাফফার বলেন, এসব ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে একশ্রেণির লোভী সংগঠকের কারণে। আমি ভাগ্যবান যে, বঙ্গবন্ধু যে ক্লাবের অধিনায়ক ছিলেন সে ওয়ান্ডারার্সে আমিও খেলেছি। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় ওয়ান্ডারার্স, মোহামেডান, মুক্তিযোদ্ধা যেখানে ক্রীড়াঙ্গনে ভূমিকা রাখবে সেখানে অনৈতিক সব কাজ করে খেলাধুলায় বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। আমি চাই সরকারি উদ্যোগে এসব ক্লাবে ত্যাগী ও যোগ্য সংগঠকদের দায়িত্ব দেয়া হোক।
খেলার নামে ক্লাব গুলোতে যা চলতো
Advertisement