সারফুদ্দিন আহমেদ :: পদ্মা সেতুর কাজে এক হাজার কাটা মুণ্ডু লাগবে। বাচ্চাকাচ্চার মাথা হলে ভালো হয়। সাবালকের মাথা হলেও চলবে। জরুরি ভিত্তিতে এই সহস্র মুণ্ডু সংগ্রহ প্রকল্পের কাজ চলছে। মাথা সংগ্রাহকেরা নানান ছদ্মবেশে বাংলার অলিত–গলিতে ছড়িয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ এখন এই গুজবে রীতিমতো মুখরিত। ‘পোলাচোর’, ‘কল্লা কাটা’, ‘ছেলেধরা’—স্থানভেদে এই জোড়া শব্দগুলো এখন মানুষের মুখে মুখে। শব্দগুলো লোকে মুড়িমুড়কির মতো খাচ্ছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ঢাকার মোহাম্মদপুরে দুই যুবককে ছেলেধরা সন্দেহে ‘মহাসমারোহে’ পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। ফেনীতে মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবককে ‘কল্লা কাটা’ সন্দেহে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছে। কপাল জোরে তিনি বেঁচে গেছেন। চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে মানসিক ভারসাম্যহীন আরেক ব্যক্তিকে বেদম মারধর করেছে উচ্ছৃঙ্খল জনতা। পুলিশ না এসে পড়লে ওই লোকটাকেও বেঘোরে জান হারাতে হতো। অনেক জায়গায় ছেলেধরা আতঙ্কে স্কুলে যেতে ভয় পাচ্ছে শিশুরা। স্কুলে শিশুশিক্ষার্থীর উপস্থিতি কমে গেছে।
গত দুই তিন দিনে যে এই গুজব ছড়িয়েছে, তা নয়। গুজবের চারা লাগানো হয়েছিল বেশ কিছুদিন আগেই। ডালপালা মেলে এখন সে মহিরুহ।
গত রোজার ঈদে দেশের বাড়ি গিয়ে এই জিনিস প্রথম শুনেছি। তখনই মাতৃস্থানীয় এক আত্মীয়া বলেছিলেন, ‘পদ্দা বিরিজ নাকি মাথা চায়?’ আমি বললাম, ‘কার মাথা?’ উনি বললেন, ‘সে কি আর আমি জানি রে বাপু! আশপাশে সগ্গলে কচ্ছে বিরিজে মাথা নাগবে। বিরিজের নোক নাকি পোলাচোর দিয়ে পোলাপান ধইরে নিচ্ছে! আর কল্লা কাইটে পিলারের গোড়াতে ফেলতিছে!’ আমি ধমকে বলেছিলাম, ‘এই সব ফালতু আলাপ কই পাও? কাম–কাজ নাই? সব গুজব। মিথ্যা কথা। ডাহা মিথ্যা!’ তিনি বললেন, ‘তুই “মিথ্যা” কইয়ে দিলিই তো আর মানুষ শুনবিনানে! সবাই কচ্ছে পোলাচোর বাইর হইছে!’
বুঝতে পারছি কোন কথাটি সত্য আর কোনটি নয়, সেই বিচার এখন অবান্তর। কারণ, গোটা দেশটাই এখন সত্যোত্তর—‘পোস্ট ট্রুথ’। আজকের অবস্থা দেখলে ‘পোস্ট ট্রুথ’-এর মাহাত্ম্য বুঝতে কষ্ট হয় না। সত্য-মিথ্যার বিভেদহীন এই দেশের মাটি গোয়েবলসীয় গুজবের জন্য অতি উর্বর। এখানে কোনো গুজবকে ‘সত্য’ হয়ে উঠতে শুধু কিছু ফেসবুক পোস্টের হাজার কয়েক শেয়ারের প্রয়োজন হয়। কটাকট কিছু ছবি ফটোশপে মেরে দিয়ে কায়দামতো একটা ক্যাপশন লিখে ফেসবুকে আপলোড করে দিলেই হলো। এই ছবি–সংবলিত বয়ানগুলোই বাস্তব। ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যাহা তাহা সব সত্য নহে’—এই দার্শনিক ভিত্তির ওপর ভর করে ছবি আর বয়ান মিলিয়ে তৈরি হয় মেসেজ। ইনফো-হাইওয়েতে সেগুলো ছড়িয়ে পড়ে। গালভরা পোস্ট-ট্রুথের জামানায় এই বিভ্রমই হয়ে ওঠে বাস্তব। ‘তথ্যফথ্য’ নয়, ‘যুক্তিফুক্তি’ নয়, স্রেফ আবেগনির্ভর মেসেজ দিয়েই আধুনিকতার যুক্তি-তর্কের ইমারতকে টলিয়ে দেওয়া যাবে। কারণ, মানুষের আগ্রহ এখন যতটা না তথ্যে, তার চেয়ে বেশি ‘বিকল্প’ তথ্যে। নিউজ় নয়, ফেক নিউজ়ই এখন বেশি প্রভাবশালী।
ইন্টারনেট-পূর্ব সময়ে হুইসপারিং ক্যাম্পেইনের চল ছিল। ‘ওয়ার্ডস অব মাউথ’ বা মুখে মুখে ফিসফাস করে গুজব ছড়ানোর ধারা ছিল। তথ্যপ্রযুক্তি সেই ‘খাতে’ বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এখন কারেন্টের গতিতে ভুয়া খবর ভাইরাল হয়ে তা খবরের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। এটি সত্যি নাকি ভুয়া, তা যাচাই করার আগ্রহ বা সময় কোনোটাই বেশির ভাগ মানুষের নেই, শিক্ষাগত বা বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতার কথা না হয় বাদই দিলাম।
গত দুই তিন দিনে ছেলেধরার গুজব এমন পর্যায়ে গেছে যে পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষকে গুজবে কান না দেওয়ার জন্য বিবৃতি দিতে হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাঁরা গুজব ছড়িয়েছেন, তাঁদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মাঠে নামতে হয়েছে। পুলিশ বলেছে, তাঁদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া চলছে। ইতিমধ্যে ফেসবুকে পোস্ট শেয়ার করে ভাইরাল করা কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁদের প্রোফাইল, টাইমলাইন, ব্যাকগ্রাউন্ড এবং অন্যান্য তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
অনেকে কাটা মাথার ছবি শেয়ার করেছেন। মিয়ানমারের রাখাইনের নানা ছবি শেয়ার করার প্রমাণও পেয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া পদ্মা নদী ও সেতুর নির্মাণকাজের ছবিকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে ফটোশপের মাধ্যমে কাটা মাথার ছবি টেবিলের ওপর বসানোর প্রমাণ পেয়েছে তারা।
এই ভয়ানক ‘স্যাবোটাজ’ কেউ ‘এমনি এমনি শখ করে’ করেছে, তা মনে করা ঝুঁকিপূর্ণ হবে। মাথায় রাখা দরকার, পদ্মা সেতু দেশের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প। এ প্রকল্পের সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তি জড়িত। প্রথম থেকেই এই প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা এসেছে। কিন্তু সব বাধা ঠেলে যখন সেতুটি দৃশ্যমান অবয়বের মধ্য দিয়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে এমন গুজবের আকস্মিক উত্থান মনে যথেষ্ট সন্দেহ আনে। কোনো মহল সেতুর কাজ ব্যাহত করতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া দরকার। উদ্দেশ্য যা-ই থাক, পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পকে জড়িয়ে যাঁরা এই গুজব ছড়িয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া অতি জরুরি।
মানুষ আসলে ভয় পেতে ভালোবাসে। সুসংবাদে যদিও–বা কেউ অবিশ্বাস করে, কিন্তু ভীতিপ্রদ খবরে অবিশ্বাস করার মতো মনের জোর বেশির ভাগ লোকেরই থাকে না। মানব মনস্তত্ত্বের এই দিককেই গুজব রটনাকারীরা কাজে লাগায়। ফলে পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ যতই বিবৃতি দিক বা পুলিশ যতই কঠোর হওয়ার হুমকি দিক, তাতে গুজবের প্রাবল্য কমবে, এমনটি শতভাগ নিশ্চিত করে বলা যায় না। অর্থাৎ, শুধু সরকার বা প্রশাসনের নেওয়া পদক্ষেপ গুজব ঠেকাতে সর্বাংশে সফল হবে বলে মনে হয় না। সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ের আঁতুড়ঘরে গুজব নামক যে অপচ্ছায়ার জন্ম, তা বিনাশ করতে সেই সমাজকেই সচেতন করতে হবে। বিজ্ঞানের কথা বুঝিয়ে কুসংস্কার ভাঙার প্রয়াস চালাতে হবে। সমাজের শিক্ষিত শ্রেণি যদি ধরে নেয় যা করার প্রশাসনই করবে, তাদের কোনো দায়িত্ব নেই, তাহলে আরও কতজনকে ছেলেধরা ঠাওরে পিটিয়ে মেরে ফেলা হবে, তার ঠিক নেই। ছেলেধরা গুজবে দেশ তটস্থ, অথচ ভ্রান্তি ভাঙাতে সংঘবদ্ধভাবে সমাজের ভেতর থেকে কেউ এগিয়ে আসবে না, এ তো মারাত্মক বিপদের কথা!