গ্রেনেডের ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন তারা

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে নারকীয় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। সেদিন শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়া মাত্র গ্রেনেড হামলা ও গুলিবর্ষণ শুরু হয়। এতে আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং কয়েকশ মানুষ আহত হন। হামলায় অল্পের জন্য শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে তার শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়। নারকীয় সেই হামলায় আহত হয়েছিলেন শত শত নেতাকর্মী। ওই ঘটনায় ক্ষত নিয়ে বেঁচে গেছেন যারা তাদের অনেকেরই জীবন হয়ে উঠেছে বিষময়।আগস্টের সেই গ্রেনেড হামলার ঘটনায় এখনো শরীরে ৪০টিরও বেশি স্প্লিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। গ্রেনেডের ক্ষত ও সেদিনের দুঃসহ কষ্টের দিনগুলো তিনি এখনো একমুহূর্তের জন্য ভুলতে পারেন না। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার ৪৯১ জন সাক্ষীর মধ্যে তিনি অন্যতম রাজসাক্ষী। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে সেদিনের ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়ে থাকেন তিনি।

ভয়াবহ সেই হামলায় আহত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী রাশিদা আক্তার রুমা। বর্তমানে সেই আঘাতের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। নিজের দুর্দশার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, পায়ে শত শত স্প্লিন্টার হাড়ের ভেতরে, এই হাড়ের ভেতরের স্প্লিন্টারগুলো যখন ওপর নিচে চলাচল করে তখন মনে হয় নিজের পা নিজে কেটে ফেলি। পায়ে খুব যন্ত্রণা করে। ২১ আগস্ট ঘটনার পরই আমার পা কেটে ফেলতে চেয়েছিল তখন সাবের ভাইসহ কয়েকজন পা কাটতে দেয়নি। আবার যখন কাটতে চাইছিল তখন আপা (শেখ হাসিনা) না করেছেন। এখন ডান পা কিছুটা ভালো কিন্তু বাঁপায়ের ক্ষত এখনো শুকায়নি, এই যে দেখেন রক্ত ঝরছে।সমাবেশে মঞ্চের খুব কাছেই ছিলেন বর্তমান কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য ইকবাল হোসেন অপু। গ্রেনেড বিস্ফোরণে তার দুই পা স্প্লিন্টারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। উভয় পায়ের মাংসপেশি, বাঁ-হাঁটু ও পায়ের পাতায় এখনও স্প্লিন্টারের ব্যথা অনুভব করেন। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, স্প্লিন্টারের ব্যথা শরীরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। সারা বছরই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। স্প্লিন্টারের কারণে শারীরিকভাবে কোনো শান্তি নেই। সব সময় নেতাকর্মীদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে ব্যথা ভুলে থাকার চেষ্টা করি।তিনি বলেন, ওই দিনের ঘটনা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলিনি। নেত্রী মঞ্চ থেকে নামছেন। হঠাৎ মুহুর্মুহু শব্দ। আমি পড়ে গেলাম। শরীরের কোথাও আঘাত পেয়েছি কি না বুঝতে পারছি না। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি কিন্তু পারছিলাম না। তবে বুঝতে পারছিলাম, এই বুঝি সবাইকে মেরে ফেলা হচ্ছে। ২১ আগস্টের কথা মনে পড়লেই মনে হয়, আল্লাহর অশেষ রহমতে আমাদের নেত্রী বেঁচে গেছেন। সঙ্গে অমিও মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থেকে ফিরে এসেছি।

শরীরে প্রায় দুই শতাধিক স্প্লিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতা জোবায়দুল হক রাসেল। সেদিনের দুঃসহ স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, হঠাৎ বিকট একটা শব্দ শোনার পর বুঝতে পারিনি কী হয়েছিল। এরপর কয়েকটা বিকট শব্দ হয়। চারদিকে মানুষ ছুটাছুটি করছিল। আর্তচিৎকারে একটা ভয়াবহ পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। এরপর আমি আর কিছু বলতে পারব না, কয়েক ঘণ্টা পরে হাসপাতালে জ্ঞান ফিরলেও কিছুই মনে ছিল না। জ্ঞান ফিরলেই আমার পাশের সিটে দেখতে পাই বর্তমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে। গ্রেনেড হামলার চিকিৎসা নিয়ে ফেরার পর থেকে ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় আমার ওজন ৬০ কেজি বেড়ে যায়। কোনোভাবেই ওজন কমাতে পারছি না। মনে হয় যত দিন যাচ্ছে স্প্লিন্টারের ব্যথা বাড়তেছে। মাঝে মাঝে শরীরের ব্যথা এতই বেশি হয় যে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মনে হয়, মনে হয় এই বুঝি আমি মরে যাচ্ছি। বাবা, মা, স্ত্রী-সন্তানরাও শরীরের বিভিন্ন অংশে মালিশ করে দেয়।সেদিন জনসভায় এসেছিলেন মাহবুবা পারভীন। ওই ঘটনায় মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। এখনো প্রায় সাড়ে চারশ’ স্প্লিন্টার শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। ওই দিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, যখন সাভার থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে এসে পৌঁছাই তখন ৪টা বাজে। আমি আইভি আপার (আইভি রহমান) পাশে ট্রাকের পেছনের চাকার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কারণ সেখান থেকে নেত্রীকে দেখতে পাওয়া যায়। শীর্ষনেতারা একের পর এক বক্তব্য দিলেন। এরপর শেখ হাসিনা আপা জয় বাংলা বলার সঙ্গে সঙ্গে পুরো এলাকা বিকট শব্দের সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার হয়ে যায়। শুধু চিৎকার আর চিৎকার। আমি দাঁড়ানো অবস্থা থেকে পড়ে গেলাম। এরপর আর আমার কিছু মনে নেই।তিনি বলেন, পরে জানলাম আমাকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য কাপড়ের ব্যানারে করে দুই পাশ থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমার এক পাশ প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিল। বাম হাত ও বাম পা অবশ হওয়ার কারণে দাঁড় করাতে পারছিল না। এ জন্য আমাকে ব্যানারে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রচার সম্পাদক আশীষ কুমার মজুমদার আমাকে সেখান থেকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যান। আমি ৭২ ঘণ্টা আইসিইউতে ছিলাম। আমার ভাই যখন ডাক্তারের কাছে আমার অবস্থা জানতে চাইলেন ডাক্তার বললেন, সে বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে, তা ৭২ ঘণ্টা পর বোঝা যাবে। আমার ভাই তখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।

Advertisement