চলচ্চিত্র যাপন যেন

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: সিনেমাটিতে অভিনয় করছে তিনটি বিড়াল। একটা মা, একটা যুবতী আরেকটা কিশোরী। শুটিংয়ের ব্যাপারস্যাপার। একদিনে তো হয় না। সময় লাগে। এই সময়ে বিড়াল বাচ্চা দিয়েছে। সব মিলিয়ে এখন বিড়াল ১৫টি। তাদের আবার বাজার থেকে কেনা রুই মাছ ভাজা করে খাওয়াতে হয়। দেখাশোনার দায়িত্ব পড়েছে সহকারী পরিচালকের ওপর। সিনেমা সামলাও, সামলাও এর অভিনয়শিল্পীদেরও।

সিঁড়ি ভেঙে ওপরের দিকে উঠতে উঠতে বলেন কাঁটা চলচ্চিত্রের পরিচালক টোকন ঠাকুর। পুরান ঢাকার নারিন্দায় সিনেমার সেট পড়েছে। একটা পুরোনো পরিত্যক্ত বাড়ি। সেখানেই তাঁরা থাকছেন। নাম দিয়েছেন ‘কাঁটা ক্যাম্প’। ছবির প্রয়োজনেই এটি। গল্পে উঠে আসবে ’৬৪ সালের দাঙ্গা, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও ’৯০ সালের বাবরি মসজিদ ভাঙার সময়কার ঘটনা। তাই ২০০ বছরের পুরোনো একটি বাড়ি চাই। ষাটের দশকেও যেন বাড়িটিকে মনে হয় বেশ পুরোনো। খুঁজতে খুঁজতে মেলে এই বাড়িটি। যেনতেন বাড়ি নয়। এই বাড়িতেই থাকতেন সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন।

ছাদে উঠেই চোখে পড়ে একটি বিড়াল। ছাদের রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে। পরিচালক হাঁক ছাড়লেন সহকারী পরিচালকদের। ‘বিড়ালকে সরাও কবুতর খেয়ে ফেলবে।’ কবুতরও আছে বুঝি? ১০০ কবুতর কিনে আনা হয়েছে। সিনেমায় লাগবে। জানান টোকন ঠাকুর। সিনেমা নিয়ে কথা চলে। এই বাড়ির মালিকের নাম আবদুল আজিজ ব্যাপারী। তাঁর বাড়িতেই থাকে সুবোধ ও স্বপ্না রানী নামে দম্পতি। ষাট, একাত্তর ও নব্বই—এই তিন সময়েই তিনটি দম্পতি থাকে। তাদের নামও একই। তিন জোড়া সুবোধ ও স্বপ্না। বাড়ির সামনেই একটা কূপ। সেখানে ডুবে মারা যায় তিন দম্পতিই। বিড়ালের সঙ্গে মালিক আজিজ ব্যাপারীর দ্বন্দ্ব। অন্যদিকে সুবোধের বউ স্বপ্না রানী দাস আবার ওই বিড়ালকেই দুধ খাওয়ায়। এ নিয়ে সুবোধদের সঙ্গে আজিজ ব্যাপারীরও দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব কি শুধু বিড়াল নিয়ে? পরিচালক বলেন, না। এটা ছবির একটা ছোট অংশ। মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠরা বাহুবল দিয়ে সংখ্যালঘিষ্ঠকে শিকার বানায়। শিকার করেও ফেলে। মিয়ানমারের দিকে তাকালে দেখা যায় যে রোহিঙ্গারা শিকার হয়ে গেল। কাঁটায় এটাই উঠে আসবে।

শহীদুল জহিরের ‘কাঁটা’ গল্প নিয়ে এই সিনেমা। ২০১২–১৩ অর্থবছরে অনুদান পায়। এখনো শুটিং চলছে! যদিও ৭০ ভাগ শেষ। এত সময় লাগার কারণ কী? টোকন ঠাকুরের বক্তব্য, গল্পে উঠে আসছে তিনটি দশক। তিনটি সময় নিয়ে সিনেমা করা চাট্টিখানি কথা নয়। তিন দশককে ধরতে সংগ্রহ করতে হয়েছে নানা প্রপস। বাংলাদেশের মানুষ আর্কাইভাল ভ্যালু বোঝে কম। সবাই দলিল ছাড়া অন্য কিছু সংগ্রহ করে না। নানাজনের কাছ থেকে অনেক কষ্টে সেই সময়ের নানা উপকরণ সংগ্রহ করা হয়েছে। পরিচালক নিয়ে যান প্রপসে ঠাসা একটি কক্ষে। এগুলো সংগ্রহ করতেই সময় লেগেছে অনেক। পাশে দাঁড়িয়েছে দেশাল। বন্ধু পরিচালক অনিমেষ আইচ দিয়েছেন তাঁর ছবির কিছু পোশাক ও দ্রব্য। কেউ সংগ্রহে রেখেছিলেন ষাটের দশকের তাঁদের বিয়ের স্মৃতির শাড়ি। ওগুলো দিয়েই ছবির কাজ চলছে।

আকাশ মেঘলা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও। গত রোববার তাই শুটিং ছিল না। সুনসান বাড়িটি। কে বলবে, এখানে চলচ্চিত্রের শুটিং হয়! পুরো বাড়িটি অর্থাৎ শুটিং সেট ঘুরে দেখান পরিচালক। দেখে মনে হয়, একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে আস্তানা গেড়েছে একটি পরিবার। ঘরের গৃহস্থ টোকন ঠাকুর। এক এক করে পরিচয় করিয়ে দেন তাঁর পরিবারের সদস্যদের। কেউ সম্পাদক, কেউ শিল্প নির্দেশক, কেউ অভিনয়শিল্পী, কেউ পোশাক পরিকল্পক। এক হয়ে যেন পরিবারের মতো একটি চলচ্চিত্র যাপন করছেন। এই পরিবারটির কাজকারবার দেখছেন পাশের বাড়ির লোকেরা। শুটিং দেখে তাঁদের অনুভূতি কেমন? পরিচালকের নীরস উত্তর—‘খুব একটা আগ্রহ নেই। সিনেমায় তো নায়ক–নায়িকা, নাচ–গান থাকে। আমিও শহীদুল জহিরের স্ক্রিপ্টে বাজারের নায়ক–নায়িকা নিয়ে কাজ করতে চাইনি। আমার সিনেমায় চরিত্রায়নে যে সময়টা দরকার, তা তো তাঁরা দিতে পারবেন না।’

২০০ অভিনয়শিল্পী বাছাই করে দিনের পর দিন চলে কর্মশালা। ২৫ বার ঘষামাজা করে ২৬তম পাণ্ডুলিপিতে চলছে শুটিং। এক মাস শুটিং করলেই কাজ শেষ হবে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা। সারা দেশেই ছবিটি দেখানোর ইচ্ছা পরিচালকের। কথা চলে। এর মধ্যেই ঢুকে পড়েন ছবির সুবোধ চরিত্রের অভিনয়শিল্পী কৃতি। উষ্কখুষ্ক চুলের সুবোধ দেখতে বর্তমানে রাজধানীর দেয়ালে করা গ্রাফিতির সুবোধের মতো লাগে। এই সুবোধ কি ওই সুবোধ? যে এ দেশ থেকে পালিয়ে যেতে চায়? তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে আগামী বছর পর্যন্ত।

Advertisement