চীনের দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশ

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ তিনটি দেশের ধর্মীয় নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের প্রচেষ্টা রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ককে দৃঢ় করার ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যে উদ্যোগ, তা খর্ব করা উচিত নয় সরকারের ওই প্রচেষ্টার মাধ্যমে।

নাগরিকত্ব সংশোধন আইন বা সিএএ নিয়ে প্রতিবাদের কারণ হলো, এই আইনের বিধানগুলো নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি আছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশে এই আইন নিয়ে ভুল তথ্য প্রচার করছে। কিন্তু যদি যথাযথভাবে অথবা দ্রুততার সঙ্গে বিষয়টি মোকাবিলা করা না হয়, তাহলে, পুরো একটি আভ্যন্তরীণ বিষয় মারাত্মক প্রচ্ছন্ন বৈদেশিক বিষয়ে রূপ নিতে পারে।

ভারতে সিএএ বিরোধী নেতিবাচক প্রচারণায় বাংলাদেশে সরকার বিরোধী শক্তিগুলোর ব্যবহার করা খুব সহজ হয়ে পড়বে। তারা মিথ্যা এলার্ম বা সংকেত দেবে যে, ভারত থেকে দলে দলে মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে।

যদিও এমন আশঙ্কা দূরবর্তী। তবুও বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশে গুজব ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং তা থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যে সম্পর্ক ১৯৭১ সাল থেকে নানা প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে সতর্কতার সঙ্গে লালন করেছে দুই দেশ।

বাংলাদেশের ওপর নির্ভর করে অনেক কিছু
সিএএ’তে যে তিনটি দেশের নাম করা হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ ও আন্তরিক সম্পর্ক রয়েছে নয়া দিল্লির। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল সীমান্ত এলাকা। আছে আরো দীর্ঘ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক। অর্থনৈতিক ও কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে নয়া দিল্লির সঙ্গে বাংলাদেশের যে গুরুত্ব রয়েছে, অন্য কোনো প্রতিবেশীর তেমনটা নেই। ‘লুক ইস্ট অ্যাক্ট ইস্ট’ পলিসির ঈপ্সিত নীতির সফলতা এবং রিজিয়নাল কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) অথবা বিমসটেকের মতো এজেন্ডার পরিবর্তে কোনো আঞ্চলিক বাণিজ্যিক ফোরামের বিষয়টির ওপর নয়া দিল্লির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক খুব বেশিভাবে নির্ভর করে। দুই দেশই ২০১৯ সালের মার্চে নতুন নতুন চারটি প্রকল্প চালু করেছে। উদ্বোধন হয়েছে ৩৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও ১১টি পানি শোধন প্লান্ট। বাংলাদেশের নিরপেক্ষ স্কলার ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে ভারতের একই পক্ষের সঙ্গে সংযুক্ত করতে ভারত তার ন্যাশনাল নলেজ নেটওয়ার্ক প্রসারিত করেছে। অক্টোবরে তিনটি প্রকল্প চালু করা হয়েছে। এগুলো হলো বাংলাদেশ থেকে এলপিজি গ্যাস আমদানি, ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনে বিবেকানন্দ ভবন এবং খুলনায় ইন্সটিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারসে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন ইন্সটিটিউট চালু করা।

ভারতের সাউথ ব্লক প্রকল্পগুলি বাস্তবায়নে মন্থর গতির এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সম্ভবত অতীত জড়তার কারণে এমনটা হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করা হয়। ভারত কথা বলে বেশি। কাজ করে সামন্যই। এতে ঢাকার সঙ্গে নয়া দিল্লির সম্পর্কের ফারাক বৃদ্ধি পেতে পারে বলে মনে করা হয়। অন্য কেউ নন, স্বয়ং পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর নিজে এ বিষয়টি পয়েন্ট আউট করেছেন সম্প্রতি রাইসিনা ডায়ালগ ২০২০-তে তার বক্তব্যে।

চায়না ধাঁধা
এটা কোনো গোপন বিষয় নয় যে, অর্থনীতিবিদরা চীনের মাল্টি ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা করছেন। তারা চাইছেন পুরো বিশ্ব তাদের বাজারে পরিণত হোক এবং তাদের পণ্য সারাবিশ্বে সহজে প্রবেশ করার সুযোগ পাক। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম নয়। কৌশলগত অংশীদারিত্বকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে বেইজিং আরো আধুনিক করেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে চীন খুব স্বস্তিতে ছিল না। সেই বিবেচনায় এক্ষেত্রে চীন অনেক বেশি অগ্রগতি করেছে।

চীন যখন ঢাকার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে, তখন পাকিস্তানকে কঠোরভাবে কব্জায় নিয়ে নিয়েছে চীন। এটা করেছে চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি)-এর মাধ্যমে। এর ফলে গোয়েদার বন্দরের পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে তারা। শ্রীলঙ্কার হাম্বানতোতা ছাড়াও ভারত মহাসাগরে চীনের এখন দুটি কৌশলগত ঘাঁটি আছে। তা হলো চট্টগ্রাম ও গোয়েদার বন্দর। এসবের মধ্য দিয়ে তারা গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক যোগযোগের ওপর নিবিড় নজরদারি করছে। এই সমুদ্র যোগাযোগ বিস্তৃত পারস্য উপসাগর থেকে মালাকা প্রণালী পর্যন্ত। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, যাকে আরো মারাত্মক উস্কানিমুলক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তা হলো বাংলাদেশে ৩৮০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন। বাংলাদেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরো উন্নত করতে চীন সরবরাহ দিয়েছে মিং-ক্লাসের টাইপ ০৩৫বি সাবমেরিন। এই চুক্তির পাল্টা হিসেবে দ্রুততার সঙ্গে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করতে এবং আরো সামরিক হার্ডওয়্যার অর্জন করতে বাংলাদেশকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে ভারত।

দৃষ্টি বাংলাদেশের ওপর
এমনকি বেইজিং যখন ঢাকা নিয়ে ব্যস্ত, তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক সফরে বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ভারত ও বাংলাদেশ। সাতটি চুক্তি স্বাক্ষর ছাড়াও রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে রাজি হয়েছে ভারত। এসব রোহিঙ্গা নির্যাতন থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে ২০১৭ সালে ভারত সফরে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তখন একটি বেসামরিক পারমাণবিক ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ক চুক্তিতে প্রবেশ করে নয়া দিল্লি ও ঢাকা। অন্য কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গে এই একই রকম চুক্তি নেই ভারতের। যা এই অঞ্চলে নয়া দিল্লির নিরাপত্তার হিসাবে বাংলাদেশের গুরুত্ব কতখানি তার ইঙ্গিত দেয়। বিদ্যমান ৩০০ কোটি ডলারের ঋণ বাড়িয়ে নয়া দিল্লি ঢাকাকে ৪৫০ কোটি ডলার দিতে সম্মত হয়েছে। এই অর্থে বেশ কিছু সংখ্যক অবকাঠামো বিষয়ক প্রকল্প দেখাশোনা করা হবে।

এসব উদ্যোগ সত্ত্বেও নয়া দিল্লি বিরুদ্ধ-জনমতের উত্তাপ অনুভব করছে। এই সম্পর্কের সাফল্যকে দেখা হয় তিস্তার পানি বন্টন চুক্তির সীমাবদ্ধতায়। আর একটি বড় বিরক্তির বিষয় হলো অবৈধ অভিবাসীর ইস্যু। এর মধ্যে রয়েছে অনাকাঙ্খিত রোহিঙ্গার দল বেঁধে প্রত্যাবর্তন, যা যথাযথ উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
মোদি সরকারকে অবশ্যই এ বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, যখন তারা সিএএ বিরোধী বিক্ষোভকে শান্ত করার চেষ্টা করছে, তখন তাদের মনে বাংলাদেশের বিষয়টিও রাখতে হবে। চীনের মতো না হয়ে, বাংলাদেশের শিক্ষাবিদ ও কৌশলগত কমিউনিটিকে আশ্বস্ত করার ক্ষেত্রে নয়া দিল্লির সামনে একটি বড় বাধা হওয়া উচিত নয় ভাষা ও যোগাযোগ। তাদেরকে বলতে হবে যে, এটা ভারতের স্বার্থে অথবা তাদের এজেন্ডা নয় এই অঞ্চলকে ভারত ও চীনের মধ্যে ভয়াবহ ভূরাজনৈতিক এলাকায় পরিণত করা।

Advertisement