ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: ২৫ জুলাই, দুপুর ১টা। বুয়েটের আহসানুল্লাহ হলের এক ছাত্রলীগ নেতা অভিজিত খেরকে ডেকে পাঠান। তিনি যাওয়ার পর দেখেন, সেখানে আরও ১৪ শিক্ষার্থী। সবাইকে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে নির্দেশ দেয়া হয়। এর পর ছাত্রলীগ নেতারা তাদের বেদম মারধর করেন।
যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের সৌমিত্র লাহিড়ি অভিজিতকে থাপ্পড় দেন। এতে তার কান থেকে রক্ত পড়তে শুরু করে। এমন অবস্থা দেখে তাকে রুমে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
পরের দিন চিকিৎসকের কাছে গেলে জানা যায়, তার কানের পর্দা ফেটে গিয়ে ভেতরে রক্ত জমাট হয়ে গেছে। ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের (ডিএসডব্লিউ) অভিযোগ দিলেন অভিজিত। পরে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটির সুপারিশে সৌমিত্র লাহিড়ি, প্লাবন চৌধুরী, নাহিদ আহমেদ, ফরহাদ হোসেন মিথু, অর্ণব চৌধুরী ও সব্যসাচী দাসকে আহসানুল্লাহ হল থেকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করার কথা বলা হয়েছে।
এ ছাড়া হলে ঢুকতেও তাদের নিষিদ্ধ করার পরামর্শ দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে আবাসিক ও শৃঙ্খলা বোর্ডের মাধ্যমে সৌমিত্র ও প্লাবনকে আরও কঠোর শাস্তির সুপারিশ করেছিল।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেবল সৌমিত্র ও প্লাবনকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করেন। আর বাকিদের সাজা থেকে রেহাই দেয়া হয়েছে।
শিক্ষার্থী ও সহকারী প্রাধ্যক্ষ বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে- তারা এখনও হল ছাড়েননি। বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। উল্টো তার উপকার হয়েছে, বহিষ্কারের সুযোগে হলের বিভিন্ন ফি দিতে হয়নি তাকে।
নির্যাতনের কারণে শাস্তির নজির একমাত্র সৌমিত্রই বলে জানান শিক্ষার্থীরা। এর বাইরে অনেক ঘটনা ঘটে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে তাদের অভিযোগ।
সোহরাওয়ার্দী হলেরও দুই শিক্ষার্থীকে একইভাবে মারধর করা হলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শেষ বর্ষের এক ছাত্র বলেন, গত ২৩ নভেম্বর এম রশিদ হলে ছয় ব্যক্তি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে তাকে বেধড়ক পেটানো হয়েছে। যাতে তার বাঁ পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে।
হলের ভোজে টাকা দিতে অস্বীকার করায় এই মারধর। ভোজের সময় হলে থাকবেন না বলে টাকা দিতে চাননি ওই সিএসই শিক্ষার্থী।
মাসখানেক হাঁটতে না পারলেও পাল্টা প্রতিশোধের ভয়ে কোনো অভিযোগ দাখিল করেননি তিনি।
একজন সহকারী প্রাধ্যক্ষ বলেন, এটা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। গত পাঁচ থেকে ছয় বছর ধরে এমন ঘটনাই ঘটে আসছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সহকারী প্রাধ্যক্ষ আরও বলেন, এটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চরম ব্যর্থতা। আমরা শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছি।
আরেক সহকারী প্রাধ্যক্ষ বলেন, প্রতিটি ঘটনাই প্রশাসন যথাযথ পদক্ষেপ নিলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো। এটি আমাদের ব্যর্থতা।
‘শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দেয়া আমাদের দায়িত্ব হলেও প্রশাসনে রাজনৈতিকীকরণের কারণে তা পালন করতে পারিনি। ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের কাছে যখনই আমরা অভিযোগ দিই, তখনই তিনি বলেন, পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিন,’ বললেন আরেক সহকারী প্রাধ্যক্ষ।
বুয়েট কর্তৃপক্ষ জানতেন যে শিক্ষার্থীদের শারীরিক নির্যাতন, গালাগাল ও উত্ত্যক্ত করছেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। কিন্তু অপরাধীদের বিরুদ্ধে তাদের ব্যবস্থা নেয়ার নজির বিরলই বটে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির ১০ শিক্ষক ও তিন সহকারী প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলে এমনটিই জানা গেছে। হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নির্যাতনের কথা তারা জানতেন।
তাদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি সঠিকভাবে পদক্ষেপ নিতেন, তবে আবরারকে এভাবে মরতে হতো না।
বুয়েটের তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন আবরার ফাহাদ। রোববার রাতে তাকে হলের কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছেন ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী। এ নিয়ে দেশজুড়ে ক্ষোভ চলছে।
বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি একেএম মাসুদ বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে এমনটি ঘটে আসছে। এটি রাতারাতি কোনো ঘটনা না। নিঃসন্দেহে এটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা। অবশ্য শিক্ষকদেরও।
তিনি বলেন, শিক্ষক সমিতি গতকাল একটি বৈঠক করেছে। সেখানে হলগুলোর প্রতিনিধিরা বলেছেন- নির্যাতন নিয়ে তারা সতর্ক ছিলেন। কিন্তু উচ্চপর্যায় থেকে সহযোগিতা না পাওয়ায় তারা যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেননি।
মাসুদ বলেন, এখানে ভর্তি হওয়ার পর মেধাবী শিক্ষার্থীরা কেন উচ্ছৃঙ্খল হতে যাবে? এটা হতাশারই ঘটনা। উদ্বেগের আরেকটি বিষয় হচ্ছে, রাজনৈতিক চাপে তারা সর্বদা অস্বীকার করার মেজাজে থাকেন।
শিক্ষার্থীদের প্রতি খেয়াল রাখতে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের একজন হচ্ছেন ছাত্রকল্যাণ পরিচালক (ডিএসডব্লিউ) বলে জানালেন শিক্ষক সমিতির এ সভাপতি।
বেশ কয়েকজন শিক্ষক বলেছেন, হল কর্তৃপক্ষ উচ্চপর্যায়ের কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানালেও সেখান থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হয়েছে।
অধিকাংশ শিক্ষককের মত, হিতে বিপরীত হওয়ার ভয়ে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ দিতে ভয় পাচ্ছেন। এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ দেয়ার পরও অপরাধীদের সাজার মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা বিরল।
এক বুয়েট শিক্ষার্থী বলেন, প্রশাসন যদি সঠিক পদক্ষেপ নিত এবং সক্রিয় হতো, তা হলে আবরারকে মরতে হতো না, আর ছাত্রলীগও এতটা সাহসী হয়ে উঠত না।
ডিএসডব্লিউ অফিসের পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, এটি আমার ব্যর্থতা না, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা। মাস তিনেক আগে আমি দায়িত্ব নিয়েছি। আমার সামনে এসে কেউ যদি বলতে পারেন যে আমি তাদের পরিস্থিতি মানিয়ে চলতে বলেছি, তবে আমি তখনই পদত্যাগ করব।
বুয়েটির এক শিক্ষক বলেন, এমন ঘটনা অনলাইনে ছড়িয়ে দিতে ২০১৬ সালে সিএসই বিভাগ থেকে একটি ওয়েবসাইট চালু করেছেন। জুলাই পর্যন্ত সেখানে ১০৩টি ঘটনার প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। এসব প্রতিবেদন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।