তবে এককালের ছাত্রলীগের নেতা, আজকের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ ক্ষেত্রে তাঁর রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তারই পরিচয় দিয়েছেন। মূলত, ছাত্র-তরুণদের সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ছাত্রলীগের অকার্যকরতার প্রমাণ পাওয়ায় নেতাদের এই ভাবনা-দুর্ভাবনা। বস্তুত, ২০১২ সালের শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের পরে সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনটিও ছিল ছাত্র-তরুণদের এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদী জাগরণ। বরাবরের মতো এতেও নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই। আন্দোলনটি ছিল ন্যায্য, এর পেছনে সমর্থন ছিল ব্যাপক, গণমাধ্যমও একে সমর্থন দিয়েছে। ফলে দ্রুত ছাত্রসমাজের পক্ষে তাদের অনুকূলে ব্যাপক জনমত তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। তারুণ্যের এ রকম স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণে সাধারণত দলমতের বিষয়টি মুখ্য থাকে না। তরুণদের দাবিও ছিল সর্বজনীন-এ ছিল দলমত-নির্বিশেষে সবার সমর্থনে ন্যায্যতা ও জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে শক্তিশালী আন্দোলন। এতে নিশ্চিতভাবে ছাত্রলীগের সমর্থক এবং সাধারণ কর্মীরাও শামিল হয়ে থাকবেন। আদতে দলীয় পরিচয় ভুলে তাঁরা সবাই নিজেদের ভবিষ্যৎ চিন্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েই এতে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন।
অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, যেকোনো জনপ্রিয় ইস্যু ও আন্দোলনকে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে আসার ক্ষমতা এবং প্রবণতা হয়তো দূরদর্শিতাই আওয়ামী লীগের রয়েছে। অন্যদের সূচিত অনেক কর্মসূচি ও আন্দোলনের প্রতি জনসমর্থন প্রমাণিত হলে তারা তাতে যুক্ত হয়েছে এবং বড় দল হিসেবে এর নেতৃত্ব ও সুফল নিজেদের করে নিতে পেরেছে। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন কিংবা কর্মসূচি হিসেবে সমাজতন্ত্রের দাবি কখনো সাধারণ ছাত্ররা, কখনো বামপন্থীরা শুরু করেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে রাজনৈতিক যাত্রাপথে এসবের উত্তরাধিকার আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ গ্রহণ করেছে এবং সুফলও পেয়েছে। একে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের দূরদর্শিতা ও সৃজনশীলতা আখ্যায়িত করা যায়। বঙ্গবন্ধু তাই তাঁর অগ্রবর্তী ও সমসাময়িক নেতাদের ছাপিয়ে গিয়েছিলেন এবং এ দেশের প্রগতিশীল মানুষেরও নেতা হিসেবে আদৃত হয়েছেন। সাম্প্রতিক কালে শেখ হাসিনাও বর্তমান কাল ও আগামী দিনের প্রেক্ষাপটে ডিজিটাল প্রযুক্তির গুরুত্ব অনুধাবন করে সে আঙ্গিকে তাঁর সরকার পরিচালনা করে সৃজনশীলতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু একই সঙ্গে লক্ষণীয় বিষয় হলো, দীর্ঘদিন ধরে প্রথমে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের এবং বর্তমানে ক্ষমতা ধরে রাখতে ব্যতিব্যস্ত আওয়ামী লীগ এবং আরও বেশি করে ছাত্রলীগ কোনো নতুন রাজনৈতিক তত্ত্ব, ধারণা বা কর্মসূচিকে রাজনীতিতে ব্যবহার করতে পারছে না। যেকোনো ধরনের স্থবিরতা অবক্ষয়ের সূচনা করে এবং দলের অভ্যন্তরে টানাপোড়েন ও সংকট তৈরি করে। জনাব কাদের সমস্যাটা দেখতে পেয়েছেন, এ বিষয়ে আশু কিছু করণীয় প্রয়োজন, তাও বুঝতে পেরেছেন-এটা সৌভাগ্যের বিষয় এবং তাঁকে সাধুবাদ দিতে হয়।
রাজনীতির এই রাজনীতিহীনতার দৈন্য ও সংকট নতুন নয়, এর সূত্রপাত হয়েছে সামরিক শাসনের আমল থেকে। ১৯৭৫-এর পরে দুই সামরিক শাসক বিরাজনৈতিকীকরণের একটি প্রক্রিয়া চালিয়েছিলেন। তখন থেকে রাজনীতিতে কালোটাকা, অবৈধ অস্ত্র ও পেশিশক্তির প্রয়োগ ঘটতে শুরু করল। ছাত্ররাজনীতিতে এর দূষণ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তবে এ সত্ত্বেও তাকে কলুষিত ও অকার্যকর করে তুলতে আরও কিছু সময় লেগেছে। স্বৈরাচারবিরোধী গণ-আন্দোলনে ছাত্রসমাজই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু তখনো ছাত্র নেতৃত্বের কোনো কোনো অংশ অবৈধ অর্থ, অন্যায় ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি ভোগ করে আসছিল।
ছাত্রশিবির বা ছাত্রদলের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে একসময় ছাত্রলীগও ক্যাম্পাস দখলে নেওয়ার রাজনীতিতে জড়িয়েছে। দখলের এই রাজনীতিতে অর্থ ও প্রতিপত্তি অর্জনের পথও খুলে যায়। আর অর্থ, প্রতিপত্তির কারণে নেতা ও তাঁর অনুগ্রহভাজন ক্যাডার তৈরির প্রক্রিয়াও অবশ্যম্ভাবী ছিল এবং তা এখানেও ঘটেছে। এতে দলীয় সংহতি ও ঐক্য বজায় রাখার কোনো উপায় থাকে না। কারণ, দখলদার প্রতিপত্তিশালী নেতাদের ঘিরে ছোট ছোট উপদল তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। আজ জনাব ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগ নিয়ে যে দুর্ভাবনায় পড়েছেন, তার গোড়া কিন্তু এই অতীতের মধ্যেই নিহিত আছে।
ছাত্রলীগ আজ বহুধাবিভক্ত, যার পেছনে আদর্শ নয় নিতান্ত বৈষয়িক স্বার্থই কাজ করে থাকে-প্রতিটি ক্যাম্পাস বা এলাকায় স্বতন্ত্র নেতা ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থে কাজ করে থাকেন। বাইরে বাইরে শোনা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ায় ছাত্রলীগের ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তাতেই কি ছাত্রলীগের মধ্যে বেশি চাঞ্চল্য, গোয়েন্দাদের বিভ্রান্তিকর তৎপরতা দেখা দিয়েছিল? এর সত্যতা আমরা জানি না, তবে আন্দোলনটির প্রকৃতি ও বাস্তবতা খেয়াল করলে ছাত্রলীগের অপারগতার কারণ বোঝা যায়।
ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, দীর্ঘদিন ধরে প্রতাপ, প্রতিপত্তি তথা একচ্ছত্র দখলদারি কায়েম রাখার জন্য সাধারণ ছাত্রদের ওপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা যে জুলুম চালিয়ে আসছেন, এ আন্দোলনে তার বিরুদ্ধে তাঁদের ক্ষোভেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। সাম্প্রতিক অতীতে আমরা দেখেছি, ছাত্র-তরুণদের গণজাগরণ মঞ্চের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে কীভাবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করার ও তা আয়ত্তে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ। তাতে শেষ পর্যন্ত এ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে বন্ধই হয়ে গেল। কিন্তু এর বিপরীতে, অর্থাৎ একটি অসাম্প্রদায়িক প্রগতিচেতনার দেশপ্রেমিক আন্দোলনের অবসানের মধ্য দিয়ে হেফাজতে ইসলামের মতো জাতীয় ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধাবিহীন, দেশচেতনাহীন ধর্মীয় গোষ্ঠীর উত্থান ঘটল। এতেই শেষ নয়, দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকার তাদের নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে, তাদের নানা অ্যাজেন্ডা পূরণে আন্তরিক থাকছে। কেবল হেফাজত নয়, ধর্মীয় মৌলবাদী চিন্তাচেতনা আজ ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের ছায়ায় সমাজে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এই ভূমিকাকে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সৃজনশীলতা বলা যাবে, নাকি ক্ষমতার জন্য আপসকামিতা বলা ঠিক হবে-তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভাবতে হবে।
অতীতে আমরা ভাষা আন্দোলনের সুফল পেয়েছি বাঙালি জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের পরিণতি ঘটেছে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে। তা সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ ও তাঁর নেতৃত্বে সাহসী আপসহীন আন্দোলনের মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিপত্তি ও দখলদারির রাজনীতিতে এ রকম পরিণতি অর্জন আর সম্ভব নয়। গণজাগরণ মঞ্চের ভস্ম থেকে যেন হেফাজতের উত্থান ঘটল। এসব বিষয় আশা করি জনাব কাদের ও তাঁর সহকর্মীদের বিবেচনায় থাকবে।
দখল ও প্রতিপত্তির নেতৃত্ব ক্রমেই রাজনৈতিক বিবেচনা ও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে, হারিয়ে যায় দূরদর্শী চিন্তা ও আদর্শবাদের গুরুত্ব। সবটাই চলে তাৎক্ষণিক প্রয়োজন ও লাভের বিবেচনায়। আমরা একসময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি প্রগতিশীল বাম ছাত্রসংগঠনের উত্থান ঠেকাতে ছাত্রলীগ ছাত্রশিবিরের সঙ্গেও কাঁধ মিলিয়েছিল। অভিযোগ উঠেছে, আজ ছাত্রলীগে বহু ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মী অনুপ্রবেশ করেছেন। তাঁরা অনুপ্রবেশ করুন বা না করুন, যে বাস্তবতার মধ্য দিয়ে বর্তমান নেতৃত্বের বিকাশ হয়েছে, তাতে তারা তো রাজনৈতিক আদর্শ বা কর্মসূচি নিয়ে ভাবতে শেখেনি, তারা শিখেছে ক্যাম্পাস দখলে রেখে নগদ লাভবান হওয়ার কৌশল। এটি রাজনীতির কানা গলি, যেখানে ঢোকা যায়, কিন্তু সোজা পথে বের হওয়া যায় না। বেরোতে হলে দুই পা পেছনে যেতে হবে—পিছিয়েই ফিরতে হবে রাজপথে। ফিরে এসে তবেই রাজনীতির মহাসড়কে ওঠা সম্ভব হবে। সড়ক পরিবহনমন্ত্রী তো সেতুমন্ত্রীও বটে। আশা করি, তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির মহাসড়কে প্রত্যাবর্তনের পথে সেতুবন্ধ রচনা করতে পারবেন। আমরা তাঁর সাফল্য কামনা করি।