আবুল কাসেম ভূঁইয়া:
বাংলাদেশে নীরবে গড়ে উঠেছে জাহাজ নির্মাণ শিল্প। এই শিল্প এখন আশার আলো দেখতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে নির্মিত পণ্য এবং যাত্রী বহনকারী জাহাজ ডেনমার্ক, জার্মান, পোল্যান্ডে যাচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ বাংলাদেশে নির্মিত জাহাজ ক্রয় করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ব্রিটিশ নৌবাহিনী বাংলাদেশ থেকে যুদ্ধ-জাহাজ নির্মাণ করে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প ইতোমধ্যে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সূচনা প্রাচীনকাল থেকেই। ১৫ থেকে ১৭ শতাব্দীর মধ্যে আমাদের দেশে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সূচনা ঘটে। ১৮০৬ সালের দিকে চট্টগ্রাম শিপইয়ার্ড ১০০০ টন পণ্যবাহী বাণিজ্যিক জাহাজ নির্মাণ করে। একই সময়ে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জন্য যুদ্ধ-জাহাজ নির্মাণ করা হয়। তখনকার সময়ে সম্পূর্ণ কাঠের জাহাজ নির্মাণ করা হতো। বর্তমান সময়ে সম্পূর্ণ স্টিল বডি জাহাজ নির্মাণ করা হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের দেশে ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় ২০০টি জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে নির্মিত জাহাজ বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৫৮ সালের দিকে জার্মানির সহায়তায় খুলনা শিপইয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৫৭ সালের দিকে উক্ত প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণভাবে জাহাজ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৯৯ সালের দিকে বাংলাদেশ নৌবাহিনী উক্ত প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বভার গ্রহণ করে। বর্তমানে এটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ১৯৭৯ সালের দিকে ঢাকার ফতুল্লায় আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য জাহাজ নির্মাণের জন্য জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে জাহাজ নির্মাণ শিল্প গড়ে উঠলেও আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান আনন্দ শিপইয়ার্ড এবং ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। তারা অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে জাহাজ নির্মাণ করছে। বর্তমানে পৃথিবীর মধ্যে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে চীন সবার শীর্ষে থাকলেও বাংলাদেশ জাহাজ নির্মাণ শিল্পে চীনের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে। জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি চীন, কোরিয়া এবং জাপানের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু দক্ষতার দিক দিয়ে বাংলাদেশের শ্রমিকরা অনেক এগিয়ে আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের নির্মিত জাহাজ নির্মাণ ব্যয় সর্ববৃহত্ জাহাজ নির্মাণকারী দেশ চীনের তুলনায় ১৫% কম। আন্তর্জাতিক বাজারে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে ২০০ বিলিয়ন ডলারের শতকরা দুই ভাগ অর্ডার পেলে বাংলাদেশ জাহাজ নির্মাণ শিল্পে অনেক এগিয়ে যাবে। জাহাজ নির্মাণ শিল্পে প্রচুর মূলধনের প্রয়োজন হয়। যা নাকি এদেশে সব শিপইয়ার্ডের কাছ নেই। মূলধন সমস্যা সমাধান করতে পারলেই শিপইয়ার্ডগুলো লাভের মুখ দেখতে পারতো। বাংলাদেশে শতকরা ১৬ ভাগ সুদে ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা করতে হয়। অপরদিকে চীনে মাত্র শতকরা ছয় ভাগ সুদে ব্যাংক ঋণ পায় শিপইয়ার্ডগুলো। বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য শিপইয়ার্ডের মালিকরা কম সুদে ঋণপ্রাপ্তির দাবি জানিয়েছেন। জাহাজ রপ্তানিতে বাংলাদেশের শিপইয়ার্ডগুলো মাত্র শতকরা পাঁচ ভাগ ইনসেনটিভ পায়। ভারতে পায় শতকরা ২৫ ভাগ। বর্তমানে বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিকভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে জাহাজ নির্মাণের ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে। এ পর্যন্ত ২৫০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্ষুদ্র জাহাজ নির্মাণের জন্য ৪০০ বিলিয়ন ডলারের চাহিদা রয়েছে। দেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে দেশের রপ্তানি পণ্য তালিকায় গার্মেন্টস শিল্পের পর জাহাজ নির্মাণ শিল্পের স্থান হবে এমন প্রত্যাশা অমূলক নয়। বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের গত ২৫ বছর ২৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। আর জাহাজ নির্মাণ শিল্পে গত ১৩ বছরে তার সমপর্যায়ে আয় করেছে। পৃথিবীর বৃহত্ জাহাজ নির্মাণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উঠে এসেছে। জাহাজ নির্মাণ শিল্পের ব্যাপারে সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা পেলে এই শিল্প আরো এগিয়ে যাবে। বর্তমানে এই শিল্পে হাজার হাজার লোক কর্মরত আছেন। দিন দিন এই শিল্পে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা বাড়ছে। বলা প্রয়োজন যে এই শিল্পের জন্য দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে অর্থমন্ত্রণালয়। আগামী ৩ বছরে ১০ হাজার বেকার তরুণ যুবককে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। জাহাজ নির্মাণ শিল্প মালিক সমিতি এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে প্রচুর লোকের কর্মসংস্থান হবে এবং এই শিল্পের মানও আরো বেড়ে যাবে। আমাদের দেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন দিগন্তের সূচনা সময়ের ব্যাপার মাত্র।