সালাম মশরুর :: ডাক্তারদের চেম্বারে তালা ঝুলছে। হাসপাতালগুলোতেও চিকিৎসা নেই। রোগীদের বঞ্চনা নিয়ে জনমনে অসন্তুষ সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের বতমান সংকট মোকাবিলায় সরকারের সাথে বিভিন্ন শেনী পেশার মানুষও এগিয়ে আসছে। মানুষ মানুষের জন্য এই সত্যটি আজ সর্বত্র প্রতিফলিত হচ্ছে। কর্মহীন, দরিদ্র মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়ার জন্য সরকারী বরাদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে প্রশাসনের কর্মকর্তারা বাড়ী বাড়ী গিয়ে ত্রান সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন।
সে সাথে নাগরিক সমাজ, বিভিন্ন সামাজিক ও ব্যবসায়ী সংগঠন ত্রান সামগ্রী নিয়ে এগিয়ে আসছে। এই মুহ্রর্তে মানুষ অভুক্ত থাকবেনা। সেটা বলা যায়। না খেয়েও মানুষ মারা যাবেনা তবে যথাযথ চিকিৎসার অভাবে প্রাণের ক্ষতি হতে পারে।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে করনা নিয়ে আতংকের কারনে মৌসুমী জ্বর সর্দি কাশি নিয়ে আক্রান্তরা সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়া অন্যান্য রোগীরাও যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছেন না। চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে প্রাণহানির আশংকা রয়েছে। দেশের হাসপাতাল গুলোতে কোন রোগী জ্বর, সর্দি, কাশি নিয়ে গেলে রোগীর কথা শুনতেও কোন লোক এগিয়ে আসেননা। পূর্ব থেকে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত, শ্বাস কষ্ট, কিডনী সমস্যার রোগীরা নিয়মিত চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গিয়েও স্থান পাচ্ছেননা। অলিখিতভাবে হাসপাতালগুলোতে চলছে রোগীদের এড়িয়ে চলার পদ্ধতি। রোগী গেলে কোন ক্ষেত্রে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসাবে দু-চারটি টেবলেট লিখে দিয়ে পরবর্তীতে যোগাযোগ করার কথা বলে বিদায় করে দেয়া হয়। ডাক্তার কখন আসবেন, কোথায় আছেন, এই বিষয়েও সন্তুষজনক উত্তর পাওয়া যাচ্ছেনা। দেশের সবচেয়ে স্পর্শকাতর সেক্টর হচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ। সাধারণ সময়ে আমাদের দেশে ডাক্তার ও চিকিৎসা নিয়ে অবহেলা, অব্যবস্থা, খামখেয়ালী, ব্যবসাায়ীক মনোভাবের অভিযোগ নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। চিকিৎসা ক্ষেত্রে অবহেলা, ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুবরন, সময় মত চিকিৎসা না দেয়ায় রোগীর মৃত্যু। ভুল চিকিৎসায় রোগীর মত্যুকে কেন্দ্র করে হাসপাতালে হামলা, রোগীর স্বজনদের সাথে নার্স ও চিকিৎসকের হাঙ্গামা, হামলাসহ নানান অপ্রীতিকর ঘটনা নিয়ে সারা বছর পত্র পত্রিকায় এই চিত্র পাওয়া যায়। অন্যান্য দেশে ডাক্তার রোগীর সম্পর্ক হচ্ছে বন্ধুর মতো। এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, আমাদের দেশে ডাক্তার আর রোগীর ব্যবধান হচ্ছে আকাশ পাতাল। অনেক সময় রোগীরা চেম্বারে গিয়ে কোন ডাক্তারের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলতে পারলে, আর ডাক্তারও রোগীকে অভয় দিলে সেই রোগী যেন চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসতে না আসতেই ভালো হয়ে গেছেন এমন ভাব দেখা যায়। রোগীর প্রশংসায় ভাসতে থাকবেন ডাক্তার। কোথাও সুযোগ পেলেই ঐ রোগী সবার আগে বলবেন ঐ ডাক্তারের নাম। ডাক্তার ভিজিট নিচ্ছেন ঠিকই শুধু একটু ভালো ব্যবহার, রোগীরকে রোগ নিরাময়ে কতখানি সাহায্য করে সেটা সবাই জানেন। আমাদের দেশে এই ব্যবহারটার খুবই অভাব। যে কারনে নিজের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা রেখে এই দেশের মানুষ প্রতিনিয়ত প্রতিবেশী দেশ ভারতে যাচ্ছেন। সেখানে রোগীরা ডাক্তারের কাছ থেকে সেবা ও ব্যবহার দুটোই পাচ্ছেন। আজকের এই দু:সময়ে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মানবিক দিক বিবেচনা করে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। ডাক্তার হিসাবে তার ঝুঁকি রয়েছে। আর সেই ঝুঁকি কাধে নিয়ে কিভাবে মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা যায় সেটা তাদেরকেই খোঁজে নিতে হবে।
বাইরের দুনিয়ায় করনা আক্রান্ত স্থানে ডাক্তাররা সেবা দিয়ে যাচ্ছে সেটারও উদাহরন রয়েছে। ইতালী সরকারের ঘোষনার সাথে সাথে ৮হাজার চিকিৎসক করনা আক্রান্তদের চিকিৎসা প্রদানে এগিয়ে এসেছে। তারাতো জানে করনা আক্রান্ত হয়ে তাদের মৃত্যু হতে পারে তবুও মানবতার ডাকে তারা ঘরে বসে থাকতে পারেনি। প্রতিটি দেশে এই সংকটময় মুহূর্তে চিকিৎসকরা কোথাও ঘরে বসে নেই। ব্রিটেন আমেরিকায় সেদেশের চিকিৎসকদের সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের বাঙালী চিকিৎসক ও নার্সরা নিজেদের উজাড় করে মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। বৃটেনে নিয়মিত চিকিৎসকদের পাশাপাশি দুর্যোগ মোকাবিলায় মানব সেবায় এগিয়ে এসেছেন দেশটির অবসরে চলে যাওয়া চিকিৎকরা। সেসাথে বিমান বালা, ফায়ার সার্ভিস সেনাবাহিনী নৌবাহিনীসহ বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত যারা প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানে প্রশিক্ষন প্রাপ্ত তাদেরকেও চিকিৎসা সেবায় মাঠে নামানো হয়েছে। এছাড়া দেশের সকল মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিবিএস শেষ বর্ষে অধ্যয়নরত ছাত্রদের সরকার থেকে চিকিৎসক স্বীকৃতি দিয়ে চিকিৎসা প্রদানের জন্য নিয়োজিত করা হয়েছে। ডাক্তারদের চিকিৎসা সেবা দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে তাদের সুরক্ষা তাদেরকেই নির্ধারন করতে হবে। ডাক্তাররা চিকিৎসা সেবা না দিলে রোগীর পরিত্রানের অন্য ব্যবস্থা নেই। আর এই ক্ষেত্রে মানবিক বিষয়টি অগ্রগন্য।
প্রতিবছরের এই সময়ে আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে সাধারণ ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপে জ্বর আর ঠান্ডার সংক্রমণ দেখা দেয় বেশী। এ বছর মহামারী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয়ায় সাধারণ সর্দি-কাশি বা ফ্লুতেও উৎকণ্ঠা ছড়াচ্ছে। যে কারনে এই সাধারণ সমস্যাগুলোও হয়ে উঠেছে ভয়ের কারণ। চিকিৎকদের মতে করোনার সংক্রমণের সঙ্গে সাধারণ ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জার যেমন মিল আছে তেমনি আবার সুস্পষ্ট অমিলও আছে। করোনা ও সাধারণ ফ্লু দুটোই শ্বাসতন্ত্রের রোগ। দুটোর সংক্রমণ ছড়ায়ও একইভাবে ড্রপলেট (মুখ বা নাকনিঃসৃত তরল কণা), বিভিন্ন বস্তু আর সংস্পর্শের মাধ্যমে। তাই দুটোকেই প্রতিরোধ করার উপায়ও এক। হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলা, হাত দিয়ে নাক-মুখ-চোখ স্পর্শ না করা; বারবার হাত ধোয়া এবং সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলার মাধ্যমেই কেবল রোগ প্রতিরোধ সম্ভব।
সাধারণ মৃদু সর্দি-কাশি-জ্বর থেকে শুরু করে তীব্র সংক্রমণ, নিউমোনিয়া বা শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ হয়ে থাকে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণগুলোর সঙ্গে মিল থাকায় সাধারণ সর্দি-কাশি হলেও সবাই ভয় পাচ্ছেন, করোনা হলো কি না। সাধারণ সময়ে মৌসুমী জ্বর সর্দি কাশির জন্য বেশীর ভাগ লোক স্থানীয় ফামের্সী থেকে ঔষধ কিনে নিয়ে সেবন করেন। বর্তমানে জ্বর সর্দি কাশির জন্য ফার্মেসী গুলোও অধিক সতর্কতার কারনে রেগিীদের ঔষধ না দিয়ে বিদায় করে দিচ্ছে। এমনকি ফার্মেসীতে যাবার পর ঐ ব্যক্তিকে করনা আক্রান্ত মনে করে এমন ব্যবহার করা হচ্ছে যে, যত তাড়াতাড়ি তাকে সরিয়ে দেয়া যায় ততই মঙ্গল। হাসপাতালগুলি প্রায় রোগী শূন্য। যেখানে প্রতিদিন সরকারী বেসরকারী হাসপাতাল, ডাক্তারের চেম্বার গুলোতে কয়েক হাজার রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন, সেখানে রোগীর সংখ্যা শূন্যের কোঠায়।
ডাক্তার না থাকায় ঘরে বসেই তাদের কাতরাত্বে হচ্ছে। গুটি কয়েক ডাক্তার আছেন তারা সুবিধা বুঝে, আত্মীয় পরিজনের সুবাধে কোন ভাবে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। অধিকাংশ ডাক্তারই বলতে গেলে হোম কোয়ারেন্টিনে চলে গেছেন। চেম্বারগুলোতে তালা ঝুলছে। কোথায় কাকে গিয়ে দেখানো যাবে, তাও কেউ জানেনা। স্বাভাবিক সময়ে আমাদের দেশে ডাক্তারের সাক্ষাৎ পেতে হলে চেম্বারে নির্দিষ্ট সময়ে অথবা ডাক্তারের চেম্বার সহকারীর মোবাইল ফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা চেষ্টা করে টিকেট সংগ্রহ করতে হয়। এখন সেই ব্যবস্থাও আর চালু নেই। সুতরাং করনার পাশাপাশি সাধারন মৌসুমী জ্বর, সর্দি কাশিসহ অন্যান্য রোগের চিকিৎসার অবাধ সুযোগ না থাকলে সংকট মহাসংকটে রূপ নেবে। এমনিতেই করনা ভীতি সমাজ জীবনে জটিল পরিস্থিতি তৈরী করেছে। সাধারন জ্বর সর্দি কাশিতে মৃত্যু বরণ করেও অতি সতর্কতার কারনে মৃত ব্যক্তির দাফন কাফন থেকে শুরু করে পরিবারের পরবর্তী জীবন ব্যবস্থাও জটিল হয়ে উঠছে। বর্তমান আতংকিত পরিস্থিতিতে সাধারন মৃত্যুকেও যেন স্বাভাবিক মেনে নিতে দশবার ভাবতে হচ্ছে। এক ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করেই শেষ নয়। প্রথম দফায় গোটা পরিবারকে যেতে হচ্ছে হোম কোয়ারেন্টিনে। গ্রামে যেন তারা এক ঘরে হয়ে গেলেন। অজানা আতংকে প্রতিবেশীরাও তাদের এড়িয়ে চলছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চার বছরের মধ্যে এই মৌসুমেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ বা অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন (এআরআই) বলতে সর্দি–কাশি, গলাব্যথা থেকে শুরু করে ব্রঙ্কাইটিস (শ্বাসনালীর ভেতরে আবৃত ঝিল্লিতে সংক্রমণ), ব্রঙ্কোলাইটিস ও নিউমোনিয়াকে বোঝানো হয়ে থাকে।
নিয়ন্ত্রণকক্ষের তথ্যমতে, এ বছরের মার্চে গত বছরের মার্চের তুলনায় এআরআইতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৪ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। এ বছর ৩০ মার্চ পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১১ হাজার ৯৩০। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮২০, ২০১৮ সালে ১০১০ এবং ২০১৭ সালে ১৪১ জন। একইভাবে দেখা যাচ্ছে, এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এআরআইতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৯৫০, গত বছর এই সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৪৬০। এর এক মাস আগে অর্থাৎ জানুয়ারিতে রোগীর সংখ্যা ছিল ২৬ হাজার ৬৪১। গত বছরের জানুয়ারিতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ৫২০।
গত চার বছরের তুলনায় এ বছরই শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এতো বেশি কেন, এ প্রশ্ন তুলছেন খোদ চিকিৎসকরাই। তারা বলছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মেনে এটিপিক্যাল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের অবশ্যই করোনা পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৯ জন।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক