গাজীউল হাসান খান ::
যা আশঙ্কা করা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তা-ই করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর পূর্বঘোষিত ইচ্ছা অনুযায়ী দেশের দক্ষিণ সীমান্তে বিরাজমান পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে অভিযোগ করে তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। ক্ষমতায় আসার আগে থেকে দুই হাজার মাইল দীর্ঘ মেক্সিকো সীমান্তকে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন অবৈধ অভিবাসন, মাদক চোরাচালান ও অবাঞ্ছিত অপরাধীদের নিকৃষ্ট বিচরণক্ষেত্র হিসেবে। বিষয়টি ছিল তাঁর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য প্রণীত ইশতেহারের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ইস্যু। এর পেছনে দেশের আপামর জনসাধারণের তেমন সমর্থন না থাকলেও প্রচুর আগ্রহ ছিল দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনগ্রসর শ্বেতাঙ্গ সমাজের। এ ইস্যুতে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ‘শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের’ ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মূলত শ্বেতাঙ্গদের সে ব্যাপক অংশের ভোটই তাঁকে ক্ষমতায় যেতে সাহায্য করেছে বলে অনেকের ধারণা। সে অংশটির বিরুদ্ধে উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং এমনকি বর্ণবাদী মনোভাবেরও অভিযোগ রয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনোমতেই তাদের হাতছাড়া করতে রাজি নন। সুতরাং দেশের দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকারীরা এসে যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের সব চাকরিবাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য হাতিয়ে নিচ্ছে বলে প্রচার করেছেন ট্রাম্প। তিনি অভিযোগ আরো জোরদার করেছেন যে তারাই অবৈধ অভিবাসন, মানব ও মাদক পাচারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মেক্সিকো ও দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য দেশ থেকে পালিয়ে আসা অপরাধী কিংবা সমাজবিরোধী মানুষরাই যুক্তরাষ্ট্রের সব অপরাধমূলক কিংবা অসামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর অভিযোগ অব্যাহত রেখেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য প্রদত্ত সব সাহায্য-সহযোগিতা অন্যায়ভাবে ভোগ করছে সেসব অবৈধ অভিবাসী। সেখানে অর্থাৎ দক্ষিণ সীমান্তে এক যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে বলে প্রচার করে যাচ্ছেন ট্রাম্প। সুতরাং তাঁর মতে, সে সীমান্তজুড়ে একটি সুউচ্চ ও শক্তিশালী প্রাচীর বা দেয়াল নির্মাণের প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। কিন্তু বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া গণমাধ্যমের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বলে যে বেশ কিছু বছর ধরে মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে অভিযুক্ত অবৈধ অভিবাসী কিংবা মানব ও মাদক পাচারের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। এখন যা হচ্ছে সেটি ডোনাল্ড ট্রাম্পের একচেটিয়া অপপ্রচার।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া ডেমোক্রেটিক দলের অভিমতও গণমাধ্যমের মতোই। তাদের ধারণা, আগামী বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নির্বাচন। এতে দ্বিতীয় দফায় প্রার্থী হতে বদ্ধপরিকর ট্রাম্প। তাই নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ততই দক্ষিণ সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ নিয়ে তৎপর হয়ে উঠেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। কিন্তু ট্রাম্পের অসামান্য চাপ ও দাবির মুখে তাঁর দেয়াল নির্মাণ খাতে প্রার্থিত বরাদ্দ দিতে রাজি হয়নি ডেমোক্র্যাটস প্রভাবাধীন প্রতিনিধি পরিষদ। দুই হাজার মাইল বিস্তৃত সীমান্তজুড়ে দেয়াল নির্মাণ প্রয়োজনীয় কিংবা বাস্তবসম্মত নয় বলে তাদের ধারণা। এর সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলের বেশ কিছু সদস্যও একমত। সে কারণে ট্রাম্পের প্রার্থিতা সাড়ে পাঁচ বিলিয়নের স্থলে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল ডেমোক্র্যাটরা। এতে রাজি হননি ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং এর পাশাপাশি চলছিল ফেডারেল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাটডাউন। প্রায় দেড় মাস ধরে বেতন-ভাতা আটকে গিয়েছিল তাঁদেরও। সে কারণে জরুরি অবস্থা ঘোষণা দেওয়ার হুমকি দিয়ে যাচ্ছিলেন ট্রাম্প। কারণ একমাত্র জরুরি অবস্থার মধ্যেই প্রেসিডেন্ট তাঁর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ করতে পারেন। এর জন্য কংগ্রেসের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয় না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানতেন, প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া বিরোধী ডেমোক্র্যাটরা তাঁকে তাঁর কাঙ্ক্ষিত অর্থ বরাদ্দ দেবে না। তাই তিনি বারবার জরুরি অবস্থা ঘোষণার হুমকি দিয়েছেন। ২০১৬ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ট্রাম্প এ দেয়াল নির্মাণের অর্থ দাবি করেছিলেন মেক্সিকোর কাছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নিকট প্রতিবশী দেশ মেক্সিকো সে অর্থ জোগাতে অসম্মতি জানায়। কিন্তু ট্রাম্প তাতে হাল ছেড়ে দেননি। তিনি জানেন, এ ক্ষেত্রে তাঁর শেষ ভরসা জরুরি অবস্থা জারি করা। এবং শেষ পর্যন্ত সেটিই করেছেন তিনি। এটি যুক্তরাষ্ট্রে কোনো প্রেসিডেন্টের জারি করা ৩০তম জরুরি অবস্থা। ট্রাম্পের মতে, দেশের দক্ষিণ সীমান্তজুড়ে যে অরাজকতা বিরাজ করছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন ও স্বার্থের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সেখানে অর্থাৎ দক্ষিণ সীমান্তজুড়ে চলছে এক ব্যাপক অনুপ্রবেশ ও অবৈধ কার্যকলাপ, যা যুদ্ধাবস্থারই শামিল। সুতরাং একটি চরম বিতর্কিত দেয়াল নির্মাণ করার জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে তিনি এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তবে এটিকে জরুরি আইনের বরখেলাপ বলে অনেকে মনে করে।
ট্রাম্প ঘোষিত এ ধরনের জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নগরীর রাজনীতিসচেতন মানুষ। নিউ ইয়র্কে ট্রাম্প হোটেলের সামনে তাত্ক্ষণিকভাবে (গত শুক্রবার সন্ধ্যায়) সমবেত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছে বহু মানুষ। সে বিক্ষোভ এখন অন্যান্য নগরীতেও ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। ডেমোক্র্যাটরা দেয়াল নির্মাণের অভিপ্রায়ে এ জরুরি অবস্থা ঘোষণাকে ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একটি হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এটিকে যুক্তরাষ্ট্রে অবাধ গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ বলে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট উল্লেখ করেছে। এতে শুধু ডেমোক্র্যাটরাই নয়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলীয় অনেকেই প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা এ সাজানো জরুরি অবস্থাকে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার অপব্যবহার কিংবা স্বেচ্ছাচারিতা বলেও উল্লেখ করেছে। অনেকে বলেছে, এই মুহূর্তে দেশে এ ধরনের জরুরি আইন জারি করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। সে কারণে টেক্সাসের একটি পরিবেশবাদী আন্দোলনের নেতারা মামলা দায়ের করেছেন। তা ছাড়া ডেমোক্রেটিক দলের আইন প্রণেতা, বিভিন্ন রাজ্য ও উদারপন্থীরাও আইনগত ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত হচ্ছে বলে জানা গেছে। তদুপরি রিপাবলিকান দলীয় বিশিষ্ট সিনেটর রন জনসন (উইসকনসিন) দক্ষিণ সীমান্তের পরিস্থিতি জরুরি আইন জারি করার উপযোগী কি না, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে কংগ্রেস একটি প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে বলেও জানা গেছে। কারণ মেক্সিকো সীমান্তজুড়ে অপ্রয়োজনীয় ও পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ একটি বীভৎস দেয়াল নির্মাণের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এখন কংগ্রেসে আলোচনা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাই পার্টিশন রাজনীতিতে (কংগ্রেসে) বিরোধী ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে রিপাবলিকানরা (প্রয়োজনমতো) হাত মেলালে ট্রাম্পের জরুরি আইন ঘোষণা অকার্যকর কিংবা বাতিল হয়ে যেতে পারে। রিপাবলিকানদের ধারণা, ট্রাম্পের ভুল কিংবা পাগলামির কারণে আগামী সাধারণ নির্বাচনে (নভেম্বর ২০২০) তারা সিনেটে তাদের বর্তমান সংখ্যাগরিষ্ঠতাটুকুও (রিপাবলিকান ৫৩-ডেমোক্র্যাট ৪৫) হারিয়ে ফেলতে পারে। তা ছাড়া শুধু সিনেটে নয়, প্রতিনিধি পরিষদে আরো আসন হারাতে পারে। এতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দ্বিতীয় টার্মে বিজয়ী হলেও ঠুঁটো জগন্নাথের মতো কাল কাটাতে হবে।
কারণ তাঁর পক্ষে বারবার তো সব ব্যাপারে জরুরি আইন জারি করা সম্ভব হবে না। আর আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন—এর নিশ্চয়তা কোথায়?
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মাথার ওপর রবার্ট মুলারের বিশেষ কাউন্সিলের তদন্ত এখনো খোলা তলোয়ারের মতো ঝুলে রয়েছে। ২০১৬ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও রাশিয়ার সাইবার কারসাজির অভিযোগ কিংবা ট্রাম্পকে বিজয়ী করার ষড়যন্ত্র প্রমাণিত হলে প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসনের ব্যবস্থা নেবে। কিংবা সাংবিধানিক দিক থেকে আইনগতভাবেই প্রেসিডেন্টের পদ থেকে ট্রাম্পকে সরে যেতে হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিশংসনের ব্যাপারে প্রতিনিধি পরিষদের বিচার বিভাগীয় কমিটি এরই মধ্যে দুজন আইনজীবী নিয়োগ করেছে। তাঁরা এরই মধ্যে পূর্ণোদ্যমেই কাজ শুরু করেছেন। তা ছাড়া প্রতিনিধি পরিষদের বিচার বিভাগীয় কমিটির চেয়ারম্যান জেরি ন্যাডলার বিভিন্ন বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আরো আইনি ব্যবস্থা নিতেও প্রস্তুত হচ্ছেন বলে জানা গেছে। বিচার বিভাগীয় কমিটির আইনজীবীরা মুলারের তদন্ত প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিকও পর্যালোচনা করবেন। তাঁরা এখন অপেক্ষায় রয়েছেন মুলারের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য। তা ছাড়া নিউ ইয়র্কের সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্টের বিচার বিভাগীয় কমিটিও ট্রাম্পের ডাক ও তার সংক্রান্ত সংঘটিত অপরাধ, অর্থপাচার, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং গত নির্বাচনকালীন চক্রান্ত ও বিদেশি সূত্রে প্রাপ্ত নির্বাচনী তহবিলের ব্যাপারে তদন্ত করছে। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্প রবার্ট মুলারকে শেষ পর্যন্ত বিশেষ তদন্ত কাউন্সিল থেকে সরিয়ে দিলেও নিউ ইয়র্ক সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট তাদের আইনি তৎপরতা চালিয়ে যাবে বলে ঘোষণা করেছে। তারা তদন্তের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারের তহবিলের ওপর নির্ভর করে না। এ মুহূর্তে বিশেষ কাউন্সিলের তদন্ত শেষ করার জন্য রবার্ট মুলারের ওপর বিশেষ চাপ রয়েছে। নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হলে মুলার তদন্ত কাউন্সিলের অর্থ বরাদ্দও বাতিল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিসচেতন মানুষ, বিশেষ করে ট্রাম্পবিরোধীরা মুলারের প্রতিবেদনের অপেক্ষায় রয়েছে অধীর আগ্রহে। এরই মধ্যে হোয়াইট হাউস প্রকাশন থেকে একে একে পুরনো সবাই বিদায় নিয়েছেন। এখন তাঁদের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন ট্রাম্পের পছন্দের দক্ষিণপন্থী কর্মকর্তারা। তাঁদের অনেকেই পেশাদারির চেয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইচ্ছা বা রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে বরং অতিরিক্ত আগ্রহী। ট্রাম্প এখন দ্রুত চেষ্টা করছেন দক্ষিণ সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের জন্য তাঁর প্রস্তাবিত আট বিলিয়ন ডলার সরিয়ে আনতে। তিনি সামরিক খাতের বিভিন্ন বরাদ্দ কেটে এ অর্থ জোগাড় করতে চাচ্ছেন বলে জানা গেছে। সে অর্থের একটি অংশ বিগত বন্যার পর বিভিন্ন রাজ্যে পুনর্বাসনের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল, যার একটি অংশ এখনো অব্যবহৃত রয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
মেক্সিকো সীমান্তজুড়ে বিভিন্ন স্থানে দেয়াল নির্মাণের সিদ্ধান্তে অটল ট্রাম্পের জরুরি অবস্থা ঘোষণায় এখন বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠছে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ও বর্ণবাদীরা। দেশব্যাপী ছোট ছোট শহর ও গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী শ্বেতাঙ্গদের সংগঠিত করার জন্য আবার মাঠে নামছে ট্রাম্পের বিশেষ রাজনৈতিক টিম। তবে এত কিছুর পরও ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রবল ইচ্ছাশক্তি রাজনৈতিক মহলে এক বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। বিরোধী দল, বিশেষ করে ডেমোক্র্যাটদের এত প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও বিরোধিতার মুখেও ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনো ব্যাপারে মাথা হেঁট করার মতো নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্রমাগতভাবে বলে যাচ্ছেন, তিনি নাকি ভালো কাজ করছেন। তাঁর আমলে দেশের শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বেড়েছে আশাতীতভাবে। সে কথা আংশিক সত্য আর আংশিক হচ্ছে ট্রাম্পের দাবি। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় থেকেই ক্রমে ক্রমে মোটরশিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। কিন্তু বর্তমান চিত্র কিছুটা ভিন্ন। কারণ অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সূচকগুলো এখন কিছুটা নিম্নমুখী। এ ধারা থামাতে না পারলে বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো যুক্তরাষ্ট্রেও অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে। ট্রাম্প মুক্তবাজার কিংবা মুক্তবাণিজ্য, বহুমুখী আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য এবং প্রতিষ্ঠিত আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তিগুলো ভেঙে দিয়ে বিশ্ববাণিজ্যের সাম্প্রতিক ধারাকে এখন মন্থর গতির দিকে ঠেলে দিয়েছেন। তিনি কথায় কথায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে (ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন) সমালোচনা করেন অত্যন্ত একতরফাভাবে। তা ছাড়া পশ্চিমা প্রতিরক্ষা জোট ন্যাটোর প্রতি বিরূপ মনোভাব তাঁর এখনো কাটেনি। হেলসিংকি ও হামবুর্গে রুশ নেতা ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তাঁর রুদ্ধদ্বার গোপন বৈঠক পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্বে এক বিরূপ মনোভাব ও সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।
পশ্চিমা জগতে অনেকেই এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে রাশিয়ার এজেন্ট বলে ভাবতে দ্বিধা বোধ করে না। ক্রিমিয়া দখল ও ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধাবস্থাকে কখনো তীব্রভাবে সমালোচনা করেননি ট্রাম্প। অধিকন্তু উত্তর কোরিয়াকে সামাল দিতে অর্থাৎ কিম জং উনের পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারকে রোধ করতে রাশিয়াকে মুরব্বি ধরেছেন ট্রাম্প। অপরদিকে চীনের বিরুদ্ধে এক অঘোষিত বাণিজ্যযুদ্ধে গেলেও ট্রাম্প উত্তর কোরিয়াকে সামলাতে চীনের ওপরই ভরসা রাখছেন বেশি। তাঁর এই একলা চলার নীতিকে কোনোমতেই পছন্দ বা সমর্থন করছে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তিনি ইহুদিবাদী ইসরায়েলকে সমর্থন করতে গিয়ে ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন সংকট সৃষ্টি করেছেন। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ জেরুজালেমকে আগ্রাসনবাদী ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করা।
পশ্চিমাজগতের গণমাধ্যম এবং গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনীতিসচেতন মানুষ মনে করে, যেকোনো বৈধ পন্থায় হোক ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো অরাজনৈতিক, অসাধু, সাম্প্রদায়িক ও অনৈতিক ব্যক্তিকে মুক্তবিশ্বের নেতৃত্বদানকারী পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব থেকে সরানো উচিত। তাঁর ক্ষমতায় থাকা একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী কিংবা একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। প্রশ্ন উঠেছে, ট্রাম্প কিভাবে আমেরিকাকে আবার বিশ্বের এক নম্বর ও মহান করতে চান? যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির ভাষায়, ডোনাল্ড ট্রাম্প যা বলেন তার অর্থ নিজেই বোঝেন না। আমেরিকা (যুক্তরাষ্ট্র) আসলে কী, তা ট্রাম্প জানেন না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা যে আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে দেশটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ট্রাম্প তা থেকে অনেক দূরে।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক