তারেকের নির্দেশনাও মানছেন না বিএনপির নেতারা!

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: বিএনপির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া গতি পাচ্ছে না। বিএনপির হাইকমান্ড সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের সব কমিটি করার নির্দেশ দেন। কিন্তু নির্দেশনা কেউই মানছে না।

এছাড়া বিএনপির ‘এক নেতা এক পদ’ নীতিও বাস্তবায়ন হচ্ছে না পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে। অনেক নেতাকে এক পদ রেখে অন্য পদ ছেড়ে দিতে খালেদা জিয়া বেশ কয়েকবার কঠোর নির্দেশও দিয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও নির্দেশ দিয়েছেন। কোনো নির্দেশেই কাজ হচ্ছে না।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ১৯ সাংগঠনিক জেলার আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে। তাদের ৩ মাসের মেয়াদ শেষ।

কিন্তু বেশিরভাগ জেলার থানা-উপজেলায় কোনো কমিটিই হয়নি। যেখানে হয়েছে সেখানে নিজের অনুসারী ছাড়া অন্য কাউকে শীর্ষ পদ দেয়া হয়নি।

কৃষক দলসহ চার অঙ্গ সংগঠনেরও একই অবস্থা। আহ্বায়ক কমিটি ৩ মাসের মধ্যে কাউন্সিলও করতে পারেনি।

১৮ সেপ্টেম্বর কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১ মাস পার হলেও তারা এখনও কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি।

যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলে আরও হযবরল অবস্থা। মেয়াদোত্তীর্ণ এ দুই সংগঠনের কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে দলের হাইকমান্ড। কিন্তু কোন্দলের কারণে যুবদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে সন্দিহান নেতাকর্মীরা।

জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার কাজ চলছে। কোথাও কোনো অভিযোগ থাকলে তা দেখতে কেন্দ্রীয় নেতাদের নেতৃত্বে একাধিক টিম কাজ করছে। সবাইকে বুঝতে হবে, মামলা-হামলাসহ নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হচ্ছে। এ কারণে হয়তো কিছু কমিটির মেয়াদ ১০-১৫ দিন পার হয়েছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা কাউন্সিলের মাধ্যমে ছাত্রদল, ড্যাবের কমিটি করেছি। যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল পূর্ণাঙ্গ করার কাজ চলছে।

এছাড়া অন্যান্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি কাউন্সিলের মাধ্যমে করার প্রক্রিয়া চলছে।

নীতিনির্ধারকরা জানান, দল পুনর্গঠন নিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা ছিল- জেলায় ৩ মাসের জন্য প্রথমে আহ্বায়ক কমিটি করা। তারা ইউনিয়ন-থানাসহ সংশ্লিষ্ট জেলার সব পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে অথবা সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব বের করবেন।

সব শেষে জেলায় কাউন্সিল করে ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ক্ষেত্রেও প্রায় একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপির ৮২টি সাংগঠনিক জেলা কমিটির মধ্যে ১৯টির আহ্বায়ক কমিটি এবং ৯টির পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এর মধ্যে নীলফামারী, হবিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নওগাঁ, যশোর, বগুড়া, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, সৈয়দপুর, পাবনা, নাটোর, রাজশাহী জেলার ৩ মাসের মেয়াদ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে।

নেত্রকোনা, পঞ্চগড়, ঝিনাইদহ, মাগুরা জেলার মেয়াদও প্রায় শেষের দিকে। এসব জেলার নেতারা হাইকমান্ডের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করছেন না। বেশিরভাগ তৃণমূল নেতৃত্ব ভোটের মাধ্যমে করা হচ্ছে না।

যেসব জেলার নেতা থানা, পৌর বা উপজেলা কমিটি করেছেন তাতে তাদের নিজস্ব বলয়ের নেতাদের স্থান দিয়েছেন। বিগত দিনে আন্দোলন সংগ্রামে যারা ছিলেন তাদের মূল্যায়ন করেননি। আবার কয়েকটি জেলা আছে নেতাদের মেয়াদ শেষ হয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কার্যক্রমই শুরু করেননি।

১৭ অক্টোবর রাজশাহীর পুঠিয়া ও দুর্গাপুর উপজেলার ৪ ইউনিটেই কমিটি ঘোষণা করা হয়। রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদ ঘোষিত সব কমিটিতে স্থান পেয়েছে তার অনুসারীরাই।

এতে রাজশাহী-৫ (পুটিয়া-দুর্গাপুর) আসনের বিএনপির একটি অংশের মধ্যে ক্ষোভ এবং অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ মহাসচিবের কাছে লিখিত অভিযোগও করা হয়েছে।

রাজশাহী বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য নাদিম মোস্তাফা বলেন, সাজানো-গোছানো বিএনপিকে আওয়ামী লীগের হাতে তুলে দিতে ঘরে বসে এসব কমিটি দেয়া হয়েছে। বিগত দিনে যারা আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে ছিলেন তাদের বাদ দেয়া হয়েছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য আমাকে উচ্ছেদ করা। কিন্তু এতে দলের বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। মাদারীপুর জেলা কমিটি নিয়ে বিব্রত দলের হাইকমান্ড।

৩ মাসের মেয়াদের মধ্যে জেলার নেতারা তৃনমূলের কোনো কমিটি করতে পারেনি। মেয়াদ শেষ হওয়ার পর চলতি মাসে জেলার ৮ ইউনিটের কমিটি গঠন করেছে আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট জাফর আলী।

যেখানে তার অনুসারীরাই শুধু স্থান পেয়েছে। কমিটি করার ক্ষেত্রে তিনি সদস্য সচিব জাহান্দার আলী জাহানের স্বাক্ষর পর্যন্ত নেননি। যা নিয়ে কেন্দ্রে অভিযোগ গেলে ৮ ইউনিটের কমিটিই স্থগিত করা হয়।

জাহান্দার আলী জাহান জানান, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনা ছিল নিজ নিজ ইউনিটে গিয়ে কমিটি ভেঙে সঙ্গে সঙ্গে নতুন নেতা নির্বাচন করবেন। আলোচনার মাধ্যমে না হলে ভোটের মাধ্যমে করবেন। অথচ হাইকমান্ডের নির্দেশনা উপেক্ষা করে আহ্বায়ক নিজে এককভাবে কমিটি করতে গেলে স্থানীয় নেতাকর্মীরা বাধা দেন। পরে গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে সদস্য সচিব ছাড়া যুগ্ম আহ্বায়কের স্বাক্ষরে কমিটি ঘোষণা দেন তিনি। এমন ঘটনা এ প্রথম মাদারীপুরে দেখলাম।

তিনি আরও বলেন, আমার বিরুদ্ধে কেন্দ্রে অভিযোগ দিয়েছেন আমি নাকি কমিটি গঠনে বাধা দিয়েছে, গাড়ি ভাংচুরের সঙ্গে জড়িত। বহিষ্কারের জন্য বলেছেন। পরে ঘটনা তদন্ত করার জন্য কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সব কার্যক্রম বন্ধ থাকার কথা বলেছেন।

নির্বাচনের পরে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকদের তৃণমূল পুনর্গঠনে দায়িত্ব দেন তারেক রহমান। এসব দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের বিরুদ্ধেও এরই মধ্যে নানা অভিযোগ উঠেছে।

প্রভাবশালী নেতাদের পাশাপাশি বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগের জেলা ও মহানগর কমিটি গঠনে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে।

পরে সমস্যা সমাধানে বরিশালের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলুকে এবং ময়মনসিংহের দায়িত্বে যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে।

সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ম্যাডামের অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যেভাবে দলের হাল ধরেছেন এটা প্রশংসনীয়। তিনি সাহসের সঙ্গে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করছেন। সমস্যা যেটাই হোক সমাধানও হচ্ছে।

এদিকে বিএনপির গঠনতন্ত্রের ১৫ অনুচ্ছেদে থাকা ‘এক নেতা এক পদ’ নীতিও বাস্তবায়ন হচ্ছে না পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে। কেন্দ্রীয় পদে থেকে আবার জেলারও শীর্ষ পদে রয়েছেন অনেকে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দলের ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী একই সঙ্গে পটুয়াখালী জেলার সভাপতি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মশিউর রহমান ঝিনাইদহ জেলার আহ্বায়ক, যুগ্ম মহাসচিব মুজিবুর রহমান সরোয়ার বরিশাল মহানগর সভাপতি, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন নরসিংদী জেলার সভাপতি, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি, যুগ্ম আহ্বায়ক আসলাম চৌধুরী চট্টগ্রাম উত্তরের সভাপতি, সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জু খুলনা মহানগরের সভাপতি, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন গাজীপুরের সভাপতি।

এ ধরনের নেতাদের এক পদ রেখে অন্য পদ ছেড়ে দিতে খালেদা জিয়া বেশ কয়েকবার কঠোর নির্দেশও দিয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও নির্দেশ দিয়েছেন। কোনো নির্দেশেই কাজ হচ্ছে না।

যে কারণে জেলাগুলো পুনর্গঠনের কাজ শেষ করতে পারছে না দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।

সম্প্রতি গাজীপুর জেলা কমিটি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি মনির হোসেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে একটি চিঠি দিয়েছেন।

সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘পর্যায়ক্রমে ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কেন্দ্রীয় কমিটি মিলিয়ে ১৯৮৬ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ছাত্রদলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম।

এরপর আর কোনো কমিটিতে স্থান হয়নি। কোনো পদ-পদবি ছাড়া জুনিয়রদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কষ্টকর। আমাকে যে কোনো পদ্ধতিতে আটকাতে ফজলুল হক মিলন ভাই একাই বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, গাজীপুর জেলা সভাপতি, কালীগঞ্জ থানা বিএনপির সভাপতি পদে আছেন।

এছাড়াও কালীগঞ্জ পৌর বিএনপির কমিটি না থাকলেও পদাধিকার বলে তিনিই সভাপতি। কেন্দ্রীয় অথবা স্থানীয় কোথাও কাজ করার সুযোগ পাচ্ছি না।

আপনি ছাড়া আমার কোনো আশা নেই। কোনো দায়িত্ব দিলে ইমানি দায়িত্ব মনে করে করব- কথা দিলাম।’

অবশ্য ফজলুল হক মিলন বলেন, আমার বিরুদ্ধে যা বলা হয়েছে তা মিথ্যা।

এদিকে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর জন্য আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে বিএনপি। ৩ মাসের মধ্যে কাউন্সিল করে নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য চার সংগঠনকে নির্দেশনা দেয়া হলেও তা করতে পারেননি নেতারা।

অঙ্গ সংগঠনগুলো হল- কৃষক দল, তাঁতী দল, ওলামা দল ও মৎস্যজীবী দল। এ চারটি সংগঠনের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণে এখন আবার ‘পর্যবেক্ষণ কমিটি’ করেছে বিএনপি। পৃথকভাবে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে।

Advertisement