থু থু দিতেও ঘৃণা হয়!

ফারজানা ইসলাম লিনু

বাড়ির সামনে পুকুর, পারিবারিক গোরস্তান পেরিয়ে মাত্র কয়েক কদম পায়ে হেটে যেতে হয় মসজিদে। বাল্যকালে এই মসজিদেই শুরু হয়েছিলো আমাদের ধর্মীয় শিক্ষার প্রথম পাঠ।

অতিভোরে সূর্য উঠারও অনেক আগে শুরু হতো মসজিদের বিদ্যার্জন।
সকালে হুজুরের চা নাস্তা নিয়েই হাজির হতাম মসজিদে। জবানি (মুখস্থ) পড়া দিয়ে সবার আগেই ছুটি নিয়ে চলে আসতাম।

মসজিদের শিক্ষার্থীরা কেবল শিশু কিশোর ছিলো না। কিশোর বয়স পেরুনো কিছু ছেলে মেয়েও পড়তো তখন। মিয়াছাবের হাতের নানা সাইজের বেত। কোনটা লম্বা, কোনটা ছোট। সুরে বেসুরে চিৎকার করে পড়ার শব্দে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত। নির্ধারিত সময়ের পরে মসজিদে উপস্থিত হলে কিংবা শব্দের উচ্চতার ঘাটতি হলেই মিয়াছাবের বেত্রাঘাত।

নির্দয় হুজুরের বাধ ভাঙা অদম্য উল্লাসের সপাং সপাং বেত্রাঘাতের শব্দে সম্বিৎ ফিরে পায় অমনোযোগীরা। বেত চালনায় মিয়াছাবদের বিমলানন্দ চোখে পড়ার মতো।
গুরুজনরা সান্ত্বনা দিতেন,হুজুর যে জায়গায় মারবেন সেই জায়গাটা বিনা হিসাবে বেহেশতে যাবে। কিন্তু অন্যদের পিঠে মাইরের তীব্রতা দেখে বেহেশতের আশা বাদ দিয়ে ইহকালের পিঠ রক্ষার জন্য জান সপে পড়তাম। তাইতো রক্ষা। হুজুরদের প্রহারের হিংস্রতার শিকার হতে হয় নি কখনো। কিন্তু হুজুরদের বেতবাজিতে আমার তীব্র ক্ষোভ ছিল বরাবর।

বাড়িতে এসে হুজুরদের তিন বেলা খাবারের প্রথাও ছিলো তখন। রান্নাঘর থেকে বাহির বাড়ি পর্যন্ত ভাত তরকারি নিয়ে যাওয়াও ছিলো আমাদের কাজ। মসজিদে টিউবওয়েল ছিলো না। রোজার মাস আসলে ইফতার ও খাবার পানি দিয়ে আসতাম অতি আগ্রহ নিয়ে।

আমার শৈশব কৈশরের সেই মিয়াছাব এখনো বেঁচে আছেন। বাড়িতে গিয়েছি খবর পেলেই হয়েছে। দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে আমাদের দেখতে আসেন। সৌম্য দর্শন সাদা শুশ্রুমন্ডিত সেই হুজুর কে সবাই বলেন ক্বারি ছাব। প্রবল মমতায় এই বৃদ্ধ বয়সে আমাদের বাচ্চাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। গত হওয়া পিতামাতার জন্য হাত তুলে উচ্চ শব্দে দোয়া করেন আপনজনের মতো।

চাচাতো বোন আসমানী আপা, মিতা, জোছনা ও বাছিত মামা (সমবয়সী মামা, ছোট চাচি আম্মার ভাই) তখন ঘরে হুজুরের কাছে পড়তেন। সেই হুজুরের নাম ছিলো বাট্টি মিয়াছাব। অল্প বয়সী মাদ্রাসা পড়ুয়া সেই বাট্টি মিয়াছাব পরবর্তীতে ঝাড়ফুঁক দাওয়াইয়ে অনেক সুনাম কুড়িয়েছিলেন। মাঝে মাঝে আমিও বসতাম তাদের সাথে। কুরআন শিক্ষার পাশাপাশি দোয়া দুরুদ, আদব, কেতাব ও নামাজের শিক্ষা দিতেন বাট্টি মিয়াছাব। বাড়িতে প্রাইভেট পড়ানোর কারণে হউক আর স্বভাবের কারণেই বাট্টি মিয়াছাব বেত চালনায় অতোটা পারদর্শী ছিলেন না। বড় হওয়ার পর বাট্টি মিয়াছাবের সাথে কখনো দেখা হয়েছে, সালাম দিয়েছি। অবনত দৃষ্টিতে কুশলাদি জিজ্ঞেস করেছেন, শুভকামনা করেছেন।

আমাদের অঞ্চলের সবচেয়ে বর্ষিয়ান হুজুর ছিলেন ইসমাইল আলী মৌলভী। স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি বাচ্চাদের ধর্মীয় শিক্ষাও প্রদান করতেন। বয়সের ভারে ন্যুজ হলেও বয়স তাকে কাবু করতে পারেনি। স্বচ্ছ ধর্মীয় ও আধুনিক জ্ঞানের অধিকারী এই ভদ্রলোক আমাদের দাদাদের সমসাময়িক ছিলেন। অতি বৃদ্ধ বয়সে সোমা ও রিতাকে পড়ানোর দায়িত্ব পড়ে উনার উপর। হয়তো আম্মা বুঝেছিলেন মসজিদে পাঠালে সোমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বেশিরভাগই সময়ের আগে বেহেশতে চলে যাবে। একই অবস্থা রিতার ক্ষেত্রেও।

যদিও সপ্তাহের বেশিরভাগ দিনই পড় অজুহাত তৈরিতে সিদ্ধহস্ত এই দুই বিশিষ্ট জন ইসমাইল আলী মৌলভী সাহেবের অতি প্রিয় ছিলেন।
দন্তবিহীন মুখের অস্পষ্ট উচ্চারণে তিনি যা শিখিয়েছিলেন সোমা এখনো তা কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।

আমরা হয়তো সৌভাগ্যবান যে ক্বারিছাব, বাট্টি মিয়াছাব বা ইসমাইল আলী মৌলভী সাহেবের মতো মহৎপ্রাণ সৎ হুজুর পেয়েছিলাম। হুজুর বা মিয়াছাব সম্পর্কে কোন নেতিবাচক ধারণা আমাদের মনে জন্মেনি মনে হয় সে কারণে।
পর পর দুই কন্যা সন্তানের জন্মের পর কন্যা শিশুর সুরক্ষার বিষয়টা আপনা আপনি গোচরে আসে। বিভিন্ন ঘটনার পর্যালোচনায় দেখা যায় হুজুর, শিক্ষক ও আপনজনের কাছেই শিশুরা নিগৃহিত হয় বেশি। হয়তো আগেও শিশুরা থাবার নিচে ছিলো। লজ্জা ও সচেতনতার কারণে প্রকাশ হয়নি সেভাবে।

কন্যা সন্তানের মা হিসেবে নড়েচড়ে বসি আমি। গৃহ শিক্ষকের দরকার না পড়লেও হুজুরেরতো দরকার পড়ে। চোখের সামনে বাচ্চাদের ধর্মীয় শিক্ষাদানের জায়গা নির্ধারন করলেও মনের খুঁতখুঁতানি যায় না। দীর্ঘ পনেরো বছর থেকে একই হুজুর আমার সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। বেত প্রদর্শনের কারণে আমার মেঝো কন্যা এই হুজুরের কাছে পড়তে অস্বীকৃতি জানায়। বড় জনকে এক দিন হালকা বেতের বাড়ি দিলে আমি নিষেধ করি।

হুজুর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলেও মিতুলকে আর বসানো যায়নি। অন্য হুজুরকে দিয়ে তার ধর্মীয় পাঠ কোনমতে সম্পন্ন করি।

কেবল মেয়ে শিশু না ছেলে শিশুর নিরাপত্তা নিয়েও আমরা উদ্বিগ্ন। তাইতো ছেলেকে হুজুরের কাছে পড়াতে বসালেও আমাদের দৃষ্টি সজাগ থাকে।

প্রতিবছর রোজায় মসজিদের হুজুর বা মুয়াজ্জিন কেউ একজনের খাবারের ভার পড়ে আমাদের বাসায়। কখনো হুজুররা নিজে এসে কখনো টিফিন পাঠিয়ে খাবার নিয়ে যান।
অনেক বছর আগে এক নিকটাত্মীয়ের বাসায় কাজের মেয়ের সাথে হুজুরের অসাদাচরণের এক গল্প শুনে হুজুরদের ঘরে বসিয়ে খাওয়ার ব্যাপারটা আমি মেনে নিতে পারি না। হুজুর এসে টিফিনে করে খাবার নিয়ে যান। রোজাও শেষ, হুজুরের খাওয়া দাওয়ার মেয়াদও শেষ। কিছুদিন পর কর্তার কাছে খবর পেলাম সেই হুজুরের হাতে মসজিদে পড়তে ছোট ছোট ছেলেরা যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছে। বিকৃত রুচির এই লোকটাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আগেই চোরের মতো পালিয়ে যায়।

পরের বছর নতুন মোয়াজ্জিন আসেন খাবার নিতে। পর পর তিন বার রোজায় এই ভদ্রলোক আমাদের সাথে রোজার খাবার গ্রহণ করেন। শেষ দিন হাত কচলে, লাজুক ভঙ্গিতে আমার ও মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যান। মাসব্যাপী ভুল ত্রুটির জন্য করজোড়ে ক্ষমা চান। যদিও আমরা বউ শ্বাশুড়ির মাথায় আসেনা এক মাস অন্নগ্রহণ করে ইনি কিইবা ভুল করতে পারেন।

এইার রোজায় টিফিন হাতে নতুন হুজুরের আগমন ঘটে। পুত্র কন্যার বাবার কাছ থেকে নবাগত হুজুরের আগমন হেতু জানতে পারলাম। একই কেস। কোন বাসায় বাচ্চা পড়াতে গিয়ে ছোট শিশুর উপর নিজের কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন। প্রাণ বাঁচাতে রাতের আধারে পালিয়ে গিয়েছেন। নাউজুবিল্লাহ, এই শয়তানের শয়তান আবার অন্য কোথাও গিয়ে কোন শিশুর সর্বনাশে তার লালসার হাত না বাড়িয়ে দেয়।

গোমট ভ্যাপসা গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। রহমতের বৃষ্টিতেও শান্তি নেই। মনের অশান্তিতে গরমের তাপ বেড়ে যায়। মানুষরূপী পশুদের কৃতকর্মে লজ্জিত হই ভাষা হারিয়ে ফেলি। মসজিদ, মাদ্রাসাকে অপবিত্র করে চলছে লালসা চরিতার্থ।

মাদ্রাসার হুজুর, শিক্ষক কারো কাছে আমার আপনার সন্তানের নিরাপত্তা নেই। মানুষগুলো দিনকে দিন পশুকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। লজ্জায় অপমানে মনে হয় অন্ধকার গর্তে লুকাই গিয়ে। মাতৃজঠরে বেড়ে উঠা কন্যা শিশুকে পৃথিবীর আলোতে না এনে অন্ধকার জঠরে রেখে দেই আজন্ম।

এই অনাচার ও নিগ্রহের শেষ কোথায় জানিনা। সামাজিক প্রতিরোধের পাশাপাশি ধর্ষকদের কঠিন শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি নেই। পশুর চেয়ে অধম লোকগুলোর মুখের থু থু দিয়ে ঘৃনা জানাতেও রুচিতে বাধে।

ফারজানা ইসলাম লিনু ,শিক্ষক ও গল্পকার

Advertisement