দেশের স্বাস্থ্য সেবার কেন এত বেহাল দশা?

                                ।। ডা. ওয়াজেদ খান।।

মরণ কামড় না দিতেই করোনা মোকাবেলায় হাঁপিয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। হিমশিম খাচ্ছে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ। এর ফাঁকে দৃশ্যমান হচ্ছে দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থার আসল চিত্র। যা অত্যন্ত নাজুক ও অন্তঃসারশূন্য। করোনার আক্রমণ রুখে দিতে শতভাগ প্রস্তুত। কিংবা করোনার চেয়েও নিজেদেরকে শক্তিশালী বলে দম্ভ করেছেন যারা। আজ তারা চুপসে গেছেন বেলুনের মতো। করোনার বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নিতে গিয়েই ভেঙ্গে পড়েছে গোটা চিকিৎসা ব্যবস্থা।

সামাল দেয়া যাচ্ছে না রোগীদের। সর্বত্র স্পষ্ট হয়ে উঠছে জাতীয় স্বাস্থ্য সেবার করুণ অবস্থা। কেন এই বেহাল দশা স্বাস্থ্য খাতে? জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে এমন হাজারো প্রশ্ন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকার যত আশার বাণীই শুনাক না কেন, দেশের মানুষ আজ মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। অনিরাপদ ও অরক্ষিত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন উৎকণ্ঠিত। একদিকে বৈশ্বিক মহামারী করোনার ভয়াল ছোবল। অপর দিকে লকডাউনে স্থবির অনিশ্চিত জীবন জীবিকা। চিকিৎসার অন্বেষায় এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটছে মানুষ। খুঁজছে নির্ঝঞ্ঝাট নিরাপদ আশ্রয়।
স্বাস্থ্য মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের অন্যতম। জাতীয় উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যবান একটি জনগোষ্ঠী। কেউ শারীরিকভাবে নিরোগ হলেই তাকে স্বাস্থ্যবান বলা যাবে না। স্বাস্থ্যবান তাকেই বলা যাবে যিনি শারীরিক, মানুষিক ও সামাজিকভাবে ভালো বোধ করেন। আর্থ সামাজিক উন্নয়নের ফলে দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। এক শ্রেণীর মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতিও হয়েছে অনেকটা।

কিন্তু জনস্বাস্থ্য বা পাবলিক হেলথের সার্বিক উন্নয়ন বলতে যা বুঝায় তা থেকে দেশ অনেক দূর পিছিয়ে। এখনো অপুষ্টিতে ভুগছে সিংহভাগ মানুষ। চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত বিরাট জনগোষ্ঠী। এর মাঝে আঘাত হেনেছে ঘাতক ব্যাধি করোনা। দেশজুড়ে মৃত্যু ও আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন। অনেক উন্নত দেশের তুলনায় এই মুহূর্তে মৃত্যু হার কম। তবে সময়মতো সাবধান ও সতর্ক না হলে ঘটতে পারে ব্যাপক প্রাণহানি। করোনা মহামারী আকার ধারণ করলে কীভাবে সামাল দেবে সরকার। কোথায় সেই প্রস্তুতি। এ নিয়ে সংশয় ও অস্বস্তিতে আছে দেশবাসী। দেশে হাসপাতাল আছে। নেই সুচিকিৎসার নিশ্চয়তা। বন্যার সময় চারদিকে পানি থৈ থৈ করে। অথচ পান করার মতো পানি যেমন মেলে না, ঠিক তেমনি দেশজুড়ে হাসপাতাল থাকলেও মিলছে না চিকিৎসা।

সরকারি, বেসরকারি, ছোট-বড় মিলিয়ে দেশে হাসপাতাল আছে প্রায় ৬ হাজার। কিন্তু এসব হাসপাতালে নেই করোনা চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট। ব্যবস্থা নেই ভেন্টিলেটর ও সার্বক্ষণিক অক্সিজেন সরবরাহের। অভাব রয়েছে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর। তারপরও যারা হাসপাতালগুলোতে কাজ করছেন তাদের সুরক্ষায় নেই পর্যাপ্ত পিপিই। প্রাথমিক পর্যায়ে হাসপাতালে সরবরাহকৃত এন-৯৫ মাস্কগুলো ছিল নকল। ফলে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মাঝে বেড়ে যায় আক্রান্তের সংখ্যা। ইতোমধ্যে আক্রান্ত সাড়ে পাঁচ’শ চিকিৎসকের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন দু’জন। এসব নিয়ে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও তাদের পরিবারে বিরাজ করছে চরম আতঙ্ক। করোনা পরীক্ষার জন্য নেই পর্যাপ্ত কীট ও লোকবল। করোনা চিকিৎসা কোন কোন হাসপাতালে হবে তা নিয়ে চলছে তেলেসমাতি। একারণে সাধারণ রোগীরাও শিকার হচ্ছেন ভোগান্তির। বঞ্চিত হচ্ছেন নিয়মিত চিকিৎসা সেবা থেকে। আর যেসব হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে সেখানে সমস্যার অন্ত নেই।

দেশের ৬৪টি জেলার ৪৭টিতেই নাকি নেই কোনো ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট বা আইসিইউ। ভেন্টিলেটরতো পরের কথা। কোনো হাসপাতালে আইসিইউ এবং ভেন্টিলেটর থাকলেও নেই তা ব্যবহার করার মতো প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী। এসব কারণেই জীবন দিতে হয়েছে সিলেট মেডিকেল কলেজের ডা. মঈন উদ্দীনকে। বৃহত্তর সিলেটে দু’টি আইসিইউ ও ভেন্টিলেটরের সব ক’টিই অকার্যকর থাকায় তাকে চিকিৎসা দেয়া যায়নি সেখানে।

করোনা চিকিৎসায় হাত দিয়ে সবকিছু গুলিয়ে ফেলেছে সরকার। স্বাস্থ্যখাতে লাগামহীন দুর্নীতি-অনিয়ম ও নৈরাজ্য চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এটা নতুন কিছু নয়। করোনাকালে এর চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে মাত্র।

স্বাস্থ্য সেবা খাতে বেহাল দশার নেপথ্যে-

১. স্বাস্থ্য নীতিমালার অভাব: যুগপোযুগী, সার্বজনীন ও সুষম স্বাস্থ্য নীতিমালার অভাবে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা। রাষ্ট্রপতি, সরকারের মন্ত্রী, বিত্তবান রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, অমলা সবাই চিকিৎসা সেবা নেন বিদেশে। নিজ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর বিশ্বাস, ভক্তি বা আস্থা কোনটিই নেই তাদের। শরীর ঠিকমতো চলছে কিনা তা পরখ করাতে তারা বছরে বারকয়েক দৌড়ান বিদেশে। দেশের বড় হাসপাতালগুলোতেও তাদের জন্য রয়েছে বিশেষ চিকিৎসা ব্যবস্থা। ভিআইপি, ভিভিআইপি কেবিন। প্রয়োজনে প্রস্তুত থাকে এয়ার এম্বুলেন্স। বৈষম্যমূলক এ চিকিৎসা ব্যবস্থা দেশের সংবিধান পরিপন্থী। ‘স্বাস্থ্য সকল সুখের মূল’ আর ‘স্বাস্থ্যই যখন সম্পদ’- তখন কেন তারা এই অমূল্য সম্পদ বিনষ্ট করবেন দেশের মাটিতে। তাদের বিলাসী এবং অদেশপ্রেমিক মনোভাবের কারণে অবহেলিত থেকে গেছে স্বাস্থ্যখাত। তাই অদ্যাবধি প্রণীত হয়নি কোনো নীতিমালা। তবে করোনা মৌসুমে এসে ফেঁসে গেছেন ভিআইপিরা। বন্ধ হয়ে গেছে তাদের সিঙ্গাপুরমুখী হওয়া। এতে প্রথমবারের মতো টনক নড়েছে তাদের।

২. স্বাস্থ্যখাতে বাজেট: স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাবরই ছিল অপ্রতুল। এখনো জিডিপির মাত্র ২.৩৭ শতাংশ বরাদ্দ স্বাস্থ্য সেবার জন্য। ভারতে ৩.৬ শতাংশ। মালদ্বীপে ৯.৫ শতাংশ। আর যুক্তরাষ্ট্রে ১৮ শতাংশ। এমনকি পাকিস্তান জিডিপির ৩ শতাংশ ব্যয় করে স্বাস্থ্য খাতে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে মাথাপিছু ব্যয়ের পরিমাণ এখনো ৩৫ ডলার। অথাৎ ৩ হাজার টাকা। যুক্তরাষ্ট্রে এর পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় সাড়ে ৯ লাখ টাকার মতো। তারপরও বাংলাদেশের অনেক মন্ত্রী কটাক্ষ করেন যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে।

৩. নিম্নমানের চিকিৎসা সেবা: দেশে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও মেডিকেল কলেজ বেড়েছে। কিন্তু গুনগত মানে পরিবর্তন আসেনি চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে। ১০ হাজার মানুষের জন্য হাসপাতাল বেড বরাদ্দ আছে ৩ টি এবং চিকিৎসক আছেন ৩ দশমিক ০৫ জন। আর নার্স আছেন ১ দশমিক ৮ জন। একটি স্বাস্থ্যবান জনগোষ্ঠীর জন্য এ পরিসংখ্যান হতাশাজনক। দেশে শতাধিক মেডিকেল কলেজের মধ্যে ৬৩টিই বেসরকারি। কয়েকটি বাদে এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার নূন্যতম কোনো মান ও পরিবেশ নেই। এসব নিয়ন্ত্রণে রাখতে কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের।

৪. স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি-অনিয়ম: দুর্নীতি-অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মন্ত্রণালয় ও সরকারি হাসপাতালগুলোতে ঘুষ, দুর্নীতি এখন ওপেন সিক্রেট। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পদোন্নতি, বদলী। ঠিকাদারি, বেসরকারি হাসপাতাল- ক্লিনিকের অনুমোদন কোন কিছুই হয়না ঘুষ ছাড়া।

৫. চিকিৎসা ক্ষেত্রে দলবাজি: দেশের সরকারি হাসপাতাল, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো ক্ষমতাসীন দলীয় চিকিৎসকদের হাতে জিম্মি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে এদের রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দলের চিকিৎসকরা নিয়ন্ত্রণ করে চিকিৎসকদের পদোন্নতি, বদলীসহ সবকিছু। স্বাস্থ্য বিভাগের সকল প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে আসীন হন সরকার দলীয় চিকিৎসকরা। আর যোগ্য মেধাবীরা হন নানাভাবে কোনঠাসা। হাসপাতালে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের চিকিৎসকরা সব মার্কা মারা। হাসপাতাল বেড, চিকিৎসা সেবাও অনেক সময় নির্ধারিত হয় দলীয় বিবেচনায়। দলবাজির আত্মঘাতি বিস্তৃতি তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের মধ্যেও ঘটেছে। চিকিৎসকদের স্বার্থ দেখার জন্য রয়েছে তাঁদের প্রতিষ্ঠিত পেশাজীবী সংগঠন মেডিকেল এসোসিয়েশন। তারপরও হাসপাতালকে তারা বানিয়েছেন রাজনীতির ময়দান। নিরাপদ বাণিজ্য কেন্দ্র। হাসপাতালে চিকিৎসকদের দলীয় রাজনীতির এমন নজির বিশ্বের কোথাও নেই। করোনা মহামারী ঠেকাতে এখনো পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই হাসপাতালগুলোতে। প্রতিদিন বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। শহর, বন্দর, গ্রামে মানুষ মরছে সুচিকিৎসার অভাবে। চৌকাঠে লাশ ফেলে পালাচ্ছে স্বজন। কি অদ্ভুত আচরণ সমাজ সংসারে। সবাই গ্যারান্টি চায় বেঁচে থাকার। চারদিকে অস্থিরতা, অজানা আতঙ্ক। তারপরও আত্মসন্তুষ্টির ঢেঁকুর তুলছেন সরকারী কর্মকর্তারা। এজন্যই বলে পাগলের সুখ নাকি মনে মনে।

লেখক: ডা: ওয়াজেদ খান, সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, নিউইয়র্ক।

Advertisement