ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। গঠিত হচ্ছে নতুন নতুন জোট। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতার মধ্যে রয়েছে বিরাট ফারাক। এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজের তিন কিস্তির লেখার শেষ কিস্তি ছাপা হলো আজ। লিখেছেন আলী রীয়াজ
আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলো এখন কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, ১৪ জোটের শরিকেরা ও জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। অন্যদিকে অন্যান্য বিরোধী দল, যারা প্রধানত বিভিন্ন জোটে বিভক্ত, কিন্তু সবাই জোটভুক্ত নয়। এতে আছে কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বাম গণতান্ত্রিক জোট। আছে বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলন ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল।
এক অর্থে এই অবস্থা ২০১৩ সালের পুনরাবৃত্তি। ১৯৯১ সাল-পরবর্তী রাজনীতির অভিজ্ঞতা থেকে সাধারণভাবে দুটি সম্ভাবনার কথা আমরা বিবেচনা করতে পারি; কিন্তু ১৯৯১ পূর্ববর্তী নির্বাচনের কথাও মনে রাখতে হবে। ফলে তিনটি সম্ভাবনা বিবেচিত হতে পারে। প্রথম হচ্ছে একতরফা নির্বাচন-উদাহরণ ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। তবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের হুবহু পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা এখন নেই। এ ক্ষেত্রে মূল বিষয়টি হচ্ছে বিরোধী দলগুলোকে বাদ দিয়ে নির্বাচন। দ্বিতীয় সম্ভাবনা হচ্ছে শেষ মুহূর্তে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।
তৃতীয় মডেলটি সেনাশাসনের আমলের-১৯৮৮ সালের নির্বাচন। ওই নির্বাচন প্রধান বিরোধী দলগুলো বর্জন করলেও সরকারি প্রণোদনায় একটি জোট অংশগ্রহণ করে। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে এই ধরনের ‘বিরোধী’ দল হিসেবে জাতীয় পার্টিকে উপস্থাপনের কথা প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু গত চার বছর ক্ষমতার সুবিধাভোগী জাতীয় পার্টি, এমনকি যদি তারা একটি জোট হিসেবেও অংশ নেয়, তবে তা গ্রহণযোগ্য বিরোধী দল হবে না। ১৯৮৮ সালের বিরোধী জোটও বিরোধী দল হিসেবে বিবেচিত হয়নি। কিন্তু এখন রাজনীতিতে যে পরিবর্তন ঘটেছে, তাতে মূলধারার রাজনীতির বাইরের ‘সামাজিক শক্তি’ বলে পরিচিত ইসলামপন্থীদের একাংশকে এই ভূমিকায় দেখার সম্ভাবনা আছে। হেফাজতে ইসলাম সাংগঠনিকভাবে নির্বাচনের রাজনীতিতে অংশ না নিলেও ওই জোটের ভেতরে থাকা দলগুলোর এই ধরনের আগ্রহ এখন সুবিদিত। তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘সমঝোতা’ করতে চাইছে বলেও খবর বেরিয়েছে।
এ রকম পরিস্থিতিতে নির্বাচন পর্যন্ত রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ কী খাতে বইতে পারে? গত কয়েক সপ্তাহের রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ এবং রাজনৈতিক শক্তিগুলোর
অবস্থান বিবেচনা করলে পাঁচটি সম্ভাব্য দৃশ্যকল্প বা সিনারিও দেখা যায়।
প্রথম দৃশ্যকল্প হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলসহ সব রাজনৈতিক দলের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অচলাবস্থা ও সংকট কাটিয়ে সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিএনপির সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা বারবার নাকচ করেছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ের পরে সেই সম্ভাবনা স্থায়ীভাবেই তিরোহিত হয়েছে। কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর প্রাথমিক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া এই জোটের সঙ্গে আলোচনার যে সম্ভাব্যতার ইঙ্গিত দিচ্ছিল, তা প্রধানমন্ত্রীর পরবর্তী মন্তব্যে অপসৃত হয়েছে। এই দৃশ্যকল্পের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। একে আমরা দুর্ঘট (আনলাইকলি) দৃশ্যকল্প বলে চিহ্নিত করতে পারি।
দ্বিতীয় দৃশ্যকল্প হচ্ছে নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের আন্দোলনের চেষ্টা। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরে এবং বিশেষত এটা সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরে যে বিরোধী দলের কোনো দাবির প্রতিই ভ্রুক্ষেপ না করে ক্ষমতাসীনেরা নির্বাচন অনুষ্ঠানে দৃঢ় সংকল্প, সেই সময়ে বিরোধী দলের মধ্যে আন্দোলনের প্রবণতা তৈরি হতে পারে। কেননা বিরোধী দলগুলো মনে করে যে বিরাজমান ব্যবস্থার কোনো রকম পরিবর্তন না হলে নির্বাচন কেবল আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হবে। বিরোধী দল ও জোটগুলোকে এই ধরনের পরিস্থিতিতে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা সরকারের পক্ষ থেকেই করা হতে পারে। কেননা, এতে ক্ষমতাসীনেরা বলতে পারবে যে বিরোধীরা, বিশেষত বিএনপি নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহীই ছিল না এবং তারাই ‘সন্ত্রাসের পথ’ বেছে নিয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৫ সালের যে ধরনের কার্যক্রমের জন্য বিএনপিকে দোষারোপ করা হয়, তা তখন নির্বাচন বর্জনকারী সবার জন্যই ব্যবহার করা যাবে। তদুপরি, এই পরিস্থিতিতে সরকার আরও বেশি নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম হবে এবং তার যৌক্তিকতা হিসেবে আন্দোলনকারীদের আচরণকে ব্যবহার করবে। ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ ও ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’ দমনে সাফল্যের কারণে সরকারের এই বিষয়ে নিজেদের ওপরে আস্থা আগের চেয়ে অনেক বেশি বলেই অনুমেয়।
তৃতীয় দৃশ্যকল্প হচ্ছে বিরোধী দল ও জোটগুলো যদি একটি অভিন্ন জোটে সমবেত হতে পারে বা বিভিন্ন অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও নিজেদের মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতা তৈরি করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়, মালদ্বীপ ও মালয়েশিয়ার সাম্প্রতিক নির্বাচনে এই ধরনের উদাহরণ তৈরি হয়েছে, সে ক্ষেত্রে সরকার প্রশাসনকে ব্যবহার করে গায়েবি মামলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের নিবর্তনমূলক ব্যবস্থার মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে, গণমাধ্যমের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে পারে, সামাজিক মাধ্যমে নজরদারির পাশাপাশি অন্যদের বিরুদ্ধে প্রচারণা জোরদার করতে পারে। এই সময়ে এমন ব্যবস্থা নেওয়াও স্বাভাবিক, যাকে অরুন্ধতী রায় ‘সহিংসতার আউটসোর্সিং’ বলে বর্ণনা করেছেন। সম্প্রতি জারি হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ফলে এই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের আইনি পথ ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে।
চতুর্থ দৃশ্যকল্প হচ্ছে বিরোধীরা বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে কিংবা আন্দোলনের চেষ্টায় ব্যর্থতার কারণে নির্বাচনে আশানুরূপ ফলাফল লাভে ব্যর্থতা। সেই অবস্থায় নির্বাচনের পরে তাদের ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ই মেনে নিতে হবে। ক্ষমতাসীন দল যতটুকু জায়গা ছেড়ে দেবে, তার বাইরে রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যম বা সিভিল সোসাইটির সদস্যদের প্রত্যাশার বা দাবি তোলার সুযোগ থাকবে না। তবে প্রাসঙ্গিকভাবে বলা দরকার যে এই ধরনের পরিস্থিতি বাংলাদেশের রাজনীতিকে অপরিবর্তনীয়ভাবে বদলে দেবে; এখনকার রাজনৈতিক শক্তির অনেকেই ‘অস্তিত্বের সংকটে’ পড়লে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।
পঞ্চম দৃশ্যকল্প হচ্ছে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে, তার অবসান এবং সাংগঠনিক ঐক্য প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে অপসৃত হওয়া। এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বিভিন্ন কারণে-হতে পারে অভ্যন্তরীণ কলহ বা ভুল-বোঝাবুঝির ফলে, হতে পারে সরকারের পক্ষ থেকে ভাঙনের চেষ্টার কারণে। এই রকম পরিস্থিতিতে আলাদা করে কোনো কোনো দল বা ব্যক্তি হয়তো ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে সুবিধা এবং রাজনৈতিক সুবিধা নিতে সক্ষম হবেন, কিন্তু এর চূড়ান্ত ফল চতুর্থ দৃশ্যকল্পের চেয়ে ভিন্ন কিছু হবে না।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান কোনো নির্ভুল বিজ্ঞান নয়, রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহও সরল পথে অগ্রসর হয় না। ফলে অস্থির সময়ে রাজনীতির যেকোনো দৃশ্যকল্পকে ভবিষ্যদ্বাণী বা প্রেডিকশন বলে মনে করা সমীচীন নয়। ঘটনাধারা ও ক্রীড়নকদের ভূমিকা যেকোনো কিছুকেই বদলে দিতে পারে। যেমন ক্ষমতাসীন দল চাইলে ঘটনাধারাকে ভিন্নভাবে প্রবাহিত করতে পারে, তেমনি পারেন সাধারণ নাগরিকেরা। তা সত্ত্বেও বিরাজমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই এই দৃশ্যকল্পগুলো তৈরি করা হয়েছে। এখানে কিছু বিষয় বিবেচনার বাইরে রাখা হয়েছে, তা হচ্ছে অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহের সম্ভাব্য প্রভাব এবং বিদেশি শক্তি, বিশেষত ভারতের ভূমিকা। পাঠকেরা প্রতিটি দৃশ্যকল্পে ভারতের ভূমিকা কী হতে পারে, সেটা নিজেরাও ভেবে দেখতে পারেন।