ড. সা’দত হুসাইন ::
যখন কোনো বিষয়ে দুটি বিবদমান পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী বক্তব্য পেশ করে, তখন সাধারণ শ্রোতার পক্ষে বুঝে ওঠা দুঃসাধ্য হয় যে কোন বক্তব্যটি সত্য। এরূপ কিছু বিষয়ে বছরের পর বছর তর্ক-বিতর্ক চলছে, কিন্তু এর কোনো সুরাহা হয়নি। সত্য নির্ধারণের জন্য উভয় পক্ষের সম্মত বিচারক পাওয়া যায়নি। যাবে বলে মনে হয় না। সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করতে বললে উভয় পক্ষ ঝাঁকে ঝাঁকে সাক্ষী ও গাদা গাদা নথিপত্র নিয়ে হাজির হবে। এর থেকেও সন্দেহাতীতভাবে নির্ণয় করা যাবে না কোন বক্তব্যটি সত্য। বিচারক দুই বক্তব্যের নির্যাস থেকে বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধান করে দেখতে পারেন মাঝামাঝি পর্যায়ে প্রকৃত সত্যের কোনো যৌগিক উপাদান পাওয়া যায় কি না।
বাংলাদেশে ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ব্যাপারে পক্ষ-প্রতিপক্ষ পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান। পক্ষে রয়েছে শাসকদলের নেতৃত্বাধীন বিজয়ী মহাজোট। বিপক্ষে রয়েছে ডান-বাম-মধ্যপন্থী (Right, Left, Center) পরাজিত দলগুলো। মহাজোটের সমর্থকরা সমস্বরে বলছে, নির্বাচন ভালো হয়েছে। গণরায় বিপুলভাবে মহাজোটের প্রার্থীদের পক্ষে এসেছে। ভোটাররা মহাজোটের শাসনের প্রতি তাদের অবিচল আস্থা প্রকাশ করেছে। বিরোধী দল ও ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের তারা প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন মহাজোট সরকার জনগণের নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট নিয়ে দেশ শাসন করবে। তারা হচ্ছে প্রকৃতই জনগণের সরকার। অন্যদিকে বিরোধী (এবং পরাজিত) তিন ক্যাম্প (Right, Left, Center) সমস্বরে বলছে, দেশের ইতিহাসে এরূপ কলঙ্কজনক নির্বাচন এর আগে আর কখনো অনুষ্ঠিত হয়নি। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী এ নির্বাচন ছিল অনিয়ম, শক্তি প্রয়োগ, কারচুপি, কারসাজিতে ভরা। প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহায়তায় প্রতিপক্ষ বিরোধী দলকে অবদমিত করা হয়েছে। তাদের প্রার্থী ও নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যারা বাইরে ছিল, তাদের মারাত্মকভাবে আহত করা হয়েছে, তাদের বাড়ি-গাড়ি ভাঙা হয়েছে, এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে তাদের এলাকাছাড়া করা হয়েছে। এ সুযোগে নির্বাচনের আগের রাতে পোলিং বুথ থেকে কেড়ে নেওয়া ব্যালট পেপারে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়েছে। তাদের এজেন্ট ও সমর্থক ভোটারদের শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কেন্দ্র বা বুথ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সব কিছু মিলে বিরোধী প্রার্থীদের পক্ষে ভোট পাওয়ার সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
তর্ক-বিতর্ক থেকে স্পষ্টভাবে বোঝার উপায় নেই যে কোন পক্ষের বক্তব্য সত্য। তবে ধারণা করা যায়, সত্য হয়তো বা এর মাঝামাঝি কোথাও কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে। যুক্তিবাদী বোদ্ধারা মনে করেন, প্রগাঢ় (Rigorous) গবেষণার মাধ্যমে প্রকৃত সত্য তথা বাস্তব অবস্থার কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে গণিত, পরিসংখ্যান, যুক্তিবিদ্যা, জনপ্রশাসন, মনোবিজ্ঞান, অপরাধতত্ত্ব ইত্যাদি একাডেমিক বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে অনুসন্ধান চালাতে হবে। নির্বাচনসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য এবং নির্বাচনের ফলাফল তীক্ষভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে অনেক কিছু জানা যাবে। কোনো বক্তব্য বা উপস্থাপিত তথ্য যদি গাণিতিক বা পরিসংখ্যানভিত্তিক তত্ত্বের সম্পূর্ণ পরিপন্থী হয়, তাহলে তাকে সন্দেহজনক বিবেচনা করতে হবে। যদি অন্যান্য একাডেমিক স্বতঃসিদ্ধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে সব তত্ত্বের সংযোগে তাকে অগ্রহণযোগ্য বক্তব্য বা তথ্য হিসেবে পরিগণিত করা যেতে পারে।
নির্বাচনসংক্রান্ত গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা রয়েছে। নির্বাচনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা ও বিষয়ের রেকর্ড সংরক্ষণ করার প্রথা দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসছে। বর্তমানে এটি কালোত্তীর্ণ রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ভোটারসংখ্যা, প্রতিটি নির্বাচনী এলাকা সম্পৃক্ত তথ্যাদি, প্রার্থীসংক্রান্ত তথ্যাদি, ভোট ব্যবস্থাপনার যাবতীয় তথ্য, ভোটদাতাদের সংখ্যা (শতকরা হারসহ), বিভিন্ন প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ইত্যাদি তথ্য নির্বাচন কমিশন ও তার মাঠ প্রশাসন থেকে সহজেই জানা যায়। এসব তথ্য সুবিন্যস্ত অবস্থায় রক্ষিত থাকে। ভোটের আগে-পরে, বিশেষ করে ভোটের দিন ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর, অনাকাঙ্ক্ষিত ও হিংসাত্মক ঘটনার তথ্যও কমিশনের মাঠপর্যায়ের অফিসগুলো এবং সদর দপ্তরে সংগৃহীত ও সংকলিত থাকে। গবেষক ও তথ্যানুসন্ধানীরা তাঁদের প্রয়োজনমতো এসব তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন। নির্বাচনের পর নির্বাচন ট্রাইব্যুনালে অনেক মামলা হয়। সে কারণে ব্যালট পেপার, ব্যালট বাক্সসহ নানাবিধ নির্বাচনসামগ্রী ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শনের
(Exhibit) জন্য সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়। গবেষণার কাজের প্রয়োজনে এসব Exhibit-এর ফটোকপি এবং প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি সংগ্রহ দুরূহ কাজ নয়। সময়ভিত্তিক ঐতিহাসিক উপাত্ত (Longitudinal Data) সংগ্রহ আজকাল তেমন দুঃসাধ্য কাজ নয়।
দক্ষ গবেষকদের হাতে পড়লে এসব তথ্য ও প্রদর্শনী-সামগ্রী অনেক কথা বলে। পরিসংখ্যান, গাণিতিক সূত্র ও যুক্তিবিদ্যার ধোপে উপস্থাপিত সংখ্যা, সূত্র ও যুক্তির সংগতি অচিরেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সাক্ষীর মুখের কথা গবেষকদের সত্যানুসন্ধানের মূল উৎস নয়। সাক্ষী অনেক কথা বানিয়ে বলতে পারে; কিন্তু গাণিতিক সূত্র ও পরিসংখ্যানের তত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে এসব বক্তব্য সত্যবিচ্যুত অগ্রহণযোগ্য উপাদান হিসেবে পরিত্যাজ্য হবে।
অনুসন্ধানের প্রথম ধাপ হবে জয়ী প্রার্থী ও তাঁর নিকটতম প্রার্থীর ভোটসংখ্যা লেখচিত্র আকারে উপস্থাপন। সেই চিত্র থেকে ধরা পড়বে রেখাচিত্রের সংযোগকারী বিন্দুগুলো দৈবচয়নিক (Randomised) কি না। যদি দেখা যায় যে চলকের বিস্তার বা বিস্তরণ (Distribution) নিতান্তই দৈবচয়নিক, তাহলে বলা যেতে পারে যে এর পেছনে কারচুপির সন্দেহ করা যৌক্তিক হবে না। যদি লেখচিত্রের মধ্যে কোনো প্যাটার্নের আভাস পাওয়া যায়, তাহলে সে প্যাটার্নের স্বরূপ বিশ্লেষণ আবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। দ্বি-চলকের বিস্তরণে (Bivariate Distribution) তাদের সম্পৃক্তির ধারা বিশ্লেষণের দাবি সামনে এসে পড়ে। অস্বাভাবিকতা ধরা পড়লে তার ব্যাখ্যা সংগ্রহের জন্য আরো পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার প্রয়োজন পড়ে।
প্রতিটি বিস্তরণের (Distribution) কিছু গাণিতিক ও পরিসংখ্যানগত বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন—একটি নিখুঁত মুদ্রা ওপরে ছুড়লে তার উল্টো-সোজা (Head or tail) দিক মাটিতে পড়ে দৃশ্যমান হওয়ার সম্ভাবনা (Probability) সমান সমান। সুতরাং অনেকবার ছুড়লে ‘হেড ও টেল’ মোটামুটি কাছাকাছি সংখ্যায় দৃশ্যমান হবে। অর্থাত্ যদি মুদ্রাটি ১০০ বার ওপরে ছোঁড়া হয়, তাহলে ‘হেড অথবা টেল’ প্রতিটির উঠে আসার সংখ্যা ৫০-এর আশপাশে হবে। যদি একটি ৮৫ বার এবং অন্যটি ১৫ বার ওঠে, তাহলে তা অস্বাভাবিক (abnormal) হিসেবে বিবেচিত হবে। এটি হবে একটি পরাবাস্তব ঘটনা, অথবা কোনো সূক্ষ্ম কারচুপির ফল। পুরো প্রক্রিয়াটিতে সন্দেহ দানা বাঁধবে। সুতীক্ষ ও অনুপঙ্খ তদন্তের দাবি উঠবে।
একক চলকের বিস্তার বা বিস্তরণের ক্ষেত্রে কিছু বৈশিষ্ট্য স্বাভাবিকভাবে পরিলক্ষিত হয়। এর মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্য স্বতঃসিদ্ধ (axiom) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন ত্রিভুজের যেকোনো দুই বাহুর যোগফল তৃতীয় বাহুর চেয়ে বড় হবে। কোনো পূর্ণ বস্তুর ভগ্নাংশের যোগফল পূর্ণ বস্তুর চেয়ে বড় হতে পারে না। কোনো বিস্তরণের গড় মান সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মানের বাইরে যেতে পারে না ইত্যাদি। এসব সূত্র লঙ্ঘিত হলে বুঝতে হবে, বাস্তব গণনা বা প্রায়োগিক উপসংহারে ভুল রয়েছে। পরিসংখ্যানতত্ত্বে আরো একটি ধারণা দেওয়া হয় যে মনুষ্য সম্পাদিত যেকোনো কর্মকাণ্ডে বহুসংখ্যক ঘটনার সমাহার ঘটলে তার দু-একটিতে ছোটখাটো ভুল হওয়াই স্বাভাবিক। না হলে ধরে নিতে হবে যে এ কাজে যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে অথবা স্বাভাবিক পদ্ধতির বাইরে অস্বাভাবিক কোনো কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। মনুষ্য সম্পাদিত যেকোনো কাজ বহুবার পুনরাবৃত্তি করা হলে যে নগণ্য পরিমাণ ভুল হয়, তাকে পরিসংখ্যানের পরিভাষায় বলা হয় ‘রেন্ডমাইজড এরর’ (Randomised Error) বা কারণ-বিমুক্ত দৈব ঘটনা। এমন ভুলের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি পর্যবেক্ষকের মনে সন্দেহের উদ্রেক করে।
গণিত ও পরিসংখ্যানের সূত্রের মতো কিছু বৈজ্ঞানিক সত্য রয়েছে, যার যথার্থতা সর্বজনবিদিত। এ নিয়ে কেউ সন্দেহ প্রকাশ করে না, কোনো প্রশ্ন তোলে না। যদি ভবিষ্যতে কেউ প্রশ্ন তোলে বা বিদ্যমান সত্যের বিপরীতে নতুন কোনো সত্য প্রতিস্থাপিত করতে পারে, তাহলে তা হবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অঙ্গনে যুগান্তকারী সংযোজন। এ পর্যায়ে স্থিরীকৃত বৈজ্ঞানিক সত্যকে মেনে নিয়ে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই। যেমন মেশিনের সাহায্যে হোক অথবা মেশিনবিহীনই হোক না কেন, মানুষের কর্মশক্তির সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে সে ‘গিনেস বুকে’ স্থান পেতে পারে; কিন্তু সীমাবদ্ধতা তার থাকবেই। বর্তমান বাস্তবতায় কোনো লোক ১৫০ বছরের বেশি বাঁচে না; কোনো লোক এক ঘণ্টায় ঢাকা থেকে দুবাই যেতে পারে না। বিমান ছাড়া অন্য কোনো পথে এক ঘণ্টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে পারে না। কোনো বুথের ব্যালট বাক্সে ঘণ্টায় এত ভোটারের বেশিসংখ্যক ভোটার ভোট দিতে পারে না। একইভাবে কোনো লোক ঢাকায় উপস্থিত থাকার আধা ঘণ্টার মধ্যে আবার চট্টগ্রাম অবস্থান করতে পারে না। এটি সাক্ষ্য-প্রমাণের বিষয় নয়। একজন ব্যক্তি এক হাজারবার সাক্ষ্য দিতে পারে যে সে আধাঘণ্টার কম সময়ের ব্যবধানে ঢাকা-চট্টগ্রাম দুই জায়গায় শারীরিকভাবে উপস্থিত থেকে কর্ম সম্পাদন করেছে; কিন্তু তার এ সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না; বরং তাকে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার দায়ে অভিযুক্ত করা হবে।
পক্ষ-প্রতিপক্ষের তর্ক-বিতর্ক থেকে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনকালে গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিক সূত্র স্বতঃসিদ্ধ ব্যবহার করলে অনেক সময় ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। আমরা তা না করে ব্যক্তির বক্তব্য এবং তার উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করি। ফলে আমরা বিভ্রান্তির করাল চক্রে ঘুরপাক খেতে থাকি। তদন্ত, সালিস, আদালত, বিচার, আপিলে লম্বা সময় ও সম্পদ ব্যয় করি। সময় এসেছে, চূড়ান্ত মন্তব্য করার আগে দুই পক্ষের উপস্থাপিত বক্তব্যগুলোকে আমরা যেন গণিত, পরিসংখ্যান, যুক্তিবিদ্যার সূত্রাবলি ও বৈজ্ঞানিক সত্যের নিরিখে যাচাই-বাছাই করে নিই। তাহলেই আমরা সত্যানুসন্ধানে অধিকতর সফল হব।
লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব ও
পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান