পাকিস্তান: আসল জায়গায় হাত দিচ্ছেন না ইমরান

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: যে দেশে প্রায় ৩০ শতাংশ নাগরিক দরিদ্র, কিন্তু সমর বাজেট সর্বশেষ বছরে ১৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, সেখানে কৃচ্ছ্র সাধনা কোথা থেকে শুরু হওয়া উচিত? নাশতার টেবিলে বিস্কুটের সংখ্যা কমানো দিয়ে? কিংবা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে অল্প বেতনের কর্মচারী সংখ্যা কমিয়ে? নাকি রাষ্ট্রীয় সম্পদের হিস্যা জনগণের কোন অংশে কতটা যাচ্ছে, সেদিকে নজর দিয়ে?

ইমরান খানকে ধন্যবাদ, পুরোনো এই বিতর্ক আবার উসকে দিয়েছেন তিনি।

এখনো ‘দুটি পাকিস্তান’
গড়ে পাকিস্তানে দারিদ্র্যের হার ৩০ শতাংশ বলা হলেও গ্রামাঞ্চলে সেটা ৫৫ শতাংশ। দারিদ্র্যের এই শুমারিতে মানদণ্ড ধরা হয় ২৩০০ ক্যালরি খাদ্য গ্রহণ বা তার মাসিক বাজারদর ৩ হাজার ৩০ রুপি আয়কে। দেখা গেছে, দেশটিতে এলাকাভেদে দারিদ্র্যের রয়েছে বাড়তি তীব্রতা। পাঞ্জাবে যা ৩২ শতাংশ, ট্রাইবাল এলাকায় তা ৭৪ শতাংশ।

পাকিস্তানে এমন শহর পাওয়া যাবে, যার জৌলুশ পাশ্চাত্যের অনেক শহরের মতো। আবার এমন জেলাও আছে, যার অবস্থা আফ্রিকার দরিদ্রতম জনপদের মতো। ইসলামাবাদ-লাহোর-করাচি-রাওয়ালপিন্ডির বাইরে ‘আরেকটি পাকিস্তান’ রয়েছে, যেখানে অর্থনীতি আলাদা। কিন্তু এসব শহরই ‘উন্নয়ন বরাদ্দে’র সিংহভাগ পেয়ে চলেছে। যেখানে বসবাসকারী শাসক এলিটরা দারিদ্র্য নিয়ে আলাপ করতেও অস্বস্তি বোধ করে। অথচ দেশটিতে প্রায় ২ কোটি ২৪ লাখ শিশু বিদ্যালয়ের বাইরে এবং ৪৫ শতাংশ শিশুর শরীর পুষ্টির অভাবে প্রত্যাশামতো বাড়েনি। শতকারা ৮৭ ভাগ নারী শ্রমিকের আয় ন্যূনতম জাতীয় মজুরির চেয়ে কম।

কোন শ্রেণির পকেটে হাত দেবেন ইমরান?
ধনী-দরিদ্রের মাঝে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে কোন দেশ কী করছে, এ বিষয়ে অক্সফামের বিশ্বখ্যাত সিআরআই (কমিটমেন্ট টু রিডিউসিং ইনইকুয়ালিটি) র‍্যাঙ্কিং রয়েছে। তাতে পাকিস্তানের অবস্থান ১৫২ দেশের মধ্যে ১৩৯। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয়ে অবস্থান ১৪৬। শ্রমিক অধিকারে ১১৮। একটি দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের মূল সূচক এগুলো। পাকিস্তানে সাত দশকের অন্ধকার জমে আছে। ইমরান এই অন্ধকার দূর করতে চান।

অক্সফামের সিআরআই প্রতিবেদনে বাংলাদেশও আছে। আমাদের অবস্থান ১৪১তম। শ্রম অধিকারে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল গত বছর ১৫২ দেশের মধ্যে ১২৮। যদিও বাংলাদেশ শিক্ষা-স্বাস্থ্য-শ্রম অধিকারের চেয়ে মহাশূন্যে স্যাটেলাইট পাঠানোকে অগ্রাধিকার দিয়েছে।

উপমহাদেশের ‘বৃহৎ শক্তি’ হলেও ভারতের সিআরআই অবস্থান বাংলাদেশে ও পাকিস্তানের কাছেই—১৩২তম। স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তায় তার অবস্থান অপর দুই দেশের চেয়েও খারাপ, ১৪৯।

জাতীয় সম্পদের অসম বণ্টন এবং জনস্বার্থের দিক থেকে ভুল অগ্রাধিকার এসব দেশে এ রকম অবস্থা তৈরি করেছে। কেবল বিমানবন্দরে ভিআইপিদের প্রটোকল পাল্টে, প্রধানমন্ত্রীর জন্য বুলেটপ্রুফ গাড়ির বদলে সাধারণ যান চালু করে কিংবা পুরোনো রাষ্ট্রীয় প্রাসাদগুলোকে হোটেল বানিয়ে এরূপ কাঠামোগত অসাম্য বদলানো যায় কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে।

একইভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেভাবে যোগসাধনাকে ভারতে ‘ইতিবাচক জীবনের পথ’ এবং ‘ভবিষ্যতের আশার আলো’ হিসেবে হাজির করেছেন, সেটাও মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টি সরানোর চেষ্টা মাত্র। বাংলাদেশেও একজন সামরিক শাসক সাইকেল চালিয়ে অফিসে আসা শিখিয়েছিলেন কিছুদিন। আরেক সমরবিদ বাজার অব্যবস্থাপনায় সৃষ্ট খাদ্যসংকটের সমাধান হিসেবে ভাতের বদলে আলু খেতে বলতেন। পাকিস্তানে নওয়াজ শরিফ ২০১৩ সালে ক্ষমতায় এসে খরচ কমাতে সরকারি সফরে সাংবাদিকদের অন্তর্ভুক্তি বাতিল করেছিলেন।

অর্থাৎ হাস্যকর বা গম্ভীর যেভাবেই হোক, ইমরানই প্রথম লোকরঞ্জক নেতা নন। দক্ষিণ এশিয়ার শাসকেরা অনেকেই রাষ্ট্রীয় খরচ বাঁচাতে আন্তরিক ছিলেন। কিন্তু যে বিষয়ে তাঁদের সাহসের সঙ্গে কখনো ভাবতে দেখা যায়নি, তাহলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ বণ্টন ও পুনর্বণ্টন হবে কীভাবে? ইমরান কি খতিয়ে দেখবেন, পাকিস্তান যে আজ প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলার দেনায় ধুঁকছে, সেই টাকাটা কোথায়, কীভাবে খরচ হলো? আগামী বছর থেকে সুদ-আসল মিলে রাষ্ট্রকে প্রতি ১২ মাসে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার দিতে হবে, সেটা কোন খাত থেকে যাবে? কারা অতীত ঋণের ওই দায় বইবে?

শুধু বিস্কুটের সংখ্যা কমিয়ে এসব অর্থ জোগাড় করা যাবে না। মানুষের পকেটে হাত দিতে হবে। কিন্তু কোন শ্রেণির পকেট থেকে সেই টাকা আদায় করা হবে? এসবই হলো জরুরি প্রশ্ন। অতীতে এবং এখনো।

পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, আমলাতন্ত্রকে ‘ঔপনিবেশিক মানসিকতা’ বদলাতে হবে। কিন্তু শুধু মানসিকতা বদলিয়েই কি চলবে? ঔপনিবেশিক আইন ও বাজেট ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রকাঠামো বহাল থাকলে শুধু প্রতীকী পদক্ষেপ কি নতুন কিছু দিতে সক্ষম?

রয়েছে ক্রুদ্ধ শ্রেণিবঞ্চনার বোধ
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতির সমস্যা বাস্তবে কাঠামোগত, বিস্কুট বা প্রধানমন্ত্রীর গাড়িকেন্দ্রিক নয়। রোমান্টিকতায় মোড়ানো কোনো সমাধান নেই এসবের। সমস্যার গোড়ায় রয়েছে ক্রুদ্ধ শ্রেণিবঞ্চনা। পাকিস্তানের বেলায় উঁচুতলার ২০ শতাংশ মানুষ নিচুতলার ২০ শতাংশের চেয়ে সাত গুণ বেশি ভোগ করে। এটা ইউএনডিপির গবেষণার হিসাব এবং এই ব্যবধান কমানোই দেশটির মূল অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। দেশটির গত বাজেট থেকে সামরিক বাহিনীই নিয়ে নিয়েছে ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার, যা পুরো বাজেটের প্রায় ২১ শতাংশ এবং দেশটির জিডিপির ৩ দশমিক ২ শতাংশ।

অনেকে এই বরাদ্দকে যৌক্তিকতা দিতে ভারতের ৪৫ বিলিয়ন ডলার সামরিক বরাদ্দের উদাহরণ টেনে আনবেন। কিন্তু প্রশ্নটা হওয়া উচিত নিজ দেশের দরিদ্র জনগণের বিপরীতে এরূপ বরাদ্দ যথাযথ কি না। জনগণ যদি অপুষ্টি-অশিক্ষা-অসুস্থতার শিকার থাকে, তাহলে দেশের তথাকথিত ‘প্রতিরক্ষা’র মানে কী দাঁড়ায়? এসব জিজ্ঞাসা এড়িয়ে শাসকদের ভোগবিলাসে লাগাম টেনে ধরায় যে বাহবা ওঠে, তা অক্ষমের সুখের মতো। প্রয়োজন শাসক ও শাসিতের ব্যবধান কমানো এবং পারলে ওই সামাজিক বর্গ দুটি তুলে দেওয়া। সবাইকে সমানাধিকারের জবাবদিহিতে নামিয়ে আনা।

ইমরান সেই জবাবদিহিতে তাঁর শাসকশ্রেণিকে নিতে চাইবেন কি?

সমর বাজেটের কৃচ্ছ্র সাধনা
সংবাদ বেরিয়েছে, ঋণের সুদ ও আমদানি ব্যয় মেটাতে পিটিআই সরকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যাপক হারে বিরাষ্ট্রীয়করণের উদ্যোগ নিচ্ছে। তিন প্রক্রিয়ায় রুপি সংগ্রহ হবে। কিছু সম্পদ বিক্রি করা হবে। কিছু ইজারা দেওয়া হবে। বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হবে বাকিগুলোর। এসব খুব চেনা আয়োজন।

বাংলাদেশে একসময় দেখেছে ‘লোকসানি’ প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফামুখী করার মতো ব্যবস্থাপনা-দক্ষতা শাসকদের ছিল না। খুব কম দামে শত শত কলকারখানা বিক্রি হয়েছে। এই কায়দায় সরকারি কোষাগারে এককালীন কিছু অর্থ আসে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে। কাঁচামাল উৎপাদকেরাও বেকার হয়। রাষ্ট্রীয় সম্পদের এরূপ হাতবদলে নতুন রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় নতুন মালিকগোষ্ঠী তৈরি হয়। যারা ইতিমধ্যে অর্থশালী, তারাই নতুন করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ কিনতে পারে। বিদ্যমান ধনী-গরিবের ব্যবধান আরও বাড়ায় সেটা।

এ রকম এখনো শোনা যায়নি, ইমরান বা মোদি বা বাংলাদেশে করব্যবস্থার সংস্কারের মাধ্যমে সম্পদশালীদের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ আদায় করে সেটা শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। করব্যবস্থার ওইরূপ সংস্কার ছাড়া নিয়মতান্ত্রিক পথে অর্থনৈতিক সংস্কারের কোনো উদ্যোগ অসাম্য কমাতে পারবে বলে মনে হয় না।

পাকিস্তানের বেলায় দেখা গেছে, নির্মাণ খাত অর্থনীতিতে সবচেয়ে ‘বুমিং’। কিন্তু সেখান থেকে সরকার মাত্র দশমিক ১ শতাংশ কর পায়। রাজনীতিবিদদের বিপুল এক অংশ রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ে আছে। বোধগম্য কারণেই সেখানে নজরদারি কম। প্রায় ২১ কোটি মানুষের দেশে মাত্র ১০ লাখ নাগরিক কর দেন।

সবাই আশা করছে, ইমরানের ‘নয়া পাকিস্তান’-এ করপোরেট ও ধনীদের করহার নতুন করে নির্ধারিত হবে; বিদেশে সম্পদ পাচার বন্ধ হবে। হাত দেওয়া হবে ভূমি সংস্কারে। দেশটিতে কৃষি ৪৮ শতাংশ মানুষের রুটি-রুজির প্রধান উৎস হলেও ৬৪ শতংশ কৃষিজমি মাত্র ৫ শতাংশ লোকের হাতে রয়েছে। গ্রামীণ পরিবারগুলোর ৫১ শতাংশ ভূমিহীন। এসব হিসাব চার-পাঁচ বছর পুরোনো হলেও পরিস্থিতি পাল্টায়নি খুব বেশি। প্রশ্ন হলো, এই ভূমিসম্পর্ক পাল্টাতে চেষ্টা করবেন কি ইমরান? পাশাপাশি তিনি কি সমর খাতে ক্রমাগত বরাদ্দ বৃদ্ধির যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখবেন?

এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার ওপর নির্ভর করবে পিটিআইয়ের ‘নয়া পাকিস্তান’ পুরোনো উপসংহার এড়াতে পারবে কি না!

Advertisement