গতকাল সকালে খামারবাড়ি মোড়ে ভ্রাম্যমান ট্রাক সেল পয়েন্টের দৃশ্য। এক কেজি পিয়াজের জন্য শিশুসন্তান কোলে নিয়ে কাঠফাঁটা রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছেন এক নারী। পিয়াজ ভর্তি পিকআপ আসতেই শুরু হয় হুড়োহুড়ি। ভিড়ের মধ্যে পড়ে নারীর আহাজারি আর শিশুর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। এখানে পিয়াজ কিনতে সকাল ৬টা থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রখর রোদের মধ্যে অপেক্ষা করছেন শত শত নিম্ন আয়ের মানুষ। বিক্রয় কেন্দ্রে সকাল ৯টার মধ্যে পিয়াজ ভর্তি পিকআপ আসার কথা। কিন্তু রোববার খামারবাড়ি মোড়ে পিকআপ আসে ১২ টার পর। অথচ ক্রেতারা পিয়াজ কেনার জন্য ভোর ৬টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে। দুপুর পর্যন্ত পিয়াজ না আসায় ক্রেতারা অধৈর্য হয়ে পড়েন। তবুও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিলেন সবাই। ভোর থেকে যেসব ক্রেতা লাইনে দাঁড়িয়েছেন তাদের সিরিয়াল নম্বর দেয়া হয়েছে যাতে সুশৃঙ্খলভাবে পিয়াজ কিনতে পারেন। কিন্তু ১২টার পর পিকআপ আসতেই শুরু হয় হুড়োহুড়ি। হুমড়ি খেয়ে পড়েন ক্রেতারা। এ সময় আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাস্তার মানুষ, হকার, রিকশাচালক এবং লেগুনাচালকরা পিকআপ ঘিরে ধরেন। শুরু হয় ধস্তাধস্তি। এ সময় শিশু, বৃদ্ধ ও নারীরা ছিটকে পড়েন লাইন থেকে। হুড়োহুড়ির মধ্যে ঢুকে যখন কেউ এক কেজি পিয়াজ হাতে পাচ্ছেন তার মুখে যেন যুদ্ধ জয়ের হাসি।
কেউ কেউ আগে থেকে টোকেন সংগ্রহ করে রেখেছেন। কিন্তু অধিকাংশরাই টোকেন পাননি। ক্রেতাদের অভিযোগ, ৪৫০ সিরিয়াল পর্যন্ত টোকেন দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়। দেয়ার কথা ১০০০ জনকে। বলা হয় টোকেন ছাড়া কাউকে পিয়াজ দেয়া হবে না। অন্যদিকে শত শত মানুষ ভিড় করছেন। কাকে রেখে কাকে দেবে টোকেন। তাই পিকআপ আসতেই সবাই লাইন ভেঙে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এক কেজি পিয়াজ পেতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে প্রত্যেক ক্রেতাকে। আবার ৫ টাকা খুচরা না থাকার অজুহাতে ৪৫ টাকার বদলে ৫০ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে টিসিবির পিয়াজ। তবে বিক্রেতাদের দাবি ৫ টাকার বদলে পিয়াজ একশ গ্রাম বেশি দেয়া হচ্ছে। পিয়াজ কিনতে খামার বাড়ি মোড়ে ভোর ৬টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন মধ্য বয়সী আনোয়ারা বেগম। দীর্ঘ ৬ ঘণ্টা অপেক্ষা শেষে মিলেছে এক কেজি পিয়াজ। চোখেমুখে আনন্দের ছাপ। বলেন, টেলিভিশনে খবর পেয়ে সেই মোহাম্মদপুর থেকে এসেছি। আমরা গরিব মানুষ। ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় পিয়াজ কিনে খাওয়ার সামর্থ নাই। অভাবের সংসারে ১৫০-২০০ টাকা বাঁচলে সেই টাকা দিয়ে আমি ৪ কেজি চাল কিনতে পারবো। এটা আমার কাছে অনেক কিছু। সকাল থেকে ১০ থেকে ১২ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৭০ থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের ঢল নেমেছিল খামারবাড়ি মোড়ে। ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে কারও ভাগ্যে এক কেজি পিয়াজ জুটলেও ভিড়ের মধ্যে ধস্তাধস্তিতে অনেক নারীর ভাগ্যে জোটেনি পিয়াজ। এ সময় আমেনা নামের একজন নারী ধাক্কাধাক্কিতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে এক কেজি পিয়াজ হাতে ধরিয়ে দিলে বাসায় ফিরেন।
ইন্দিরা রোডের আবুল খায়ের সকাল ৮টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু কোনোভাবে পিকআপের কাছেই ভিড়তে পারছিলেন না। ঘামেভেজা শরীর নিয়ে পিকআপের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন অসহায়ের মতো। পরে এক সংবাদকর্মীর অনুরোধে তাকে এক কেজি পিয়াজ দেয়া হয়। রেহেনা নামের প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ বছরের একজন নারী লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন সকাল ৭টা থেকে। দীর্ঘক্ষণ রোদে দাঁড়িয়ে থেকে এমনিতেই ক্লান্ত। এরপর হুড়োহুড়ি শুরু হলে ধস্তাধস্তিতে মাটিতে পড়ে যান। উঠে আবার চিৎকার করে পিয়াজের জন্য অনুনয়-বিনয় করতে থাকেন। অবশেষে এক কেজি পিয়াজ নিয়ে ভিড় ঠেলে বের হয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচেন।