পোশাকশিল্পে শক্তিশালী শ্রমিকবান্ধব সংগঠন চাই

আহমদ রফিক

‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগান একসময় বিশ্বের শ্রমজীবী মহলে প্রবল আলোড়ন তুলেছে, এখনো তুলছে মূলত ‘মে দিবস’ পালনের গতানুগতিকতায়। এতে সংগ্রামী শ্রেণি-চেতনার পরিচয় পরস্ফুিট। পশ্চিমা বিশ্বের শ্রমজীবী সচেতনতার ধারাবাহিকতায় এই শ্রেণি-আন্দোলনের ঢেউ ক্রমে এশিয়ার শ্রমজীবী মহলের নানা খাতকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। বাদ যায়নি ভারত, বঙ্গদেশ।

বহু কথিত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন বামপন্থী ও মধ্য-বামপন্থী রাজনীতির অবদান। কলকারখানা, রেলসহ যেখানেই কর্মরত শ্রমিক জীবনযাপনের সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ন্যূনতম মজুরি ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার জন্য লড়াইয়ে নেমেছে, সেখানেই রাজনৈতিক তৎপরতার টানে গড়ে উঠেছে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন। সংঘবদ্ধ শ্রমিক তাদের দাবিদাওয়া আদায়ে মরণপণ লড়াই চালিয়েছে।

ইংরেজ শাসনে ভারতবর্ষের সর্বত্র এভাবে গড়ে উঠেছে শ্রমিক আন্দোলন, আর সেই উদ্দেশ্যে তৎপর সংগঠন। কৃষিপ্রধান পূর্ববঙ্গেও চটকল, বস্ত্রকলসহ শিল্পকারখানায় শ্রমিকদের মধ্যে দাবি আদায়ে গড়ে তুলেছে উল্লিখিত রাজনৈতিক সংগঠনগুলো। মালিক ও তাদের পৃষ্ঠপোষক শাসকশ্রেণির সঙ্গে এ লড়াই মোটেই সহজ ছিল না, এখনো নয়।

জীবনযাত্রার দাবিদাওয়ার এসব লড়াইয়ে কখনো রক্ত ঝরেছে, কখনো গেছে প্রাণ। আন্তর্জাতিক মহলে সংগঠিত শ্রমিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় তৎপরতা অনেক ক্ষেত্রে নিয়মতান্ত্রিক পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে; কখনো লড়াইয়ের পরিণতি দেখা গেছে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় ও সমঝোতায়। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের এটি অন্যতম দিক। এ ছাড়া পূর্ববঙ্গে ছোটখাটো শ্রমিক সংগঠনের সংখ্যাও একসময় কম ছিল না।

দুই.

উল্লিখিত শ্রমিক সংগঠনগুলোতে বরাবর দেখা গেছে পুরুষ শ্রমিকদের প্রাধান্য বিশেষ করে বিভাগ-পূর্বকালে, এমনকি বিভাগোত্তর পাকিস্তানি শাসন আমলেও। আদমজী, বাওয়ানিসহ একাধিক শিল্পপতির প্রতিষ্ঠিত পাটকল, বস্ত্রকল, সুতা কারখানাসহ চামড়া ও অন্যান্য শিল্পকারখানার পাশাপাশি রেলশ্রমিকদের সংগঠন ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী ও রাজনৈতিক অর্থে তাৎপর্যপূর্ণ।

স্বাধীন বাংলাদেশে যে শিল্প খাতটি আপন তাৎপর্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত তা হলো পোশাকশিল্প—লোকের মুখে চলতি কথায় ‘গার্মেন্ট’ নামে সুপরিচিত। আর বৈশিষ্ট্যটি হলো এখানে নারী-শ্রমিক তথা কিশোরী, তরুণী ও যুবতী শ্রমিকদের সংখ্যাধিক্য। এদের অধিকাংশ অতিদরিদ্র, নিম্নবর্গীয় গ্রামীণ পরিবারের সদস্য। অর্ধাহার বা অনাহার থেকে মুক্তি পেতে এরা গ্রাম ছেড়ে শহরে, প্রধানত রাজধানী ঢাকায়। এরাই দেশের পোশাকশিল্পকে স্বাচ্ছন্দ্য গতি দিয়েছে তাদের স্বচ্ছ দৃষ্টির সূক্ষ্ম কারুকর্মে।

শুরুতে দেখা গেছে, বেতন তথা মজুরি যৎসামান্য। অনেক কষ্টে বস্তিবাসের জীবনযাপন। এদের অনেকে মহানগরের সাবেক গৃহকর্মী-বসবাসের স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়ে তাদের ভাষায় ‘স্বাধীন কাজের’ আকর্ষণ অনেক বেশি, আর্থিক হিসাবটা যদিও যুক্তির পক্ষে যায় না। ‘চাকরি’ বলে কথা। মধ্যবিত্ত, বিত্তবান পরিবারের গৃহিণীরা বেজায় অখুশি। তাদের মতে, গৃহকর্মে সব মিলিয়ে মোট আয় তথা উপার্জন বা প্রাপ্তি পোশাক কারখানার বেতনের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি। তবু গৃহকর্মে তাদের মন নেই।

তাদের শ্রমিকজীবনের ভয়ংকর দিকটি হলো ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অভাব, সম্ভ্রম তথা ইজ্জত রক্ষার অভাব। আজ থেকে কয়েক দশক আগে পোশাককর্মী তরুণী বা কিশোরীর ধর্ষিত লাশ দেখা গেছে ঝোপে-ঝাড়ে, ড্রেনে-ডোবায়। ওরা তখন দৈনিকপত্রের শিরোনাম। তা সত্ত্বেও ওরা পোশাক কারখানার কর্মীর কাজ ছেড়ে গৃহকর্মের দিকে ঝোঁকেনি।

সুবিধাবাদী শ্রমিক নেতাদের দেখা গেছে পোশাকশিল্প কারখানাগুলোর পরিস্থিতির সুযোগ নিতে। তাদের অনেকেই মালিকপক্ষের পৃষ্ঠপোষকতায় ধন্য, আপন স্বার্থের থলিটা ভরে নিতে করিতকর্মা, সত্যিকার ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন, শ্রমিক স্বার্থের সংগঠন গড়ে তোলার দিকে এদের আগ্রহ কমই দেখা যায়। স্থানীয় পাতিনেতারা এদের স্বার্থের পরিপূরক। বিরলসংখ্যক প্রকৃত শ্রমিক নেতা প্রবল বাধার সম্মুখীন। কখনো তেমন কারো লাশ পড়ে; কিন্তু খুনের কিনারা হয় না।

পোশাকশিল্প কারখানায় নারী শ্রমিকের সংখ্যাধিক্য সত্ত্বেও সামাজিক রীতিনীতির কারণেই বোধ হয় দাবিদাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে পুরুষ শ্রমিকদের নেতৃত্বই প্রাধান্য পেতে দেখা যায়। পিছিয়ে পড়ে নারীকর্মীও, বিশেষ করে নেতৃস্থানীয় নারী শ্রমিকও। তা ছাড়া অর্থনৈতিক বৈষম্যও লক্ষ করার মতো। তবু আন্তর্জাতিক মহলে এ দেশের পোশাকশিল্পে নারীদের অবদানের কথাই উচ্চারিত হয়ে থাকে।

তিন.

পোশাকশিল্প কারখানায় নারী শ্রমিকদের গুরুত্ব ইতি ও নেতি—দুই বিপরীত মাত্রায় ধৃত। কয়েক দশক আগের কথা। কলকাতায় এক সাংস্কৃতিক সেমিনার শেষে একদা বিপ্লবী অধ্যাপক ও সমাজসেবী শান্তিময় রায় কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, বাংলাদেশের পোশাকশিল্প খাতে যে এক নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে, সে সম্বন্ধে খুব একটা আলোচনা শুনতে পাই না। আপনাদের নিম্নবর্গীয় গ্রামীণ তরুণীরা এ শ্রেণিগত পরিবর্তনের হোতা। কিন্তু এর সুফল তাদের ভাগ্যে জোটে না।

এ সম্বন্ধে বিশদ জানার আগ্রহ ছিল অধ্যাপক রায়ের। তার কথিত ‘নীরব বিপ্লবের’ নেতিবাচক দিকগুলো উল্লেখ করতেই তিনি শিউরে উঠে বললেন, এর প্রতিকার-প্রতিরোধ হচ্ছে না কেন? কী করছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠনগুলো? জানি না, গণতন্ত্রী, না সমাজতন্ত্রী—কোন ধারার সংগঠনের কথা তার কথায় প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বহন করছিল।

আমি অবশ্য বিশেষ অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করিনি। বাংলাদেশের শ্রমজীবীবান্ধব একটি রাজনৈতিক সংগঠনের একজন শীর্ষস্থানীয় অনুজপ্রতিম নেতাকে বলেছিলাম, কেন তারা পোশাকশিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে চেষ্টা করছে না। তার নানা যুক্তির মধ্যে এমন কথাও ছিল যে গ্রাম থেকে আসা অতিগরিব পরিবারের অসহায় মেয়েরা কর্তৃপক্ষের হুমকি ও চাকরি হারানোর ভয়ে, পাতিনেতাদের চাপে আন্দোলনের পথে সহজে হাঁটতে চায় না। অবশ্য ব্যতিক্রমীরাও রয়েছে; কিন্তু সংখ্যায় অল্প।

অনস্বীকার্য যে কর্মজীবী ও শ্রমজীবী নারীদের নিয়ে রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালানোয় নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। মালিকপক্ষ সেসব সুযোগ ভালোভাবেই নিয়ে থাকে, যাতে তাদের কারখানায় শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন গঠিত হতে না পারে। এসব ক্ষেত্রে নিরাপত্তার দিকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য সে সমস্যা অল্পবিস্তর পুরুষ কর্মীদের বেলায়ও দেখা যায়।

দাবিদাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে সংগঠন করার অর্থ এমন নয় যে সর্বদাই বেপরোয়া জঙ্গিবাদী লড়াকু পথ ধরে চলতে হবে। শক্তিমান সংগঠন দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে ন্যায্য কিছু দাবি আদায় করে নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে দরকার ব্যাপক শ্রমিক-কর্মী ঐক্য।

বর্তমান অবস্থায় পুরুষকর্মী প্রধান শ্রমিক সংগঠনের একটি দুর্বলতা (অবশ্য পোশাকশিল্পে) সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীকর্মীদের অংশ বিশেষের পিছিয়ে থাকা বা পিছিয়ে পড়া। আর সে জন্যই দরকার নারী-পুরুষকর্মীর সম্মিলিত সংগঠন, যা হবে ট্রেড ইউনিয়ন চরিত্রের।

সম্প্রতি একটি দৈনিক সংবাদপত্রের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্টজনরা এমন মতামত প্রকাশ করেছেন যে পোশাকশিল্প খাতে নারী শ্রমিকদের নিয়েই ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন গড়ে তোলা দরকার। এ প্রস্তাবের পেছনে এমন ধারণা থাকতে পারে যে তারা সংখ্যা বিচারে গরিষ্ঠ, তাই মূল শ্রমিক-কর্মী সমর্থন তাদের পক্ষে থাকবে। অন্যদিকে সহিষ্ণুতা গুণের বিষয়টিও বিচার্য, যা দ্বিপক্ষীয় সংলাপের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ভেতর থেকে বা অন্য পক্ষ থেকে যত বাধা-নিষেধ আসুক না কেন, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে যেকোনো শিল্পকারখানায় শ্রমিকস্বার্থ রক্ষার জন্য ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন গড়ে তোলার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। তাতে রয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সংস্থার সমর্থন। মালিকপক্ষ ও শাসকশ্রেণি তথা সরকার তা স্বীকার করে নিতে বাধ্য।

বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর এদিক থেকে নীতিগত, আদর্শগত রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। দল বিশেষের পারস্পরিক সংঘাতে না গিয়েও যুক্তিসংগত ধারায় বিশাল পোশাকশিল্প খাতের শ্রমজীবীদের জন্য তাদের স্বার্থনির্ভর ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন তৈরি শুধু মানবিকতার দায়ই নয়, সময়েরও দাবি, সামাজিক দাবিও বটে।

পোশাকশিল্প কারখানাগুলো এখন এককভাবে শতভাগ মালিক স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করছে। শাসনযন্ত্র কমবেশি তাদের পক্ষে বা তাদের চাপের কাছে নতি স্বীকারের নীতি গ্রহণ করে চলছে। বিগত সময়ে সংঘটিত দুর্ঘটনাগুলো এবং সেই সূত্রে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ, সহায়তা ইত্যাদি বাস্তবতা তেমন প্রমাণই দেয়। মালিক সমিতি তাদের স্বার্থের পথ ধরেই হেঁটেছে।

প্রতিশ্রুতি, দায়বদ্ধতা, মানবিক চেতনা, এমনকি বিদেশি ক্রেতাগোষ্ঠীর চাপ কোনো কিছুই তাদের শ্রমিক স্বার্থ পূরণে এগিয়ে যেতে দেখা যায়নি। একমাত্র শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারত। আর সে কারণেই রাজনৈতিক সংগঠনগুলো এসব ক্ষেত্রে তাদের নীতিগত ও নৈতিক দায় এড়াতে পারে না।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, ভাষাসংগ্রামী

Advertisement