প্রপা : যত দূরে যাই

সাঈম চৌধুরী

প্রবল দুঃখবোধ থেকে তৈরি হচ্ছে একটি গান। বয়স মাত্র তেরো কিংবা চৌদ্দ। এই বয়সের দুঃখ তো কচু পাতায় জলের মতো। টুপ করেই ঝরে যায়। চোখ যদি একবার মেঘ পেয়ে জলে ঝাপসা হয় আরেকবার সেটি রোদ লেগে আলোয় ভরে ওঠে। প্রপা নামের তেরো কিংবা চৌদ্দ বয়সি এই মেয়েটির দুঃখ কিন্তু কচু পাতার জলের মতো নয়, বটবৃক্ষের মতো ডালপালা বিস্তৃত তার দুঃখমালা।

হাতেগোনা মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তিনটি মৃত্যুর ধকল সইতে হয়েছে তাকে। নানা গেছেন, নানী গেছেন। ঠাকুরদা আর ঠাকুরমার গল্প শোনা হবে না আর কোনোদিন। তারপর একদিন, ’এই একটু পরেই ফিরছি’ বলে বাবা বাসার বাইরে গেলেন। কিন্তু হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হলে মানুষ যে আর কোনোদিন ফিরে আসে না বাবার মৃত্যু দিয়ে সেই সত্যকে কঠিনভাবে উপলব্দি করে প্রপা। মৃত্যু এমনই এক আঘাত বড়রা তাতে বিপর্যস্ত হন বটে কিন্তু জীবনে অনেক মৃত্যু দেখে তারা সেটি মেনে নেবারও শক্তি অর্জন করেন। ছোটরা সেটি পারে না। প্রিয়জনের মৃত্যু মানে তাদের কাছে মাথায় আকাশ ভেঙে  পড়া। প্রপার আকাশও ভেঙে পড়ে। মুষড়ে যায় মেয়েটি। রাতে বিছানায় বালিশ ভিজে যায় চোখের জলে। বাবার সঙ্গে কাটানো টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো কাঁটা হয়ে বুকে বিঁধে। অবাধ্য চোখের জলকে বশে আনতে বিছানা ছাড়ে প্রপা। ঘরের এক কোণে রাখা গিটারটা হাতে নেয়। এটি হচ্ছে দুঃখ জয়ের প্রথম প্রচেষ্টা। ’দুঃখ তাপে ব্যথিত চিত্তে নাইবা দিলে সান্তনা, দুঃখ যেনো করিতে পারি জয়’। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত সেই কবিতা অজান্তেই প্রপার শক্তি হয়ে যায়। গিটারের ছয়টি তারে তিনটি মৃত্যুর পাষাণ তাড়ায় মেয়েটি। আর এখান থেকেই জন্ম নেয় একটি গান…।

গত ৫ নভেম্বর, সোমবার ইউটিউবে মুক্তি পেয়েছে প্রপা রেজওয়ানা আনোয়ারের প্রথম বাংলা মিউজিক ভিডিও যত দূরে যাই…। দেশের গান এটি।

দেশছাড়া মানুষের গান এটি। দূর প্রবাসেও যারা দেশকে সতত হৃদয়ে আঁকড়ে রাখেন তাদের গান এটি।
গানটি মুক্তির পর ফেলেছে বিপুল সাড়া। প্রবাসীরা মোহাবিষ্ট হয়েছেন। নিজের হৃদয়ের আকুতি তারা শুনতে পেয়েছেন গানটির প্রতিটি শব্দে আর বাক্যে। কেবল প্রবাসীই নয় দেশে থাকা মানুষেরা প্রপার গানের সাথে একাত“তা বোধ করছেন। গত দুদিনে হু হু করে বাড়ছে গানটির দর্শকসংখ্যা।
প্রপার ইমেলে আর ফেইসবুকের ইনবক্স ভাসছে প্রশংসার বন্যায়। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের কয়েকটি টিভি চ্যানেল গানটি সম্প্রচারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
প্রথম গানের এমন অভাবনীয় সাড়ায় আপ্লুত প্রপা। তাকে বেশি তৃপ্তি দেয় গানটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা গল্পগুলো-চরিত্রগুলো। এ গানের প্রতিটি চরিত্র প্রপার ঘরের মানুষ। গানটি লিখেছেন মা। ও হ্যাঁ প্রপার মায়ের কথা এখনো বলা হয়নি। তিনি আমাদের একজন। বিলেতে বাঙালি কমিউনিটির ঘনিষ্ঠ স্বজন। ড. জাকি রেজওয়ানা আনোয়ার।
নামটা শোনামাত্রই টিভি পর্দায় তার চেহারা ভেসে ওঠে। হ্যাঁ তিনি চ্যানেল এস-এর জনপ্রিয় সংবাদ পাঠক। প্রবাসীদের বিভিন্ন ইস্যুতে  থাকেন কমিউনিটির কাছাকাছি। ঐ কিছুদিন আগে যখন বাংলাদেশে প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইনে প্রবাসীদের স্বার্থবিরোধী কিছু ধারা যুক্ত করা হয়, তখন প্রস্তাবনার বিরুদ্ধে জেগে উঠা প্রবাসীদের আন্দোলনের নেতৃত্বে তিনি ছিলেন অন্যতম।
ড. জাকি রেজওয়ানা আনোয়ারের আরেকটি দিক রয়েছে সে সম্পর্কে জানেন খুব কম সংখ্যক মানুষ। তিনি একজন শিল্পী। গান মিশে আছে তার রক্তে। ধ্র“পদী আর রবীন্দ্র সংগীত তার সত্তায় দোলা দেয়। উচ্চাঙ্গ সংগীতে তালিম নিয়েছেন ওস্তাদ আক্তার সাদমানীর কাছে আর রবীন্দ্র সংগীত শিখেছেন অজিত রায়ের কাছে। ছোটবেলা থেকে গানকে সঙ্গী করে বেড়ে উঠা জাকি রেজওয়ানা এখন আর তেমন করে গান করেন না। কিন্তু তাঁর দুই সন্তান প্রমিত আনোয়ার ও প্রপা রেজওয়ানা আনোয়ার যেনো গানের কাছাকাছি থাকে এটি নিশ্চিতে তিনি তাদের তবলায় বোল দিতে শেখান, হারমোনিতে সারেগামার তাল ধরে দেন।
প্রপার জন্ম এই ব্রিটেনে। বিখ্যাত হ্যানরিয়েটা বার্নেট গ্রামার স্কুলে সিক্সথ ফর্মে পড়ুয়া প্রপার দিন-রাতের কথায়, চিন্তায় আর কর্মের পুরোটাই দখল করে আছে ইংরেজি ভাষা। পাশাপাশি জার্মান ভাষাও জানে সে। গত বছর জার্মান অলিম্পিয়াডে জার্মান ভাষাতে গান লিখে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করে প্রপা। এমন মেয়ে যদি মায়ের ভাষা মানে বাংলা ভাষা থেকে দূরে সরে যায় তবে দোষ দেয়া যাবে না। কিন্তু মা যখন ড. জাকি রেজওয়ানা আনোয়ার তখন মেয়ে বাংলা বলবে না তাই কি হয়! মায়ের তো একটাই কথা, দেশের জন্য কিছু যদি করতে নাও পারি তবু সন্তানদের যদি শুদ্ধ করে বাংলা ভাষাটা শেখাতে পারি তবেই মানবো, বাংলাকে তো পরের প্রজন্মে ছড়িয়ে দিলাম। স্বার্থক হয়েছেন তিনি। প্রমিত এবং প্রপা দু’জনেই চমৎকার বাংলা জানে। রবীন্দ্রনাথকে তারা চেনে, নজরুলকে তারা ধারণ করে। প্রপা নিজের আগ্রহেই মাকে প্রস্তাব দেয়, মা একটা বাংলা গান লিখে দাও না, আমি সুর করি।
হাসেন মা। বলেন, আমি তো পূর্ব দিকের মানুষ। আমার রয়েছে পূবের সুর। তোরা পশ্চিমকে ধারণ করে বড় হচ্ছিস। পূবে আর পশ্চিমে কি সুর মেলে?
প্রপা বলে, সুর মেলানোর দায়িত্ব আমার। তুমি শুধু কথাগুলো লিখে দাও।
প্রপাকে একা দায়িত্ব নিতে হয় না। পশ্চিমের সুরকে কিছুটা হলেও চিনেন-বুঝেন ড. জাকি রেজওয়ানা আনোয়ার। সুতরাং দায়িত্ব নেন তিনিও। রচনা হয় মা ও মেয়ের গান লেখা আর সুর দেওয়ার যৌথ খামার। তখনও তাদের বাড়িতে মৃত্যুর দুঃখ ছড়িয়ে রয়েছে। বাবা হারানো ছোট মেয়েটির বুকে তখনও কান্না লেগে আছে। সেই কান্নায় সান্তনার প্রলেপ দেয় এই যৌথ প্রচেষ্টা। একটা একটা করে শব্দ রচনা করেন মা। একটু একটু করে সুর তুলে মেয়ে। দেড় বছর ধরে চলে গান রচনা, সুরের কারুকাজ। মা-বেটিতে কিছু কিছু বিষয়ে ঐক্যমত হয়, কিছু কিছু বিষয়ে প্রবল দ্বিমত। মায়ের লেখা কোনো শব্দ গানের সুরের সাথে না গেলে মেয়ে সেটি ফেলে দিতে বলে। আবার মায়ের মন মতো সুর না মিললে তিনি বলেন, এখানে একটু যতি টানো প্রপা, এখানে একটু তাল-লয়ে খেয়াল দাও। এভাবে চলে ঘষামাজা। যত দূরে যাই গানটি  পায় চূড়ান্ত রূপ। এবার তাকে ক্যামেরায় বন্দি করার সময় এসেছে। মা লিখেছেন, গান, মেয়ে দিয়েছে সুর এবং কণ্ঠেও ধারণ করেছে গানটিকে।
ছেলে প্রমিত আনোয়ার তবে কি দূরে সরে আছে গান থেকে? মিউজিক ভিডিওটি যারা দেখেছেন, তাদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে, ভিডিওতে প্রাণবন্ত একটা ছেলে ভায়োলিনে সুর তুলছে। এই ছেলেটিই হচ্ছে প্রমিত। অক্সফোর্ড ইউনির্ভাসিটিতে পড়ুয়া দুর্দান্ত মেধাবী প্রমিত আনোয়ারের কণ্ঠের ঝলকও দেখা গেছে এই গানে। গানে আরো কণ্ঠ দিয়েছেন ড. জাকি রেজওয়ানা আনোয়ারও। এক পরিবারের তিনজন সদস্য একই গানে। ভিডিওতে তাদের দেখা গেছে। তবে তাদের তিনজনের সঙ্গে সবার অলক্ষ্যে আরো একজন মানুষ ছিলেন। তিনি ড. উদয় সাঈদ আনোয়ার। প্রমিত আর প্রপার বাবা। মানুষটি পৃথিবীতে আর নেই। তবুও প্রপারা যখন একযোগে কণ্ঠ তুলে বলে, ভেবো না কাছে নেই বলে ভুলে গেছি তোমাকে…তখন যেনো উদয় সাঈদ আনোয়ারের কথাও বলে তারা। কাছে নেই বলে ভুলে যে যায়নি কথাটি উড়িয়ে দেয় আকাশের বুকে। গানটি শেষ পর্যন্ত দেশের দিকে ধাবিত হলেও দেশ তো আসলে পিতৃভূমিই। পিতাকেই তো দেশের মানচিত্রে খুঁজে পায় সন্তানরা। সুতরাং এটি দেশের গান হয়েও একটি পরিবারের একান্ত গল্প বলে যায়।
আগেই বলা হয়েছে গানটি প্রকাশ হওয়ার পর হুলুস্থুল পড়েছে। দুই দিনে প্রায় দুই হাজার বার সেটি শোনা হয়েছে, পরে আবার শুনবেন বলে অনেকে ডাউনলোড করে রেখেছেন। গানে মুগ্ধ শ্রোতারা প্রপাকে ইমেল করার পাশাপাশি ইউটিউবের পেইজেও তাদের মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। যেমন সাজ্জাদ আহমেদ নামের একজন লিখেছেন, আপনারা সত্যিই দেশপ্রেমিক, আপনাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
শ্রোতা যখন শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধায় বিনম্র হন তখন সেটিই শিল্পীর সার্থকতা। প্রপার সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলাম। সে বললো, গানটি নিয়ে অনেক আশা ছিলো, কিন্তু মানুষের কাছ থেকে এতোটা প্রেরণা পাবো ভাবি নি। আমার খুব ভালো লাগছে।
তখন মা জাকি রেজওয়ানা আনোয়ার মেয়েকে সর্তক করে দিয়ে বলেন, মাগো, মাথা উঁচু করে দাঁড়াও কিন্তু মাথাকে কখনো বড় করে দিও না। পা যেনো মাটিতে থাকে। প্রশংসায় ডুবে না গিয়ে তাকে আগামীর চলার শক্তি হিসেবে ধারণ করো। সংযমী হও।
মা হচ্ছেন প্রপার জীবনের সবচেয়ে বড় স্কুল, মা হচ্ছেন প্রপার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। তাই মায়ের কথা মন থেকে মেনে নিয়ে প্রপা বলে, ভয় নেই মা। আমি প্রশংসায় যেমন ভাসবো না, নিন্দায়ও তেমন ঢলবো না। জীবনে আনন্দের কিছু এলে তাকে বিনয়ে গ্রহণ করবো, দুঃখের কিছু এলে তাকে সাহস দিয়ে মোকাবেলা করবো।
প্রপার কথা শেষ হয় না। তার আগে আমি ড. জাকি রেজওয়ানার কাছে জানতে চাই, প্রতিদিন অসংখ্য গানের মুক্তির এই বিশ্ব বাজারে যত দূরে যাই গানটিকে কেনো আলাদাভাবে অনেকেই গ্রহণ করে নিলেন?
তিনি বলেন, খেয়াল করে দেখবেন, গানটির কথায় এবং সুরের মধ্যে একটা অদ্ভুত ঐক্য আছে, ছন্দ আছে। গানের ভিডিওচিত্রে আমরা সেটি তুলে ধরার প্রয়াস করেছি। প্রবাসে থেকে পাখির চোখে দেশটিকে আমরা দেখতে চেয়েছি। সুতরাং দেশের গান হলেও মিউজিক ভিডিওটিতে বাংলাদেশের কোনো রূপ ফুটিয়ে তোলা হয়নি। বিলেতের দৈনন্দিন জীবনের চলাফেরায়, টিউবে, স্টেশনে, বিগ বেনের সামনে আমরা হাঁটছি তারমাঝেও আমাদের হৃদয়ে অন্তবিহীনভাবে সুর তুলছে দেশ। ভিডিওচিত্রে তারই প্রমাণ রেখেছি আমরা। আর এইসব কিছু স্পর্শ করেছে দর্শকদের। খুব সম্ভবত এটিই যত দূরে যাই গানের সাফল্যের মূল সূত্র।
প্রপা আর তার মা ড. জাকি রেজওয়ানা আনোয়ারের সাথে কথা হচ্ছিল জনমতে বসে। যত দূরে যাই গানটি আমি প্রথম শোনার সুযোগ পাই চ্যানেল এস এর বার্তা সম্পাদক কামাল মেহেদীর মাধ্যমে। প্রথম শোনাতেই প্রেমে পড়ে যাই। কামাল মেহেদী কে বলি, গানটা নিয়ে মা মেয়ের সাথে একটু কথা বলে নিজের মুগ্ধতাটুকু প্রকাশ করতে চাই।
আমার প্রস্তাবটিকে মর্যাদা দেন কামাল মেহেদী। প্রপা এবং ড. জাকি রেজওয়ানাকে নিয়ে আসেন। কথা বলি তাদের সাথে। প্রপাকে বলি, জানো মা, আমারও দু’টি মেয়ে আছে। আরশী আর অনিন্দি। খুব শখ মেয়ে দু’টিকে গান শেখাই। নিখাঁদ-খাঁটি বাংলা গান। তুমি সেই ইচ্ছার গায়ে সাহস বুলিয়ে দিলে।
আমার কথায় হাসে প্রপা। একজন বাবার স্বপ্নকে উসকে দেওয়ার মতো কী যে বিরাট একটি কাজ করে বসে আছে, বয়স কম বলে সম্ভবত বিষয়টিকে ধরতে পারে না সে।
সাঈম চৌধুরী : নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক জনমত, লন্ডন।
(উল্লেখ্য প্রপা,ব্রিট বাংলার ইয়ুথএডিটর  )
 
Advertisement