প্রবাসে ঈদ

সালেহা চৌধুরী :: ঈদ শব্দের সঙ্গে ছেলেবেলার একটি যোগ থাকে। জুতার বাক্স বালিশের কাছে রেখে ঘুমানো। মনে পড়ল, অনেক দিন আগে আমরা তখন নওগাঁয়। আব্বা সেখানে স্কুল ইন্সপেক্টর। একদিন ঈদের বাজার করতে আমাকে নওগাঁর বাজারে নিয়ে গেলেন। জামা-পাজামা কেনা হলো; একটা করে। সে সময় একটার বেশি দুটো কেনা হতো না। এর পর এলাম জুতার দোকানে। যে জুতা কেনার কথা সেটা না কিনে অনেক দামি এক জোড়া জুতায় চোখ আটকে যায়। আব্বার পকেটে যে টাকা আছে, তা দিয়ে সেই জুতা হয় না। আমি কিছুতেই ওই জুতা না নিয়ে ছাড়ব না। লাল জুতার ওপর জরির কারুকাজ। মনে হয় ‘সিন্ডারেলার স্লির’। গল্পটা আপু রাতে ঘুমাতে এসে আমাকে শুনিয়েছেন। কাজেই জুতা জোড়া দেখে মনে এলো সিন্ডারেলার গল্প। এই জুতাই আমার চাই। রীতিমতো কান্নাকাটি। আব্বা শেষ পর্যন্ত দোকানের একটা লম্বা টুলে আমাকে বসিয়ে রেখে বাড়ি গেলেন বাকি টাকা আনতে। আমি টুলের ওপর বসে তাকিয়ে রইলাম পথের দিকে। জুতা কেনা হলো। বাকি পথ বুকের কাছে জুতার বাক্স ধরে বাড়ি ফেরা।

আর সে রাতে? জুতার বাক্স মাথার কাছে নিয়ে ভোরের প্রতীক্ষা। কখন নতুন জামা-পাজামার সঙ্গে সেই জুতা পরব! এখনও সেদিনের কথা মনে হয়। আব্বার কথা ভেবে চোখ সজল হয়। কী কষ্টই না ছেলেমেয়েদের জন্য তারা করতেন! সেই সকালে ঘুম ভেঙে যেত রান্নার খোশবুতে। সেমাই হয়েছে, জর্দা হবে। এর পর মাংস-পোলাওসহ অন্যান্য। মায়ের গায়ে আতরের গন্ধ। তিনি আতর মেখে চোখে সুরমা দিয়ে রান্না করছেন। কী যেন গুনগুন করছেন আপন মনে! দোওয়া, না গান- জানি না। সেসব দিন কিছুতেই ভুলে যাওয়ার নয়। তাই ঈদ মানে আমার কাছে ছেলেবেলা। এর পর বাড়ি বাড়ি বেড়ানো। সব বাড়িতেই কিছু খাওয়া। খেতে খেতে পেট ঢোল। তার পর আবার খাওয়া। সেই বয়সে তো আর ডায়াবেটিস, ব্লাডপ্রেশারের ভয় ছিল না। তাই যত পার খাও। ঈদ মানেই খাওয়া। এর পর এলো নিজেদের জীবন। ছেলেমেয়ে আর সবার কথা ভাবা। ঢাকায় একবার কোনো দর্জি ছেলেমেয়েদের কাপড় বানাতে চাইছিল না। কারণ আমাদের কাপড় কিনতে একটু দেরি হয়ে গেছে। কী আর করা? বাড়িতে আমরা দু’জন মিলে হাত মেশিনে ছেলেমেয়ের জামা-কাপড় সেলাই করি। পাঞ্জাবি বানাতে পেরে খুবই খুশি হই। ভেবেছিলাম, ওইটি আমরা বানাতে পারব না। বেশ ভালো হয়েছিল। খুব খুশি লাগছিল এমন একটা কাজ করতে পেরে। সে বছরের ঈদের আনন্দ ছিল অন্য রকম। এর পর চলে আসা প্রবাসে।

এখানে যখন স্কুলে কাজ করতাম একদিন ‘সেকশনাল’ ছুটি পেতাম। সেদিন আবার বাড়ির প্রধান ছুটি পেতেন না। ছেলেমেয়ে স্কুলে যেত না। ওদের নিয়ে ঈদ হতো। একবার আমাদের প্রতিবেশী ওদের নিয়ে গিয়েছিল নামাজ পড়তে। এখানে মেয়েরাও মসজিদে যায় নামাজ পড়তে। তারপর চেষ্টা করতাম যেন ওদের নিয়ে মসজিদে যেতে পারি। কোরবানির ঈদ এখানে তেমন জমে না। কারণ গরু-খাসি কে এখানে কোরবানি দেবে? অনেক দূরে গিয়ে কোরবানি করতে হয়। বেশ ঝামেলা। তাই সেমাই-ঈদ জমে বেশি; কোরবানির ঈদ নয়। প্রবাসে প্রায় বেশিরভাগ মানুষ গরু-খাসির টাকা দেশে পাঠায়। আমরাও তাই করি। এ ছাড়া দেশে যারা জামা-কপড় কিনতে পারে না তাদের কথা ভেবেও টাকা পাঠানো হয়। আমাদের টাকাটা যায় সেই গ্রামে, যেখানকার লোকজন ঈদ ছাড়া মাংস খাওয়ার কথা তেমন ভাবতে পারে না। আমার বিশ্বাস, অনেকেই তাই করেন। ঢাকায় কমপিটিশন দিয়ে গরু কেনা বা লোক দেখানো কাজ কারবার। মন সায় দেয় না। তবে সেমাই-ঈদের ঘটনা অন্যরকম। এক মাস রোজার পর ঈদ। এর ঘ্রাণ গভীর ও সুন্দর। যেন এক মাস পরে খাবার নিয়ে আর কোনো ভাবনা নেই।

ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যাওয়ার পর একদিন বুঝতে পারি, এই ঈদে ওরা কেউ বাড়ি থাকবে না। একজন গেছে হলিডেতে, আরেকজন থাকে অন্য শহরে। কর্তাও ছুটি পাবেন না। অতএব একা এটা-সেটা রান্না করে লেগে যাই বাড়ির পুরনো কাবার্ড গোছানোর কাজে। বাড়িটাকে ঝকঝকে করতে। সেবার মনে হয়েছিল, প্রবাসে ঈদ মানে কাবার্ড গোছানো। এক বাটি সেমাই নিয়ে পাশের বাড়িতে দিতে গিয়ে বুঝি, তারা জিনিসটি দেখেননি। তারা ইংরেজ। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে দিই- এটা হলো ‘ভার্মিচেলি পুডিং’। তারা গ্রহণ করেন। পরে বলেন- ইট ওয়াজ টু সুইট, বাট নাইস। এর পর আমি আর পাশের বাড়িতে সেমাই পাঠাতে চেষ্টা করি না। যারা পূর্ব লন্ডনে, বালহামে, উডগ্রিনে থাকেন তাদের জন্য এ সমস্যা নেই। প্রচুর বাঙালি সেখানে। সিলেটিরা খুব মজা করে ঈদ করে। এটা বেশি হয় পূর্ব লন্ডনে। সবাই মিলে অনেক রকম কাজ-কারবারে শরিক হয় তারা। যেটা লন্ডনের সব এলাকাতে হয় না। তবে কোরবানির ঈদের চাইতে রোজার ঈদ অনেক জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপিত হয়; সে কথা আগেই বলেছি।

ভাবি, ইস্‌ আমরা লন্ডনে এমন জায়গায় থাকি কেন, যেখানে ঈদ উদযাপনের জন্য আশেপাশে কেউ নেই! বাড়ি কেনার সময় এমন কথা মনে হয়নি। যদিও আমার বাড়ির রাস্তার নাম ‘লাখনৌ স্ট্রিট’, তারপরও বাঙালি কাউকে চোখে পড়ে না। কাজেই এখন একা একা ঈদ করা। ফোনে সবাইকে ঈদ-শুভেচ্ছা জানানো, গল্প করা। ঈদের রান্না নিয়ে আলোচনা। দেশে গেলে যখন ঈদ হয়, বুঝতে পারি- প্রবাসে এমন করে ঈদ হয় না। প্রবাসে এমন করে অনেক কিছুই হয় না। তারপরও প্রবাসে থাকা। একবার এখানে এলে এখান থেকে কেউ বেরুতে পারে না। কারণ ব্রিটেন এমন একটি দেশ, একবার এলে রবিনসন ক্রুশোর মতো আটকে যায় সবাই; পালাতে পারে না। যেমন আমরা আটকে গেছি। প্রথম ভেবেছিলাম, এক বছর থাকব। এখন তো ৪৬ বছর হয়ে গেল। দেখলাম, এ দেশে থাকার ফলে ছেলেমেয়েরা ক্রিসমাস উদযাপনে উৎসাহী। কিন্তু ঈদ তেমন করে ওদের মনে সাড়া দেয় না। আমার ছেলে যে উপন্যাসটি লিখেছে সেখানে ‘ক্রিসমাস’ বলে একটি পর্ব আছে। সেখানে ও লিখেছে- বাড়িতে ক্রিসমাস। বাবা কখনও তেমন নামাজ পড়েন না। কিন্তু ক্রিসমাসের দিন দেখা গেল তিনি বারবার নামাজ পড়ছেন। ভাবখানা এই- আমরা ক্রিসমাস করলেও আসলে মুসলমান। ছেলে বেশ মজা করে পর্বটি লিখেছে। বইটির নাম ‘এ মুসলিম বয়’। ভালোই কাটতি বইটার।

যা বলছিলাম, প্রবাসের আমরা এই ঈদে কী করতে পারি? কোরবানির টাকা, জাকাতের টাকা দেশে পাঠানো ছাড়াও আরও কিছু করা যেতে পারে। যেমন মনে রাখা দেশে অন্তত ১০ জন যেন এই ঈদে কাপড়চোপড় পায়। ওরা যেন খুশিমতো ঈদ পালন করতে পারে। আহা! দেশে ঈদে কতজন এই শাড়ি কাপড় আনতে গিয়ে প্রাণ হারায়! যদি দেশের কিছু মানুষের ঈদের আনন্দ দিতে পারি, তাহলেই মনে হবে, আমরা একটা ভালো কাজ করলাম। আমরা প্রবাসের সবাই এমন করে ভাবলে দেখা যাবে অনেক পরিবারে ঈদের আনন্দ নেমে এসেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এমন কাজ অনেকেই করেন। না হলে প্রবাসে থাকা কেন?

ঈদ সংখ্যায় বাংলাদেশের বাজার সয়লাব। অনেকে লেখেন ঈদের জন্য। আমাকেও দু’একটা কাগজের জন্য লিখতে হয়। ঈদ সংখ্যা অসংখ্য। যখন দেশে যাই, সংখ্যাগুলো পুরনো হয়ে যায়। শেষ বাংলা বইয়ের দোকানটি লন্ডনে বন্ধ হয়ে গেছে। কাজেই ওখান থেকে ঈদ সংখ্যা সংগ্রহ করা আর হয় না। কেবল জানি ঈদ সংখ্যার কথা। ঢাকায় যে আমার বাড়ি দেখাশোনা করে, তাকে বলে দিই ঈদ সংখ্যাগুলো কিনে রেখে দিতে। বিশেষ করে যে সংখ্যাগুলোতে আমার লেখা আছে। এভাবেই প্রবাসে বসে ঈদ উদযাপন। আমাদের সংস্কৃতি বাঙালি প্রবহমানতায়, নানা উপাদান ও ঐতিহ্যে এবং ধর্মের ছিটেফোঁটায় একটি অনবদ্য সংস্কৃতি। জানি ধর্ম সংস্কৃতি নয়; সংস্কৃতির একটি উপাদান। যেমন ব্রিটেনে মিশেছে যিশুখ্রিষ্টের গল্প। তাই এখানে ক্রিসমাস পালন। জুয়িশরাও তাই করে। হিন্দুরাও সেই একইভাবে ধর্মকে সংস্কৃতির সঙ্গে মিশিয়েছে। তাই ধর্মকে সংস্কৃতির একটি আনুষঙ্গিক বিষয় বলে মেনে নিতে হবে।

একবার লন্ডনের স্কুলে ঈদের পর অনুষ্ঠান হয়েছিল। কারণ পূর্ব লন্ডনের স্কুলে অনেক বাঙালি মুসলমান ছেলেমেয়ে। সেসব ছেলেমেয়ে নিয়ে আমরা স্কুলে ঈদ অনুষ্ঠান করছিলাম। একজন অভিভাবক সে কথা শুনে বলে- আমরা কী দোষ করলাম? আমাদের ধর্মের অনুষ্ঠান করবে না।

-কী ধর্ম তোমাদের?

-আমাদের পয়গম্বর হায়লে সালাসি। তার জন্মদিন পালন কর। আমরা ‘রাস্টা ফেরিয়ান’। হেডমাস্টার শুনে বলেছিলেন- লোকটা তো ভাবনায় ফেলে দিল। এই স্কুলে আমরা দেয়ালি উদযাপন করেছিলাম। তিন দিন ধরে রাম-রাবণের গল্পের নাটক। তবে হায়লে সালাসির জন্মদিন পালন হয়নি। কত ধর্ম! সবারটা কি করা যায়? এসব নিয়েই আমাদের প্রবাস। সবার জন্য ঈদের শুভেচ্ছা।

ব্রিটেন প্রবাসী কথাসাহিত্যিক

Advertisement