প্রবাসে থাকিব না দেশে ফিরিব?

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: গণিত অলিম্পিয়াডের সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান ফেসবুকে এক চীনা গবেষকের একটা লেখা প্রকাশ করেছেন। কেন চীন ভারতের চেয়ে বেশি উন্নতি করছে, তা নিয়ে লিখেছেন কেমব্রিজের এই কৃতী মেধাবী। জানুস সোহু নামের এই গবেষক লিখেছেন, চীন তাদের প্রবাসী কৃতী গবেষক, বিজ্ঞানী, পণ্ডিতদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য নানা রকমের অত্যন্ত আকর্ষণীয় উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন তিনি লিখছেন, সম্প্রতি চীনের ওয়েনঝু শহর থেকে বিলেতের অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিনিধিরা এসেছিলেন, তাঁরা সেখানকার চীনা ছাত্রদের পড়াশোনা শেষে তাঁদের শহরে ফিরে যাওয়ার জন্য ‘প্রার্থনা’ জানিয়েছেন।

বলা হচ্ছে, যে প্রবাসী চীনাদের পিএইচডি আছে, ওয়েনঝু শহরে ফেরার জন্য তাঁদের প্রথমে দেওয়া হবে প্রায় এক কোটি ত্রিশ লাখ টাকা। এরপর একই পরিমাণ টাকা দেওয়া হবে বাড়ি কেনার জন্য। বাড়িটা আবার দেওয়া হবে কম দামে। যাঁদের ভালো গবেষণা আছে, যা চীনের জন্য উপকারে লাগতে পারে, তাঁদের জন্যও আকর্ষণীয় সব প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে ওই শহর কর্তৃপক্ষ। এই লেখক বলছেন, আমি কেমব্রিজের ভারতীয় শিক্ষার্থীদের দেখি, পড়াশোনা শেষ করে তাঁরা বিলেতে স্থায়ী হয়ে যান। আর আমরা চীনারা দেশে ফিরে গিয়ে দেশের জন্য কাজ করি। এই কারণে ভারতের চেয়ে চীনের উন্নতি হচ্ছে বেশি।

মুনির হাসানের এই ফেসবুক পোস্টের নিচে নানা মন্তব্য আসছে। তাদের মধ্যে এটাও আছে যে ভারতও তাদের প্রবাসী মেধাবী কৃতীদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য নানা উদ্যোগ বিভিন্ন সময়ে নিয়েছে। চীন আর ভারতের উন্নয়ন নিয়ে নানা ধরনের তর্ক-বিতর্ক হয়। আর সে বিতর্কে গণতন্ত্র আগে নাকি উন্নয়ন আগে, সেই প্রসঙ্গও আসে। কিন্তু এই ধরনের আলোচনার গণ্ডি যে রকমই থাকুক না কেন, আমাদের জন্য ঘুরেফিরে আসে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ। আমরা বাংলাদেশ কী করছি।

এই মুহূর্তে আমি আছি আমেরিকায়। বিদেশে আছি বলেই মুনির হাসানের এই ফেসবুক পোস্ট আমাকে ভাবাচ্ছে।

আমেরিকা কিংবা কানাডা কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোতে যখন যাওয়ার সুযোগ পাই, বন্ধুবান্ধবের আন্তরিক আতিথেয়তায় মনটা বিমুগ্ধ হয়ে থাকে এবং এই বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই থাকেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। আরও পাওয়া যায় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষায়তনগুলো থেকে বেরোনো প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ, বিজ্ঞানী ও গবেষকদের। তাঁদের অনেকেই বিদেশে খুব ভালো করছেন। নাম করেছেন, মানবসভ্যতার বিকাশে তাঁদের গবেষণা আর শ্রম অনেক বড় ভূমিকা রাখছে।

এই রকম একটা স্নিগ্ধতার আমেজে চীনা গবেষকের এই লেখাটা খানিকটা বিচলিত করে বৈকি। আমার কাছে কোনো নির্ভুল পরিসংখ্যান নেই, কিন্তু আমার ধারণা, আমাদের ব্যাচে যে ৫৫০ জন আমরা বুয়েট থেকে বেরিয়েছিলাম, তাদের ৪০০ জনই এখন বিদেশে।

প্রশ্ন হচ্ছে এটা ভালো না খারাপ।

এই প্রশ্নের কোনো সাদাকালো উত্তর নেই।

প্রথমত, বাংলাদেশ যে উন্নতি করতে আরম্ভ করল, তার সঙ্গে বাংলাদেশিদের বিদেশমুখী হওয়ার একটা সম্পর্ক আছে। সেই বিদেশ যাওয়াটা তিন রকমের। এক. কাজের সন্ধানে যাওয়া অভিবাসীরা, ম্যানপাওয়ার বা জনশক্তি রপ্তানির অংশ হিসেবে যাঁরা যাচ্ছেন। যাঁরা যান মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয়, কিংবা দূরপ্রাচ্যের দেশে, এমনকি আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ ও বিলেতেও। এঁরাই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস। প্রচণ্ড পরিশ্রম করে কষ্ট ভোগ করে এঁরা দেশে স্বজনদের কাছে টাকা পাঠান। আমি বলি, সব মানুষের সেরা মানুষ হলো আমাদের অভিবাসী বন্ধুরা। দুই. যাঁরা উচ্চশিক্ষিত, কিংবা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে আসেন, বাংলাদেশে যাঁদের আমরা মেধাবী বলে থাকি। এঁরা বিদেশে আসেন উচ্চশিক্ষার্থে, দেশে কোনো দিন ফিরে যাবেন, দেশের সেবা করবেন-এই স্বপ্ন তাঁদের কখনো যায় না, এঁরা নানাভাবে দেশের উপকার করার চেষ্টা করেন। দেশে টাকাও পাঠান। দেশে কোনো না কোনো উদ্যোগ নেন, প্রকল্প বা কর্মসূচিও চালান। তিন. আরেক দল আছে, দেশে যাঁরা সর্বার্থে সুবিধাভোগী, তাঁরা তাঁদের নানাভাবে অর্জিত টাকা বিদেশে নিয়ে আসেন; দেশে কোনো নিরাপত্তা নেই, এই হলো তাঁদের অজুহাত। কানাডায় ‘বেগমপাড়া’ নামে একটা কথা প্রচলিত আছে, দেশে অঢেল টাকাকড়ি হয়েছে এমন মানুষেরা তাঁদের স্ত্রী-সন্তানদের কানাডায় রেখেছেন, বেগমেরা দেশ থেকে আনা টাকায় আরামেই থাকেন।

প্রথম দুই প্রকারের অভিবাসী বাংলাদেশের উন্নতির চাকা ঘোরাতে সাহায্য করছেন। আজকে বাংলাদেশ যে মধ্যম আয়ের দেশ হচ্ছে, তার পেছনে তাঁদের গভীর অবদান আছে। সেটা যেমন রেমিট্যান্স জুগিয়ে, তেমনি নতুন নতুন ধারণা, প্রযুক্তি, জ্ঞান, উদ্ভাবন, মূল্যবোধ জুগিয়েও। তাঁদের কাছে আমাদের ঋণ স্বীকার করতেই হবে। আর তিন নম্বর শ্রেণি কিন্তু বাংলাদেশের নাম বিদেশে টাকা পাচারের শীর্ষ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য অবদান রাখছেন। এর সঙ্গে জড়িত সুশাসনের প্রশ্ন। বাংলাদেশে অবৈধভাবে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা অর্জন করা যায়, আর তা বিদেশে পাঠিয়েও দেওয়া যায়! আবার যাঁরা টাকা পাঠান, তাঁরাও অজুহাত হিসেবে বলেন, দেশের যা অবস্থা, নিরাপত্তা কোথায়!

কাজেই আমাদের বারবার করে সুশাসনের ওপরেই জোর দিতে হবে। দুর্নীতি কমে এলে এই ধরনের লুণ্ঠন নিবৃত্ত হবে, দেশের টাকা বিদেশে পাঠানোও কমে আসবে। আবার দেশে সুশাসন, আইনের শাসন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে দেশের টাকা দেশেই বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে।

এবার আসি দ্বিতীয় প্রসঙ্গটায়। ব্রেন ড্রেন বা মেধা পাচার। জরিপ বলছে, বাংলাদেশি তরুণেরা বিপুলভাবে বিদেশে চলে যেতে চান। একটা সময়ে আমরা দেখেছি, বহু স্কলার বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। এখনো সেই রকম মানুষ আছেন। কিন্তু সার্বিকভাবে সেই সংখ্যাটা কম। আর যেটা এই মুহূর্তে বলার কথা তা হলো, চীন কিংবা ভারতের মতো প্রবাসী মেধাবীদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কোনো নীতি, কর্মসূচি, প্রকল্প বাংলাদেশের নেই।

চীনারা সবার আগে অভিবাসন শুরু করেছিল। পৃথিবীতে এমন দেশ কম আছে, যেখানে চীনারা নেই। ভারতীয়রাও আমাদের আগে বিদেশে যেতে শুরু করে। আমরা অনেক পরে দেশের বাইরে যাওয়া শুরু করেছি। কিন্তু এখন বিভিন্ন দেশের বড় শহরগুলোতে বাংলাদেশিদের উপস্থিতি প্রবলভাবে চোখে পড়ে। চোখে পড়ার একটা কারণ, আমরা বাইরের কাজ বেশি করি, ভারতীয়দের মতো এখনো বড় বড় কোম্পানির সিইও হতে শুরু করিনি। কিন্তু বাইরের কাজ করতে করতেই আশ্চর্য প্রতিভাবান সৃজনশীল ও পরিশ্রমী বাংলাদেশিরা প্রচণ্ড সাফল্য দেখাতে শুরু করেছেন। বড় বড় ব্যবসার মালিক তাঁরা হতে শুরু করেছেন, সেসব ব্যবসা বিস্তারও লাভ করছে। চীনা বা ভারতীয়রা অভিবাসনমুখী হওয়ায় চীন বা ভারতের লাভই হয়েছে বলে আমার ধারণা। বাংলাদেশের বেলাতেও এই কথা সত্য।

কিন্তু এখন দরকার প্রবাসী বাংলাদেশি স্কলারদের দেশের সেবায়, দেশের কাজে লাগানোর জন্য একটা পরিকল্পিত উদ্যোগ। প্রবাসীদের মধ্যে দেশপ্রেমের অনুভূতি অত্যন্ত সজীব, খুবই তাজা এবং সক্রিয় থাকে। ডাকার মতো করে ডাকলে এঁরা দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। কিন্তু সমস্যাটা হলো, সেই ডাকটা নির্ভরযোগ্য কি না। দেশের পরিস্থিতি-রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আইনশৃঙ্খলা, কাজের পরিবেশ। আর সবচেয়ে বড় কথা, সুশাসন। সুশাসন থাকলে এই ডাকটা একটা বাস্তব ভিত্তি পাবে।

পৃথিবীজুড়েই একধরনের অস্থিরতার কাল যেন চলে এসেছে। মানবাধিকার, আইনের শাসনের কথা যেন প্রথম বিশ্বও ভুলতে বসেছে। এ অবস্থায় আমাদের গরিব-দুঃখী বাংলাদেশে এসব কথা বলা কি অরণ্যে রোদন মাত্র? কেউ শুনুক আর না শুনুক, আমাদের বলে যেতে হবে-অর্থনীতির ক্ষেত্রে সার্বিক নৈরাজ্য থেকে মুক্তি, আইনের শাসনের প্রশ্নে অগ্রগতি, পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে নতুন করে জেগে উঠে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, বাক্স্বাধীনতা-সার্বিক অর্থে সুশাসনের যে কোনোই বিকল্প নেই।

এই সব বড় বড় কথা আর কাজের মধ্যে প্রবাসীদের দেশে আকর্ষণ করার জন্য নির্দিষ্ট কর্মসূচি ঘোষণা করার এখনই সময়।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক

Advertisement