পড়ছি, আয়ও করছি

ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: পড়ালেখার পাশাপাশি কাজ করছেন, আয় করছেন বহু তরুণ। শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি হয়েছে নানা রকম কাজের সুযোগ। এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে কি ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার গড়া সহজ হবে? তুমুল প্রতিযোগিতার এই যুগে পড়ালেখার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরি কতটা গুরুত্বপূর্ণ

শিক্ষাজীবনে বইয়ের ব্যাগের সঙ্গে সঙ্গে নিজের খরচের দায়িত্বও কাঁধে তুলে নেন অনেক তরুণ। সারা বিশ্বেই শিক্ষার্থীদের খণ্ডকালীন চাকরি করার প্রচলন আছে। একসময় আমাদের দেশে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, যাঁরা পড়ালেখার পাশাপাশি আয় করতে চান, তাঁদের অধিকাংশের সম্বল ছিল টিউশনি। এখন আরও হাজারো সুযোগ তৈরি হয়েছে। কেউ ফটোগ্রাফি করছেন, কেউ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন, বিক্রেতা হিসেবে কাজ করছেন, রাইড শেয়ারিং অ্যাপের মাধ্যমে বাইক বা গাড়ি চালিয়েও আয় করছেন অনেকে।

জীবিকার তাগিদে কেউ কেউ পড়ালেখার পাশাপাশি কাজ করতে বাধ্য হন। কিন্তু ক্যারিয়ারের দুনিয়ায় এগিয়ে থাকতে হলেও কি এই অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ নয়? ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছিলাম আমরা।

ভবিষ্যতের প্রস্তুতি
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ করছেন সৈয়দ মুসাব্বিরুল ইসলাম। পাশাপাশি বাইক চালিয়ে রাইড শেয়ারিং অ্যাপ উবারের মাধ্যমে আয় করেন তিনি। চার মাস পরপর প্রতি সেমিস্টারে প্রায় ৭০ হাজার টাকা টিউশন ফি দিতে হয়। পুরো খরচটাই বহন করেন তিনি নিজে। প্রতিদিন দুপুরবেলা ক্লাস। ক্লাসের আগে-পরে প্রায় ১০-১২ ঘণ্টা বাইক চালান মুসাব্বিরুল। কখনো কখনো বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। পড়ালেখা শেষ করে তারপর ঘুম।

কষ্ট হয় না? মুসাব্বিরুল বললেন, ‘হয়। কিন্তু মা-বাবার কাছ থেকে টাকা নিতে হচ্ছে না। নিজের পড়ার খরচ নিজে বহন করছি। এর একটা আনন্দ আছে।’ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ফিন্যান্স ও মানবসম্পদ বিষয়ে মেজর করছেন তিনি। বলছিলেন, এই আয় তাঁর ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের একটা প্রস্তুতিও, ‘প্রতিদিন ১৬-১৭ জন অপরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। একেকজন মানুষ একেক রকম। একেকজনকে একেকভাবে ম্যানেজ করতে হয়। এটাও কিন্তু আমাদের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার একটা শিক্ষা।’ পথেঘাটে ফিন্যান্সের শিক্ষা কীভাবে পাচ্ছেন, সেটাও সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বললেন তিনি, ‘আবার ধরেন একেকটা রাইডে ১০০-২০০ টাকা পাই। কখনো কখনো ৩০-৪০ টাকাও আসে। সবই খুচরা টাকা। খুচরা টাকা কিন্তু জমানো কঠিন। রাস্তায় চা-নাশতা খেয়ে শেষ হয়ে যায়। এই টাকা জমিয়ে কীভাবে সেমিস্টার ফি দেওয়া যায়, সেটা কিন্তু ফিন্যান্সের পড়ালেখার একটা চর্চা।’

ভবিষ্যতে করপোরেট দুনিয়ায় ভালো বেতনের একটা চাকরি করতে চান মুসাব্বিরুল। কী মনে হয়? আপনার এখনকার অভিজ্ঞতা কি চাকরিদাতাদের কাছে আপনাকে এগিয়ে রাখবে?—প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় নিলেন না তিনি। ‘ইন্টারভিউতে যদি প্রশ্ন করে, আমি আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় কীভাবে পার করেছি, তখন এই সময়টার কথা বলব।’পড়ালেখার পাশাপাশি বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করেন অনেক শিক্ষার্থী। ছবি: হাসান রাজাআয়ের আনন্দ
মো. মাইনুল ইসলাম, মো. সুমন ও রেজাউল ইসলাম—তিন বন্ধু পড়ছেন বরগুনা সরকারি কলেজের প্রথম বর্ষে। খুব সকালে পত্রিকা বিলি করে তাঁদের দিন শুরু হয়। সকাল নটা-সাড়ে নয়টার মধ্যে কাজ শেষ করেন তাঁরা। কারণ, ১০টা থেকে ক্লাস।

মুঠোফোনে কথা হচ্ছিল মাইনুলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাবা কৃষিকাজ করেন। পরিবারের দিকে তাকালেই তো বুঝি, নিজে আয় করতে না পারলে পড়ালেখাটা বন্ধ হয়ে যাবে। পড়ালেখা যেন বন্ধ হয়ে না যায়, সে জন্যই কাজ করি। নিজের খরচ নিজে চালানোর মধ্যে একটা মজা আছে। আমরা তিন বন্ধু একসঙ্গে কাজ করি। ’

মাইনুলের মতো এ সময়ের অনেক তরুণ জানেন, নিজের দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হয়। মাইনুলের যদি কখনো ঢাকার তিতুমীর কলেজের ছাত্র নিজাম উদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, নিশ্চয়ই তাঁরা নিজেদের মধ্যে একটা মিল খুঁজে পাবেন। ব্যবস্থাপনা বিভাগের এই শিক্ষার্থী এখন দ্বিতীয় বর্ষের পাঠ নিচ্ছেন। পাশাপাশি খণ্ডকালীন বিক্রয় সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন আড়ংয়ের মগবাজার শাখায়। নিজাম বলছিলেন, ‘স্নাতকে ভর্তি হওয়ার পরই মনের মধ্যে কিছু একটা করার তাড়না ছিল। কাজের সন্ধান করছিলাম। এর মধ্যে একদিন আড়ংয়ের বিজ্ঞাপন দেখে জীবনবৃত্তান্ত পাঠাই। চাকরিটা হয়ে যায়।’ তিনি জানান, ব্যবস্থাপনার ছাত্র হিসেবে এটা তাঁর জন্য কাজ শেখার একটা দারুণ জায়গা। তার চেয়েও বড় পাওয়া হলো পরিবারের ওপর চাপ কমানোর আনন্দ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী শাহরিন আক্তারের কথাতেও একই আনন্দের রেশ পাওয়া গেল। বলছিলেন, ‘টিউশনি থেকে পাওয়া প্রথম মাসের টাকা দিয়ে মাকে মুঠোফোন কিনে দিই। স্মৃতিটা এখনো সজীব।’ ছোট থেকেই নাকি স্বাধীনচেতা স্বভাবের তিনি। আর এ জন্যই নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আয়ের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন টিউশনি। তাছাড়া বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন শাহরিনের। ছেলেমেয়েদের পড়ানোর সুযোগে তাঁর বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়াও হয়ে যায়।

 এখন এগিয়ে থাকার সময়
শাহরিনের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই মনে পড়ল ঢাকা সিটি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পেরোনো অর্চি অর্ণবের কথা। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল গত বছর, মার্কিন দূতাবাসের এডুকেশন ইউএসএ বিভাগ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে। পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে গেছেন অর্ণব। খুব আগ্রহ নিয়ে বলছিলেন, ‘পড়ালেখার পাশাপাশি আমি টিউশনি করতাম। আবেদন প্রক্রিয়ায় আমার এই অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলাম। মজার ব্যাপার হলো, বিষয়টি ওরা খুব গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেছে।’

সম্প্রতি শেষ হওয়া অমর একুশে বইমেলায় একটি প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের ছাত্রী সাফফাত ফারিসা। টাকা আয়ের তেমন কোনো চাপ নেই তাঁর, স্রেফ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যই কাজ করেছেন বলে জানালেন।

পড়ালেখার পাশাপাশি কাজ করাকে উৎসাহ দেয় ভিনদেশি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। ক্যারিয়ার বিশেষজ্ঞরা বলেন, সিভিতে যদি কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের সিজিপিএ ছাড়া আর কিছু না-ই লেখার থাকে, তাহলে চাকরিদাতারা কেনই–বা আপনার প্রতি আগ্রহী হবেন? এ ক্ষেত্রে সহশিক্ষা কার্যক্রম কিংবা কাজের অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের এগিয়ে রাখে।

পড়াশোনার পাশাপাশি কেন কাজ করা দরকার? এ বিষয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কৌশিক প্রসাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কাজের অভিজ্ঞতা সব সময়ই ছাত্রছাত্রীদের জন্য উপকারী। ধরুন, যেসব শিক্ষার্থী বইমেলায় কিংবা কোনো শোরুমে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করছেন, তাঁরা কিন্তু জানেন, কোন বইটি ভালো বিক্রি হচ্ছে, কোন কাপড়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি। বাজারের চাহিদাটা তাঁরা বুঝতে পারেন। এই অভিজ্ঞতা তাঁদের কাজে আসবে।’

কৌশিক প্রসাদ অবশ্য মনে করিয়ে দিলেন, ‘পড়ালেখার পাশাপাশি কাজ করা অবশ্যই ভালো। কিন্তু একটি দিক খেয়াল রাখতে হবে। কাজ করতে গিয়ে যেন একাডেমিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। বেশি আয়ের লোভে যেন পড়ার চেয়ে কাজকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে ফেলি, সেদিকেও একটু সতর্ক থাকতে হবে।’

Advertisement