ফাইভজির উড়ন্ত গতিদেখল মানুষ!

ব্রিট বাংলা ডেস্ক : ১৮ গিগাবাইটের একটি ভিডিও মুহূর্তেই নেমে গেল! হাতের ইশারায় রোবট খেলছে ফুটবল। ভিআর (ভার্চুয়াল রিয়ালিটি) গেমে বরফের পাহাড় স্কি দিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে মানুষ। এসবই বিশ্বের সর্বাধুনিক টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি ফাইভজির চমক। আর তা দেখতেই রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ডিজিটাল বাংলাদেশ মেলায় ভিড় করছে মানুষ। হুয়াওয়ের ফাইভজিতে ১.৬ জিবিপিএস গতির সাক্ষী হলো ঢাকা।

দেশে ফোরজির সুফলই এখনো তৃণমূল পর্যন্ত না পৌঁছলেও সর্বাধুনিক টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি ফাইভজি নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি দেখা গেল না। সাধারণ মানুষকে প্রথমবারের মতো ফাইভজির অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দিয়েছে মেলার টাইটেনিয়াম সহযোগী হুয়াওয়ে।

শ্যামলী থেকে স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে মেলায় এসেছিলেন রহিমা বেগম। তিনি বলেন, ‘বাসায় অবসর সময়ে মোবাইল ব্যবহার করি বেশি। আমার ছেলেও স্মার্টফোনে শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহ থেকে শুরু করে গেইম খেলে, খাবারের অর্ডার দেয়। আজ ও বায়না ধরল ফাইভজি দেখার। তাই নিয়ে এসেছি।’

তিন দিনের এই মেলায় দর্শনার্থীরা হুয়াওয়ের প্যাভিলিয়নে সরাসরি ফাইভজি স্পিড ও লো-ল্যাটেন্সি অভিজ্ঞতা নিতে পারবে। এ ছাড়া আকর্ষণ হিসেবে থাকছে বিশেষ একটি রোবট, যাকে হাতের ইশারায় পরিচালনা করে ফুটবল খেলা যাচ্ছে। ফাইভজি প্রযুক্তিতে কত দ্রুত ‘হিউম্যান টু মেশিন’ কিংবা ‘মেশিন টু মেশিন’ কমিউনিকেশন সম্ভব, তা তুলে ধরার উদ্দেশ্যে এই আয়োজন। পাশাপাশি মেলার প্রবেশমুখের হুয়াওয়ের প্যাভিলিয়নের ডান পাশে আরো একটি প্লে জোন আছে, যেখানে সবাই ফাইভজি প্রযুক্তির মাধ্যমে রিয়েল টাইম ভিআর উপভোগ করতে পারছে। ফাইভজি ভিআর পরার সঙ্গে সঙ্গেই অংশগ্রহণকারী নিজেকে খুঁজে পাবে স্কিরত অবস্থায়।

আড়াইহাজার উপজেলার বান্টি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেলায় এসেছে ইকলাস রায়হান অনিক। সে বলে, ‘আমি রোবটিক গেম খেললাম। ভিআর গেমে এত স্পিড যে আমি উড়েই যাচ্ছিলাম।’

মেলায় কথা হলো গ্রামীণফোনের নতুন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হওয়া ইয়াসির আজমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই বছরে আমরা ফাইভজি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ইন্টারনেট অব থিংকসের (আইওটি) যত রকম ব্যবহার আছে, তা প্রতিষ্ঠিত হতে দেখাব। চলতি বছর হয়তো এটি কিভাবে ব্যবহার করা হবে, তার ইকোসিস্টেম তৈরি হবে। আমি খুব আশাবাদী এটি বৈশ্বিক বাজারের মতো বাংলাদেশেও দ্রুত চালু হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরাও কিভাবে এটি নিয়ে আসা যায়, তা নিয়ে কাজ করছি। আমাদের মূল কম্পানি টেলিনর নরওয়ের বাজারে এরই মধ্যে ফাইভজি চালু করেছে। এ ছাড়া আরো কয়েকটি দেশে পরীক্ষা করা হয়েছে। আমাদের এ বিষয়ে সক্ষমতা আছে। ফোরজির সময় আমাদের নানা চ্যালেঞ্জ ছিল, ফাইভজির ক্ষেত্রেও আমরা এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারব বলে আশা করি।’

মানুষ ফোরজির গতি ঠিকমতো পাচ্ছে না কেন জানতে চাইলে ইয়াসির আজমান বলেন, ‘এখনো ফোরজি পুরোপুরি রোল আউট হয়নি। আমরা গ্রামীণফোন থেকে ৭০ শতাংশ ফোরজি কাভারেজ নিশ্চিত করতে পেরেছি। ফাইভ আসবে, আমাদের ফোরজির সম্প্রসারণও চালিয়ে যেতে হবে।’

ফাইভজির অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে হুয়াওয়ে টেকনোলজিস বাংলাদেশের পরিচালক (বিপণন) নাজমুল হাসান বলেন, ‘আমরা ফাইভজির স্পিড টেস্ট দেখাচ্ছি। যে কেউ মোবাইল ব্রাউজিং, ডাউনলোডে ঝোড়ো গতি দেখতে পাবেন। এ ছাড়া রোবট শো এবং ভিআর গেম চলছে, যাতে দারুণ অভিজ্ঞতা নিতে পারবে মানুষ। আমরা আজকের স্পিড টেস্টে ১.৬৫ জিবিপিএস (গিগাবাইট পার সেকেন্ড) সর্বোচ্চ পেয়েছি। ফোরজিতে এটি ৫০ এমবিপিএস (মেগাবাইট পার সেকেন্ড)।’

তিনি বলেন, এখানে গেমের ছলে ভিআর দেখানো হচ্ছে। কিন্তু এটি যদি শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। আমেরিকায় বসে চিকিৎসক ঢাকায় রোগী দেখা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারবেন। একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির বয়লার রিয়েল টাইম মনিটর করা যাবে। তিনি জানান, ফাইভজির অভিজ্ঞতা দিতে এখানে পুরো একটি বিটিএস বসানো হয়েছে। বিশ্বের ৩৪টি দেশে ৬১টি ফাইভজি নেটওয়ার্ক ডেপ্লয় করা হয়েছে, যার মধ্যে ৪১টিই হুয়াওয়ে করেছে।

প্রদর্শনীতে ফাইভজি প্রযুক্তির বহুমাত্রিক ব্যবহারের প্রটোটাইপ দেখাচ্ছে এরিকসন। তাদের স্টলে ক্লাউড কন্ট্রোল ব্যালান্সিং রোবটসহ ভবনের থ্রিডি ডিজাইন, অগমেন্টেড রিয়ালিটি, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে স্মার্ট ফার্মিং, ড্রোনের মাধ্যমে পুরো চাষাবাদ পর্যবেক্ষণ ও ব্যবস্থা, গ্লোবাল ম্যানুফ্যাকচারিংসহ ১৬টি ইউজ কেস তুলে ধরা হচ্ছে। এগুলো এখন সুইডেনে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানান এরিকসন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা।

মেলার আয়োজক ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, মেলায় ফাইভজির টাওয়ার, ডিভাইস নেটওয়ার্কিংসহ এই প্রযুক্তি বিস্তারিত তুলে ধরা হচ্ছে। ফাইভজি ছাড়াও মেলায় বিভিন্ন ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি ও ডিজিটাল ডিভাইস উপস্থাপন করা হয়েছে। মেলা চলবে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মেলা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

মেলায় মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো তাদের ভয়েস, ইন্টারনেট ও মূল্য সংযোজিত সেবাও (ভ্যাস) দেখাচ্ছে। জেডটিই, হুয়াওয়ে, নকিয়া ও এরিকসন ফাইভজি এবং ফাইভজির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি প্রদর্শন করছে। তারা লাইভ অনুষ্ঠানসহ এর ব্যবহার উপযোগিতা তুলে ধরছে। মেলায় শিশুদের প্রগ্রামিং ও রোবটিকস শিক্ষা অনুষ্ঠান, টেলিমেডিসিন ও টেলিকম বিভাগের প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা প্রদর্শিত হচ্ছে।

হুয়াওয়ে টেকনোলজিস (বাংলাদেশ) লিমিটেডের সিইও ঝাং ঝেংজুন বলেন, ‘প্রযুক্তিগত সুবিধাকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে ২১ বছর ধরে এ দেশের আইসিটি ইন্ডাস্ট্রি, টেলিকম অপারেটর ও স্থানীয় সহযোগীদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে হুয়াওয়ে। এখন ফাইভজি চালু হয়েছে এবং হুয়াওয়েও প্রস্তুত। ফাইভজি গবেষণা ও উন্নয়নে আমরাই শীর্ষস্থানীয় এবং ২১ হাজারেরও বেশি থ্রিজিপিপি ফাইভজি এনআর সমেত ফাইভজি পেটেন্টও আমাদের সবচেয়ে বেশি।’

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মিলন হোসেন বলেন ‘মেলায় নতুন প্রযুক্তি এলে আমাদের জীবনে কী প্রভাব পড়বে, কতটা সহজ হবে আমাদের জীবন, তার একটা ধারণা পেলাম এখানে। আমরা সারা দেশে ফাইভজির অপেক্ষায় থাকলাম।’

ফাইভজির জন্য স্মার্টফোন বাজারও প্রস্তুত বলে জানালেন হুয়াওয়ে কনজ্যুমার বিজনেস গ্রুপ (বাংলাদেশ)-এর সিনিয়র পাবলিক রিলেশন্স ম্যানেজার সুমন সাহা। তিনি বলেন, ‘হুয়াওয়ে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে ফাইভজি সমর্থিত স্মার্টফোন এনেছে। বাংলাদেশেও ফাইভজি চালু হলে এসব ফোন আসবে। ফোরজির স্মার্টফোন যেমন ১০০ থেকে ১৫০ ডলারেও পাওয়া যাচ্ছে, এটা ফাইভজির ক্ষেত্রেও করতে সবাই কাজ করছে। তাহলেই এসব ডিভাইস উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাধারণ মানুষের নাগালে আসবে।

২০১৮ সালের ২৫ জুলাই বাংলাদেশে ফাইভজি সেবা পরীক্ষায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল হুয়াওয়ে টেকনোলজিস (বাংলাদেশ) লিমিটেড। তখন ৮০০ মেগাহর্স স্পেকট্রাম ব্যবহার করে প্রতি সেকেন্ডে সর্বোচ্চ ৪ জিবি পর্যন্ত ইন্টারনেটের গতি পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু গতকাল দর্শনার্থীরা মেলার উদ্বোধনী দিনেই সেকেন্ডে ১.৬ জিবি গতিতে ডাটা ট্রান্সফারের অভিজ্ঞতা অর্জন করল।

Advertisement