ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: আকরাম খান এখন সারা বিশ্বের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিচিত একটি নাম। ভারতীয় কথক নাচের সঙ্গে পশ্চিমের ব্যালে আর একালের হিপহপ ও অন্যান্য নাচের চমৎকার মিশ্রণ ঘটিয়ে তৈরি তাঁর মঞ্চ উপস্থাপনা মুগ্ধ করছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দর্শকদের। আর এর স্বীকৃতি হিসেবে ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একটি অংশজুড়ে নিজের সেই শৈল্পিক সৃষ্টি তুলে ধরার দায়িত্ব তিনি পেয়েছিলেন।
আকরাম খানের জন্ম ১৯৭৪ সালে বিলেতে এবং সেখানেই তাঁর বেড়ে ওঠা। ফলে বলা যায়, দ্বিতীয় প্রজন্মের বিলেতবাসী তিনি। মা-বাবা দুজনেই বাংলাদেশ থেকে সেই দেশটিতে পাড়ি দিয়েছিলেন বলে বাংলাদেশের সঙ্গে পরিচয় তাঁর সেই শৈশব থেকেই। তবে অন্য অনেক দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় প্রজন্মের প্রবাসীর মতোই তিনিও কৈশোর আর যৌবনে নিজের মা-বাবার সেই দেশটিকে দেখেছিলেন দূর থেকে এবং নানা রকম বিশৃঙ্খলা আর ঝড়ঝাপটার মধ্য দিয়ে যাওয়া সেই দেশ তখন সেভাবে তাঁকে কাছে টানেনি। অনেকটা ভয় আর আশঙ্কা নিয়ে নিজের মা-বাবার দেশের দিকে তিনি তাকিয়ে ছিলেন। তবে পরবর্তী জীবনে বয়ঃসন্ধিক্ষণে এসে সেই ধারণা তাঁর পাল্টে যায় এবং নতুন করে দশটির দিকে তাকানোর চেষ্টা তিনি করেন। তাঁর সেই প্রচেষ্টার ফলাফল ছিল দেশ নামে তাঁর নির্দেশনায় রচিত একটি মঞ্চ নৃত্যনাট্য, বিলেত ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দর্শকদের কাছে যেটা সমাদর পেয়েছে। তবে এর সূচনা সম্ভবত প্রোথিত ছিল পিটার ব্রুকের বিখ্যাত মঞ্চ উপস্থাপনা মহাভারত-এর মধ্যে।
আকরাম খান সুযোগ পেয়েছিলেন সেই দলে শিশু নৃত্যশিল্পী হিসেবে যোগ দেওয়ার এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মহাভারত-এর মঞ্চ উপস্থাপনা উপলক্ষে ১৪ বছর বয়সে দলের সঙ্গে তিনি সেই সব দেশে গিয়েছেন। বলা যায়, পিটার ব্রুকের সেই মহান সৃষ্টি তাঁর জীবনধারাকেই কেবল পাল্টে দেয়নি, পরবর্তী সময়ে নাচকে পেশা হিসেবে নিয়ে কোরিওগ্রাফার হিসেবে তাঁর আবির্ভাবের পেছনেও ছিল পিটার ব্রুকের অবদান, যে কথা আকরাম খান নিজে বলে বেড়াতেও পছন্দ করেন। কয়েক দিন আগে টেলিফোনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি যেমন বলেছেন, ‘এই যে আজকের এই আমি, এর সবটাই সেই অভিজ্ঞতা যেন ছাঁচে ঢেলে তৈরি করে দিয়েছে। এর কারণ অবশ্যই সেই দলে যোগ দেওয়ার সময় আমি ছিলাম কিশোর, যাকে সহজেই প্রভাবিত করা সম্ভব ছিল অনেকটা যেমন শূন্য ক্যানভাসে ছবি এঁকে নেওয়ার মতো। তখনো শক্ত কোনো ভিত্তির ওপর আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম না এবং পিটার ব্রুকের সেই আন্তর্জাতিক দলে বিভিন্ন দেশের সব নামী আর মহান শিল্পীর সান্নিধ্যে আসতে পেরে সেদিন আমি আরও যা বুঝতে পেরেছিলাম তা হলো, মানবজীবনের গল্প অন্যদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যভাবে পৌঁছে দিতে হলে সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটিয়ে নেওয়া হচ্ছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
মহাভারত-এর সেই অভিজ্ঞতা ভারতের ঐতিহ্যবাহী কত্থক নৃত্যের প্রতি আকর্ষণ তাঁর মধ্যে জাগিয়ে তুলেছিল এবং কত্থক নৃত্য আরও ভালোভাবে শিখে নিয়ে ঐতিহ্যবাহী এই নাচের পেছনের যে বার্তা, সেটা ধরতে পারার জন্য এরপর কয়েক বছর তিনি ভারতে কাটান। বিলেতে ফিরে যাওয়ার পর অন্যান্য অনেক কাজের মধ্যে দেশ মঞ্চনাট্যের ধারণাও তাঁর মাথায় এসেছিল। দেশ হচ্ছে মানুষের, বিশেষ করে সারা বিশ্বের প্রবাসী মানুষের আত্মপরিচয়ের সংকটকে সামনে রেখে তৈরি করে নেওয়া একটি নৃত্যনাট্য। ফলে নিজের জীবনের কথাই এখানে যেন তিনি বলেছেন। দেশ-এর সাফল্য একই এই বার্তা আরও সহজভাবে শিশু-কিশোরদের কাছে কীভাবে পৌঁছে দেওয়া যায়, তা নিয়ে ভেবে দেখায় তাঁকে উৎসাহিত করে এবং এর ফলাফল হিসেবে পরে তিনি কিছুটা সংক্ষিপ্ত ও সহজ সংস্করণ ছোট্ট দেশ নিয়ে মঞ্চে উপস্থিত হন। ছোট্ট দেশ-এর প্রথম মঞ্চায়ন ছিল বিলেতে ২০১৫ সালে। এরপর আরও ১২টি দেশে শতাধিক মঞ্চায়ন এর হয়েছে এবং প্রতিটি দেশেই আকরাম খান তাঁর এই অসাধারণ কাজের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন।
দেশ-এর মতোই ছোট্ট দেশও হচ্ছে একক নৃত্যনাট্য, কত্থক ছাড়াও পশ্চিমের অন্যান্য নাচের মিশ্রণ যেখানে ঘটিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর শুরু একটি টেলিফোন সংলাপের মধ্য দিয়ে, যেখানে নৃত্যশিল্পী চট্টগ্রামের এক কলসেন্টারের এক বালিকার সঙ্গে ফোনালাপে কিছু তথ্য জানতে চাওয়ায় উত্তরে বালিকা তাঁকে পাসওয়ার্ড জানাতে বলে। চমৎকার এই রূপক উপস্থাপনা আমাদের নিয়ে যায় গল্পের গভীরে, যেখানে আমরা জেনে নিতে পারি মূল চরিত্রের অভিবাসী পরিচয় এবং মা-বাবার দেশটির প্রতি যার মনে দেখা দেয় আতঙ্ক আর বিতৃষ্ণা। মা-বাবার সঙ্গে সেই দেশ ভ্রমণে গিয়ে সেখানকার বিভ্রান্তি আর বিশৃঙ্খলা মনের দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়। তবে পরে মায়ের মুখ থেকে শোনা সুন্দরবনের প্রকৃতি আর সেখানকার জীবনের গল্প অন্য এক বাংলাদেশকে তাঁর সামনে নিয়ে আসে। তবে তখনো পর্যন্ত কিন্তু বালক হাবুডুবু খাচ্ছিল দোটানার জীবনে—বাবা একদিকে চাইছেন নিজের রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় ছেলে যেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, অন্যদিকে ছেলে ব্যস্ত তার স্বপ্নের পেশা নৃত্যশিল্পী হতে পারার সাধনায়। সে রকম এক জীবনে সুন্দরবনের মৌয়াল আর বাওয়ালিদের কথা, বনের বন্য প্রাণীদের সঙ্গে প্রকৃতির গড়ে ওঠা সখ্য এবং সর্বোপরি বনের রক্ষক দেবী বনবিবিকে ঘিরে লোকমুখে প্রচলিত অসাধারণ সব কল্পগাথা ভিন্ন এক জগতের দুয়ার তার সামনে খুলে দেয়, যেখানে সে খুঁজে পায় নিজের আত্মপরিচয়। নৃত্যনাট্যে এর সবটাই তুলে ধরা হয়েছে মূল নৃত্যশিল্পীর নাচের পাশাপাশি পেছনের পর্দায় আলোছায়ার অপূর্ব অ্যানিমেশনের মধ্য দিয়ে। সবশেষে আবার আমরা দেখি মঞ্চে নৃত্যশিল্পী টেলিফোনে কলসেন্টারের সেই বালিকাকে দিচ্ছে ভুলে যাওয়া পাসওয়ার্ড, তার মনে আবার ফিরে আসার বার্তা। আর সেই পাসওয়ার্ড হচ্ছে ‘বনবিবি’।
অসাধারণ এই কাহিনিভিত্তিক নৃত্যনাট্যের কোরিওগ্রাফি হচ্ছে আকরাম খানের নিজের রচনা। বাংলাদেশকে সেখানে তিনি উপস্থিত করেছেন ভিন্ন এক চেহারায়, দেশের যে চেহারা আমাদের মনে জোগায় আশা, আমাদের শোনায় আগামীর প্রত্যাশার বাণী। জাপানের তিনটি শহরে মঞ্চ উপস্থাপনার শেষে আকরাম খানের দল এখন ফিরে গেছে বিলেতে। জাপানে এবারের পরিবেশনায় আকরাম খান নিজে ব্যস্ততার কারণে উপস্থিত থাকতে পারেননি। তবে টেলিফোনে তিনি বলেছেন ভবিষ্যতে জাপানের ঐতিহ্যবাহী কাবুকি আর বুদোহ নাচের মিশ্রণ ঘটিয়ে নতুন একটি উপস্থাপনার কোরিওগ্রাফির চিন্তা তিনি এখন করছেন। ফলে ভবিষ্যতে আরও বেশি চমকপ্রদ কিছু দেখতে পারার আশা আমরা অবশ্যই করতে পারি।