এমাজউদ্দীন আহমদ ::
বাংলাদেশের রাজনৈতিক চত্বর সবসময় এত উত্তপ্ত কেন? এখানে যুক্তির পরিবর্তে আবেগের প্রাচুর্য কেন এত বেশি? যারা প্রতিনিয়ত রাজনীতির মাঠ গরম করে রাখছেন, কেন তারা এত সংকীর্ণমনা? এসব প্রশ্নের উত্তর কি কারও জানা আছে? স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও বাংলাদেশ রাজনীতি লাভ করল না এতটুকু স্থৈর্য। এতটুকু স্থিতিশীলতা। বিন্দুমাত্র সৃজনশীলতা। এভাবে চলতে থাকলে এ দেশের বেহাল অর্থনীতির কী হবে? কোন অবস্থায় পৌঁছবে নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান? মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ পাওয়া বাংলাদেশ কোন পর্যায়ে উপনীত হবে? জনগণের প্রাত্যহিক জীবন কি এভাবেই অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকবে?
একটি দেশের অবস্থা আর একটি জনপদের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা শুধু কঠিন নয়, পুরোপুরি সঠিকও নয়। তা জেনেও কিছুটা বাস্তব ধারণার লক্ষ্যে আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ১৮৬১-৬৪ সময়কালীন গৃহযুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। ওই সময়ের যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতিকে ঠাট্টা করে বলা হতো ‘সোনালি যুগ’। এই নামটি গৃহীত হয় ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত মার্ক টোয়েনের একটি উপন্যাসের শিরোনামের অনুকরণে। আজকের বাংলাদেশ যেমন বছরের পর বছর ধরে দুর্নীতি ক্ষেত্রে ছিল শীর্ষস্থানীয়। মার্ক টোয়েনের কাহিনীতে এমনই বিবরণ রয়েছে। কংগ্রেসের সদস্যরা অর্থের
বিনিময়ে নিজেদের প্রভাব বিক্রয় করতেন। অর্থের বিনিময়ে রেলপথ নির্মাতাদের কনট্রাক্ট দিতেন। দিতেন অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন সংস্থায় চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। Credit Mobilier Scandal-এর মতো ঘটনা এরই সাক্ষী। শুধু তাই নয়, সেই ‘সোনালি যুগে’র রাজনীতিও ছিল তীব্রভাবে দলীয়। গৃহযুদ্ধের পরে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক এই প্রধান দুটি দলের সম্পর্ক ছিল সাংঘর্ষিক, অনেকটা বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কের মতোই।
দুই দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের পারস্পরিক সম্পর্কও ছিল মূলত শত্রুভাবাপন্ন। তাদের মধ্যে বাক্যালাপ ও আলোচনা হতো কস্ফচিৎ, যেমন বাংলাদেশে সরকারপ্রধান ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ বা পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা হয় কদাচিৎ। বাংলাদেশের দুটি প্রধান দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা-নেত্রী যেভাবে তাদের প্রতিপক্ষকে মারাত্মক ধরনের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন এবং হাজারো সত্য-অসত্য অভিযোগের ডালা সাজিয়ে একে অপরকে সম্বোধন করেন, যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান দলের নেতৃবৃন্দ প্রায় তেমনই করতেন। কোনো দলের পক্ষেই সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। রিপাবলিকানরা প্রেসিডেন্সি দখলে রেখেছিলেন ১৮৬৮ থেকে শুরু করে ১৯১২ সাল পর্যন্ত। এ সময় শুধু গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। অন্যদিকে, ডেমোক্র্যাটদের দখলে থেকেছে কংগ্রেস এবং অধিকাংশ অঙ্গরাজ্যের আইন পরিষদ।
বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ যেমন বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে, অতীতকে মূলধন করে নির্বাচন পরিচালনা করে থাকেন, বিশেষ করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাদের কী ভূমিকা ছিল তা হাজারবার উচ্চারণ করে, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে অতীতকে বারবার টেনে আনেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তেমনি প্রায় তিন দশক পর্যন্ত অতীতমুখীই থেকে ‘রক্তাক্ত শার্টের’ প্রদর্শনী এবং এর মাধ্যমে দক্ষিণের ভোটদাতাদের স্মরণ করানো হতো যে, তারাই বিচ্ছিন্নতাবাদী। তারাই গৃহযুদ্ধ সংঘটনের প্রধান হোতা। তারাই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঐক্যের শত্রু। তাদের দেশপ্রেম প্রশ্নবিদ্ধ। অন্যদিকে, ডেমোক্র্যাটদের প্রচারণার মূল বিষয় হতো রিপাবলিকানদের সীমাহীন দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং প্রশাসনে অরুচিকর দলীয়করণ। গৃহযুদ্ধ-পরবর্তীকালের যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতির মধ্যে দেখা যাবে ভয়ঙ্কর রকম মিল। দুটিই সম্ভাবনাময় দেশ, কিন্তু রাজনীতিকদের ভাষা ও কার্যক্রমে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। দুটি দেশেই বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাঠামো; কিন্তু কোনো দেশেই এই সময়কালে রাজনীতিকদের মন গণতন্ত্রের জন্য তৈরি হয়নি। দুটি দেশেই রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ বসবাস করেছেন অতীতে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সেই গৃহযুদ্ধ এবং বাংলাদেশে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। ফলে উভয় ক্ষেত্রেই ব্যর্থতা প্রকট হয়ে উঠেছিল। অনিশ্চয়তা মূর্ত হয়েছে। কল্যাণমুখী পদক্ষেপ হয়েছে বিরল।
তিন দশক পরে যুক্তরাষ্ট্রে গভীর এক পরিবর্তন সূচিত হয়। এই পরিবর্তনের মূলে ছিল বৌদ্ধিক বা বুদ্ধিবৃত্তির এক আন্দোলন। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন বহু জ্ঞানী-গুণী-দার্শনিক এবং চিন্তাবিদ। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন উইলিয়ম জেমস, চার্লস পিয়ার্স, মার্ক টোয়েন এবং পরবর্তীকালে জন ডিউয়ি, অলিভার ওয়েন্ডেল হোমস প্রমুখ খ্যাতনামা ব্যক্তি। সেই আন্দোলন ছিল প্রয়োগবাদী। কোন বক্তব্য বা উক্তি বা ধারণা বা নীতি মানবকল্যাণের ক্ষেত্রে কতটুকু প্রাসঙ্গিক, সেই মানদণ্ডে তার বিচার হবে, অন্য কোনো মানদণ্ডে নয়। রাজনীতিকদের ব্যর্থতায় ক্লিষ্ট হয়ে, তাদের আবেগতাড়িত আত্মম্ভরিতায় ক্ষুব্ধ হয়ে, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাদের অনীহায় ব্যথিত হয়ে, বিশেষ করে তাদের অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাদের অনীহায় ব্যথিত হয়ে, বিশেষ করে তাদের অতীত-প্রিয়তায় বিরক্ত হয়ে প্রয়োগবাদিতায় এই দর্শন এসব চিন্তাবিদ তুলে ধরেন জাতির সামনে। চিন্তাবিদদের বুদ্ধিবৃত্তির আন্দোলনের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের বহু বাচনিক বৈশিষ্ট্য, রাজনীতির ওপর জনসমষ্টির অভিভাবকত্ব, বিশেষ করে রাজনীতির বস্তুনিষ্ঠতার সূচনা হয় গৃহযুদ্ধের প্রায় তিন দশক পরে। বাংলাদেশেও এমনি এক বৌদ্ধিক আন্দোলনের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে তীব্রভাবে। বাংলাদেশে রাজনীতিকে হতে হবে সৃজনশীল এক কর্মপ্রবাহ। হতে হবে যুক্তিভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যম। হতে হবে পরিশীলিত এবং রুচিকর এক যৌথ কার্যক্রম।
বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিরাট অংশ এখনও আটকে রয়েছে ‘বৈধতার’ সংকীর্ণ গুহায়। দক্ষতা বা সুষ্ঠু নীতির মানদণ্ডে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল্যায়নে প্রবৃত্ত হতে আমাদের অধিকাংশ নেতা এখনও শেখেননি। শেখেননি বলেই নিজেদের মনগড়া ‘বৈধতার’ প্রশ্নটি সারাক্ষণ আওড়াতে থাকেন। সবার মনে থাকার কথা, ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, ১৯৭৫ সালের পরের সব সরকার ছিল অবৈধ। এই ধারণা পোষণ করেই তিনি ১৯৯১ সালে বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সরকার সম্পর্কে বলেছিলেন, এ সরকারকে একদিনের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেওয়া হবে না। অন্যদিকে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি বিএনপির নেতা-নেত্রীর প্রচণ্ড ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছিল সপ্তম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিনের ওয়াক আউটে। এই অসহিষুষ্ণ অসহযোগিতার মূলে রয়েছে এই জাতির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায় যে মুক্তিযুদ্ধ, সেই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতৃবৃন্দের এক ধরনের বিশ্বাস এবং বদ্ধমূল ধারণা। সেই মুক্তিযুদ্ধকে বিভিন্ন পল্গ্যাটফর্ম থেকে হাজারো লেখক, বুদ্ধিজীবী, ইতিহাসবিদ জনযুদ্ধ রূপে চিত্রিত করলেও আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতার বিশ্বাস, তা আওয়ামী লীগের অর্জন। তাই তাদের বিশ্বাস, মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাংলাদেশকে শাসন করার বৈধ অধিকার একমাত্র আওয়ামী লীগের। অন্য কোনো দলের নয়।
আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তাদের বিশ্বাস, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের একক সৃষ্টিকর্তা। এ ক্ষেত্রে জনগণের ভূমিকা, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বা ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি অথবা মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বা বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডারদের ভূমিকা নেহাত গৌণ। গৌণ স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে জনগণের ভূমিকা। এই একদেশদর্শী ভাবনা-চিন্তার তীব্র প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলসহ সমমনা দলগুলোর অবস্থান অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে মেজর জিয়াউর রহমানের পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা, পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দান, সেক্টরপ্রধান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দান এবং জেড ফোর্সের সংগঠক, এমনকি ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে সংঘটিত সিপাহি-জনতার বিপল্গবের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়ে আধুনিক বাংলাদেশ রচনায় অগ্রণী ভূমিকার বিষয়গুলো বাংলাদেশের রাজনীতি ক্ষেত্রে বৈধতার তীব্র সংকট সৃষ্টি করেছে। এই সংকট এতই তীব্র যে, বিএনপি সরকারের সঙ্গে কোনো সহযোগিতা অথবা আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে কোনো সহযোগিতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কগনিটিভ মানচিত্রে একে অপরের অবস্থানের প্রতি স্বীকৃতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে সেই ১৯৭৫ সাল থেকেই। এভাবে যেমন ১৮৬১-৬৪ সালের গৃহযুদ্ধের সময়কালে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকে সংঘাতময় করে তুলেছিল প্রায় তিন দশক, বাংলাদেশের রাজনীতিও তেমনি সাংঘর্ষিক ও সংঘাতময় হয়ে উঠেছে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের এবং ১৯৭৫ সালের শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময়কাল থেকে। বাংলাদেশে বৈধতার প্রশ্নটি এমনি জটিল ও দৃঢ়মূল যে, শুধু রাজনৈতিক মহল নয়, দেশের বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, এমনকি সংস্কৃতিসেবীরাও এর সঙ্গে সংশ্নিষ্ট হয়ে সমগ্র জনসমষ্টির এক বৃহৎ অংশকে দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলেছে। দেশের প্রতিটি সামাজিক শক্তি এই ইস্যুতে বিভক্ত। বিএনপি সরকার যাই করুক না কেন, ভালো হোক আর মন্দ হোক, আওয়ামী নেতৃত্ব ও সহযোগীরা তার তীব্র সমালোচনা করবেই। অন্য পক্ষে আওয়ামী লীগ যা করবে তার বিরোধিতা বিএনপি ও তার সহযোগীদের পক্ষ থেকে আসবেই। যুক্তরাষ্ট্রেও অনেকটা এমনই হয়েছিল ওই সময়ে।
যুক্তরাষ্ট্র ওই সংকট থেকে অব্যাহতি লাভ করেছিল উনিশ শতকের শেষদিকে গড়ে ওঠা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে। আমরা কি তেমন কিছু করতে পারি না? সত্যি বটে, যে বৈধতার প্রশ্নটি আজ আমাদের জাতীয় জীবনে এক অভিশাপরূপে দেখা দিয়েছে, তার কেন্দ্রবিন্দু হলো শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমান। একটু সুস্থভাবে ভাবলে কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন না যে, এই দুই মহান নেতা আমাদের জাতীয় সম্পদ। এই অর্থে এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আমাদের যেমন জাতীয় সম্পদ, তেমনি জাতীয় সম্পদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলাম। জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন প্রতিভাবান দিশারি আরও আছেন এবং সবাই আমাদের জাতীয় সম্পদ। তারা সব দলের ঊর্ধ্বে। সব সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে। ঊর্ধ্বে সব সংকীর্ণতার। তার পরও আমরা এ সম্পর্কে কোনো ঐকমত্য গঠনে সক্ষম হইনি। হয়তো হবেও না অদূর ভবিষ্যতে।
যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবীরাও তাদের বৃহৎ দুটি দলের নেতৃত্বকে কাছাকাছি আনতে চেষ্টা করেননি। কেননা তাদের ধারণা ছিল, চেষ্টা করলেও কোনো লাভ হবে না। তাই তারা পরামর্শ দিয়েছিলেন, প্রয়োগবাদের মাধ্যমে জনস্বার্থ সম্পর্কিত এবং জাতীয় স্বার্থসংশ্নিষ্ট বিষয়গুলোকে যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করে বিরোধী দল বিরোধিতা করবে কি না, তা ঠিক করুক ও ক্ষমতাসীনরা আকাশছোঁয়া উদারতার আলো চারদিকে ছড়িয়ে দিক এবং বর্তমানকে মহান ও ভবিষ্যৎকে মহত্তর করুক। গৃহযুদ্ধের চার দশকের মাথায় এই আন্দোলনের সেরা সৃষ্টি উড্রো উইলসন এভাবে নতুন নেতৃত্বের প্রতিনিধিরূপে যুক্তরাষ্ট্রের সংঘাতময় রাজনীতিকে ঘৃণাভরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ১৯১৩ সালে তার The New Freedom শীর্ষক বক্তৃতায় বলতে পেরেছিলেন :’এই শ্রেষ্ঠ জাতির শক্তি ও উদ্যোগকে পুরোপুরি মুক্ত করে দিতে হবে। এভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ তার অতীত থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের গৌরব বৃদ্ধি পাবে নতুন নতুন অর্জনের মাধ্যমে। যতদিন যাবে আমেরিকা টের পাবে যে, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের সুসন্তানরা নিয়ে আসবে নতুন নতুন গৌরবগাথা। কেননা এই প্রজন্মের সুসন্তানরা অতীতের চেয়ে অনেক বেশি আলোকিত এবং সমগ্র মানবজাতির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিশ্রুতি, তা পালন করবেন।’ যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের ফলে তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব মাটির কলকোলাহল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে, তারা ভরা আকাশের দিকে দৃষ্টি দিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে আবাহন করতে শিখেছে। অতীতের সংঘাতময় দিনগুলো ভুলে বর্তমানের কর্মময়তাকে ভালোবাসতে শিখেছে। আমাদের রাজনীতির অর্জন যেমন কম নয়, তেমনি বিসর্জনের চিত্রও রয়েছে। অর্জনকে পুঁজি করে গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশে আজকের বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন ছাড়া গত্যন্তর নেই।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়