ব্রিট বাংলা ডেস্ক :: ঢাকায় এসেছেন ব্রাজিলের গ্লোবো টিভির তিন গণমাধ্যমকর্মী। বিশ্বকাপের সময় বাংলাদেশের মানুষের ফুটবল উন্মাদনা আর ব্রাজিল ফুটবল দলের প্রতি এ দেশের মানুষের ভালোবাসা দেখে নিজেরাই বিস্মিত। ব্রাজিলের ফুটবলের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা ব্রাজিলীয়দের চেয়েও বেশি মনে হয়েছে এই তিনজনের কাছে। সে ভালোবাসার কথা ব্রাজিলে পৌঁছে দিচ্ছেন সাংবাদিক ক্লেটন কনজারভানি, প্রযোজক ইগর তাভারেজ ও ক্যামেরাপারসন মাইকেল বেন্টো। তাঁদের বাংলাদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা থাকছে প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে।
সময়টা গত ফেব্রুয়ারির দিকে। ব্রাজিলের এবারের বিশ্বকাপ দলের ফুটবলারদের সই করা জার্সি নিয়ে রাশিয়ায় পর্বতারোহণ করতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন গ্লোবো টিভির রিপোর্টার ক্লেটন কনজারভানি। উদ্দেশ্য, ব্রাজিল দলের জন্য সমর্থন আর শুভকামনা সংগ্রহ। ঠিক তখনই ঢাকার ব্রাজিল দূতাবাস থেকে বাংলাদেশ সফরের প্রস্তাব পেলেন। ভাবলেন, রাশিয়ায় যেহেতু যাবেনই আরেকটা গন্তব্যে যাওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশ সম্পর্কে বলতে গেলে তেমন কিছুই জানতেন না ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় স্যাটেলাইট চ্যানেল গ্লোবো টিভির এই সাংবাদিক। তাই ক্লেটন জানতে চাইলেন, বাংলাদেশে যে আসবেন গল্প কী হবে! তখন ঢাকার দূতাবাস তাঁর কাছে ছবি আর ভিডিও পাঠায়। ছবি আর ভিডিও দেখে তিনি বুঝলেন গত বিশ্বকাপটা বাংলাদেশের মানুষ কীভাবে উপভোগ করেছেন। এসব দেখে তো মুগ্ধ ক্লেটন কনজারভানি।
গ্লোবো টিভির পরিচালককে বাংলাদেশ সফরের প্রস্তাবের কথা বললেন। জানালেন, স্টেশনের জন্য বড় একটা গল্প হতে পারে বাংলাদেশ। রাজি হয়ে গেলেন স্টেশনের পরিচালক। এরপর প্রযোজক ইগর তাভারেজ আর ক্যামেরাম্যান মাইকেল বেন্টোকে নিয়ে বাংলাদেশ যাত্রার মিশন শুরু ক্লেটনের।
বিশ্বকাপ ফুটবল, বিশেষ করে ব্রাজিল নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ কতটা আবেগতাড়িত, তা নিজেরা দেখতে আর ব্রাজিলের লোকজনকে দেখাতে ১৪ জুন থেকে ১০ দিনের সফরে বাংলাদেশে আসে গ্লোবো টিভির দলটি।
জোয়াও তাবাজেরা অলিভেইরা ডি জুনিয়র নানা ক্ষেত্রে দুই দেশকে আরও কাছে আনার দায়িত্ব নিয়ে ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত হিসেবে ঢাকায় আসেন। এটা করতে হলে ব্রাজিলকে বাংলাদেশের কাছে আর বাংলাদেশের কাছে ব্রাজিলকে তুলে ধরা জরুরি। জোয়াও তাবাজেরা বলেন, ‘এমন ভাবনা থেকে আমার মনে হয়েছে, ব্রাজিলের ফুটবলের দলের প্রতি এ দেশের লোকজনের ভালোবাসা আমার দেশে বাংলাদেশকে তুলে ধরার মোক্ষম সুযোগ। বিশ্বকাপে এই ভালোবাসা থেকে লোকজন বুঝে নেবে, এত দূরের একটা দেশের এমন গভীর ভালোবাসা। আমি তো নিশ্চিত, এটা বাংলাদেশকে নিয়ে ব্রাজিলে নতুন করে ভাবার রসদ জোগাবে। আগ্রহ তৈরি করবে।’
এরপর তিনি মার্চে ঢাকায় উপরাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে ক্লেটনের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। পাঠানো হলো ছবি ও ভিডিও। এসব দেখে কয়েক দফা যোগাযোগ শেষে বড় গল্পের খোঁজে গ্লোবো টিভির তিন সদস্য চলে এলেন বাংলাদেশে।
ক্লেটন কনজারভানির মতো প্রযোজক ইগর তাভারেজেরও এই প্রথম বাংলাদেশে আসা। নির্দ্বিধায় স্বীকার করলেন, আসার আগে বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। আসার পর কী হলো? ইগর বললেন, ‘আমি তো এককথায় মুগ্ধ আর বিস্মিত। আচরণ, ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা, লোকজনের চেহারায় এমন মিল আমি তো ভাবতেই পারি না।’ তাঁর ভাষায়, এখানকার মানুষের উষ্ণতা আর আতিথেয়তার কোনো তুলনা হয় না। দেশে ফিরে লোকজনকে জানাবেন ১৬ হাজার কিলোমিটার দূরের দেশ সম্পর্কে, যে দেশের মানুষ ফুটবল সম্পর্কে এতটা জানে যা ব্রাজিলের লোকজনও হয়তো জানে না!
‘অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশের লোকজনের ব্রাজিলের প্রতি ভালোবাসাটা ব্রাজিলীয়দের চেয়ে বেশি।’ ২০ জুন ঢাকার একটি হোটেলে এমনটাই বললেন ইগর। অন্তত গত কয়েক দিন এখানে ঘুরে তাঁর এমনটা মনে হয়েছে। ইগর যোগ করেন, বিশেষ করে গত বিশ্বকাপে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে শোচনীয় হারে ব্রাজিলের লোকজন মুষড়ে পড়েছে। তা ছাড়া রাজনীতি, অর্থনীতিসহ নানা সংকটে মানুষ দেশ নিয়ে, ফুটবল নিয়ে কিছুটা হতাশ তো বটেই। যেই আমরা ম্যাচ জিততে শুরু করব, ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে শুরু করবে। এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই, ফুটবল হচ্ছে ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় পরিচয়।
ভিডিও আর ছবি দেখে ক্লেটন কনজারভানির যে মুগ্ধতার শুরু এখানে আসার পর থেকে তা বেড়েছে। মুগ্ধতার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি ১৯ জুনের চট্টগ্রাম সফরের প্রসঙ্গ টানলেন। ক্লেটন কনজারভানি বলেন, বন্দরনগরীর আগ্রাবাদে ছোটদের এক প্রীতি ম্যাচ চলছিল। লক্ষ করলাম, ব্রাজিলের জার্সি গায়ে তাদের প্রত্যেকেই কতটা গর্বিত। তাদের চোখে চোখ রেখে বুঝেছি, ব্রাজিলের প্রতি তাদের ভালোবাসা আমাদের অনেক নাগরিকের চেয়েও বেশি। ৭-১ হারটা তারা মনেই রাখেনি। ১৬ হাজার কিলোমিটার দূরের একটা দেশ ব্রাজিলকে এতটা ভালোবাসে! বদলি হিসেবে একজনকে কোচ উঠিয়ে নেন, পারলে ছেলেটি কেঁদে ফেলে। কারণ, তাকে ব্রাজিলের জার্সিটা খুলতে হচ্ছিল। কখন যে আমার চোখের কোণে পানি এসে জমল বুঝতেই পারিনি!
মানিকগঞ্জে ২০ জুন গ্লোবো টিভির তিনজনকে পেয়ে স্থানীয় মানুষজন যেন ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের হাতের মুঠোয় পেয়েছিল। ‘ব্রাজিলের মতো এখানেও দেখলাম লোকজন সবুজ আর হলুদে নিজেদের নিজেদের রাঙিয়ে তুলেছে। একসময় তো ভুলেই গিয়েছিলাম আমি কি রিও ডি জেনেরিওতে আছি, নাকি বাংলাদেশের মানিকগঞ্জে আছি। মনে হচ্ছিল আমি ব্রাজিলেই আছি, কানে বাজছে একই সুরের মূর্ছনা। একসঙ্গে গাইছি, নাচছি। সত্যি করে বললে এই অনুভূতিটা না বলে বোঝানো যাবে না। বাংলাদেশে না এলে এই অভিজ্ঞতা আমার হতো না।’ বললেন ক্লেটন কনজারভানি।
বাংলাদেশ আর ব্রাজিলের মধ্যে মিলের প্রসঙ্গও টানলেন ক্লেটন। দুর্নীতি, ধনী-গরিবের চরম বৈষম্যের ক্ষেত্রে মিল আছে। ‘তবে একটা জায়গায় দারুণ মিল, সেটা সুখের দৃষ্টিকোণ থেকে। গরিব হলেও সুখী। সব সময় হাসিখুশি ভাবটা থাকছে। মূল বার্তাটা হচ্ছে সুখী হতে চাইলে আপনার বড়লোক না হলেও চলবে। মানুষের মধ্যে এত ভালোবাসা, এত উন্মাদনা কোথাও দেখিনি।’
বাংলাদেশের গল্পটা যে ব্রাজিলের লোকজনকে স্পর্শ করবে, টানবে তা নিশ্চিত ক্লেটন কনজারভানি। ‘তাঁরা প্রথমে তো এটা দেখেও বিশ্বাস করতে চাইবেন না। শুরুতে যে আমার কাছেই সবকিছু অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল!’
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার অ্যান্ড সাপোর্ট সার্ভিসেস টেকনোলজিসের (সিএএএসটি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফজলে এ সিদ্দিকের কাছে গ্লোবো টিভির বাংলাদেশ সফরের প্রস্তাবটা তোলেন উপরাষ্ট্রদূত। ব্রাজিলের কূটনীতিক ওই সফরে তহবিলের সংকটের কথা জানান। এটা জানার পর সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় সিএএএসটি। ফজলে এ সিদ্দিক বলেন, ‘দুই দশকের ব্যবসার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, দুই দেশের মধ্যে বেশ কিছু মিল থাকার পরও সেভাবে আমরা একে অন্যকে জানি না। তা ছাড়া কাজের জন্য প্রতিবছরই ব্রাজিলের লোকজন এখানে আসেন। বিদায় নেওয়ার সময় তাঁদের চোখ মুছতে দেখি। এসব ভেবে মনে হয়েছে, সাংবাদিকদের এই সফর দিয়ে বাংলাদেশকে তুলে ধরার একটা ভালো সুযোগ আছে।’
এটা যে সত্যিই, এক ভালো সুযোগ তা বেশ ভালোই বোঝা গেল গ্লোবো টিভির সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে। ফুটবল—এই একটা উপলক্ষই যেন ঘুচিয়ে দিয়েছে ১৬ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব।