বিদায় ধ্রুবতারা!

ফারজানা ইসলাম লিনু

অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনার সুত্র ধরে দিকহারা সিলেট গ্রামার স্কুল পরিবার। ঘোর অমানিশা ও হতাশার অন্ধকার রুখতে আলোর মশাল হাতে এগিয়ে এলেন এক নিঃস্বার্থ আলোকবর্তিকা। আলোর মিছিলে যুক্ত হলেন স্কুলের হিতৈষী আরো কিছু সিনিয়র শিক্ষক। অসম বয়সী পিতৃসম সিরাজুল ইসলাম ফারুক স্যারের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শুরু হলো শক্ত হাতে হাল ধরার লড়াই।

ডুবন্ত প্রায় তরী আমাদের তীরের নাগাল পেলো। সেই তরী আর থেমে থাকেনি এক মুহুর্তের জন্য। একের পর এক বাধা ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে চলে সম্মুখ পানে।

আজ থেকে ষোল বছর আগে ফারুক স্যারের সাথে আমাদের কর্ম জীবন শুরু হলেও বিগত এগারো বছর থেকেই তিনি আমাদের সর্বময় অভিভাবক। অর্থনীতিতে পড়াশোনা করে ইংরেজি, উর্দূ ও বাংলা সাহিত্যে আকন্ঠ ডুবেছিলেন তিনি। মহাকবি ইকবাল, জালালুদ্দিন রুমি কাহলিল জিব্রান, ওমর খৈয়াম, রবীন্দ্রনাথের রচনাবলী ছিলো স্যারের নখদর্পনে।

রবীন্দ্রনাথের”দুই বিঘা জমি” থেকে উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে স্যারের সাথে পছন্দের লাইন মিলে গেলো…. “মনে ভাবিলাম ভগবান মোরে রাখিবে না মোহগর্তে, তাই লিখে দিলো বিশ্ব নিখিল দু’ বিঘার পরিবর্তে।” অবাক বিস্ময়ে শুনেছিলাম লাইনগুলোর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা।

সাহিত্য সাধনায় কি অন্তর্নিহিত অন্তর্দৃষ্টি!!

সাদাত হোসেন মান্টোর “লাইসেন্স” নিয়ে কথা হয়েছে। অরুন্ধতীর “The Ministry of Utmost Happiness ” আমার হাতে দেখে সমালোচনা করেছিলেন। আমি তখন ডুবে আছি অরুন্ধতীর বইয়ে। ভালো লাগেনি বিরক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু যৌক্তিক সমালোচনায় মুগ্ধতা ছিলো, স্বীকার করতে হয়।

সত্য বলায় কোন রাখ ঢাক ছিলো না।

সবচেয়ে বেশি বিরক্ত ছিলেন হুমায়ুন আহমেদের “দেয়াল” উপন্যাসের উপরে।

একদিন Daughter of the East পড়তে দেখে বলেছিলেন, আত্মজীবনী পড়লে জওহরলাল নেহেরুর “An Autobiography” পড়। বিশাল সাইজের বই। অনেক দিনে শেষ করেছিলাম। ইচ্ছে করেই একটু সময় নিয়ে পড়লাম। যে কোন পাতার যে কোন বিষয় নিয়ে স্যারের মুখোমুখি হলে উপায় নেই। পঞ্চাশ, ষাট বছর আগের পড়া বইও যে স্যারের স্মৃতিতে উজ্জ্বল।

আমার অতিমাত্রায় ডানপিটে মেঝো কন্যার ব্যাট বলের যন্ত্রণায় আমি অতিষ্ঠ। কি ঘরে, কি স্কুলে অষ্টপ্রহর ক্রিকেট, ফুটবল। বাসায় মেনে নিলেও স্কুলে ভয়ে আড়ষ্ট আমি, না জানি কখন স্কুলের দরজা জানালায় আঘাত লাগে। কিন্তু স্যারের স্নেহের সমর্থনের কারণে স্কুলে আমি মিতুলের ব্যাট বল পিটানো বন্ধ করতে পারিনা।

ক্লাস সিক্সে থাকতে মিতুলের তাৎক্ষনিক কি একটা লিখায় মুগ্ধ হয়ে হাতে ধরিয়ে দিলেন ভিক্টর হুগোর “Les Miserables”। দস্যু কন্যা আমার দিন কয়েকের জন্য শান্ত হয়ে গেলো। দুষ্টামি রেখে সময়ে অসময়ে Les Miserables তার হাতে। তারপর একে একে The Kite Runner, A Thousand Splendid Suns, আরো কতো বই।

শিক্ষার্থী এমন কি শিক্ষকদের মাথায় ঝড় তোলার সম্মোহনী শক্তি ছিলো স্যারের। অভিনব বিষয়বস্তু ও সুক্ষ্ম মনস্তত্ত্বের ভিত্তিতে শিক্ষার্থী বা শিক্ষকের হাতে ধরিয়ে দিতেন লিখার বিষয়। লিখা পরবর্তী আলোচনায় উঠে আসতো তার অনুসন্ধিৎসা।

সমসাময়িক ও পারিপার্শ্বিক কৌতুহল তাকে চির সবুজ করে রেখেছিলো। তিনি ছিলেন আমাদের চিরহরিৎ বটবৃক্ষ। বার্ধক্য তার মনের কাছে ভীড়তে না পেরে ফিরে গিয়েছে বার বার।
শিশুদের সাথে ভাবের আদান প্রদানে কোন ভিন্নতা ছিলো না। তাইতো শিশুদের কাছেও সমান জনপ্রিয় ছিলেন।

সময়ের যথাযথ ব্যবহারে ছিলো না কোন আপোষ। নিজে সময়ানুবর্তিতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সহকর্মী ও ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ প্রদান করতেন। নিষ্ঠা ও নৈপুন্যের মাধ্যমে স্কুল নিয়ে সুদূরপরাহত কিছু স্বপ্নকে হাতের নাগালে আনতে সক্ষম হন এই কাজ পাগল মানুষটি।

বহুমুখী প্রতিভার একজন মানুষ নিয়ে লিখে শেষ হবে না

ার্মিক হলেও ছিলেন ধর্মান্ধতার উর্ধ্বে। বই পাগল, প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী এই ব্যক্তির সান্নিধ্য আমাদের দিয়েছে দুইহাতে।

১২ অক্টোবর, ২০১৯ সালের প্রত্যুষের খবরটা যদি মিথ্যা হতো, ভ্রম হতো, স্বপ্ন হতো, যদি প্রতিবারের মতো তিনি ফিরে আসতেন আমাদের মাঝে? কম্পিউটার খুলে জমা দেয়া ফাইনাল টার্ম এসেসমেন্টের প্রশ্ন নিয়ে বসতেন?

প্রশ্নের সেটিং, লাইন, এলাইনমেন্ট থেকে শুরু করে বিষয়বস্তু, বানান, সৃজনশীলতা কিছুই বাদ পড়তো না তার পরীক্ষণ থেকে। সুক্ষ্ম দুরদৃষ্টি উপেক্ষা করে অতি ক্ষুদ্র কোন ভুলেরও টিকে থাকার সুযোগ ছিলো না।

নির্ভুল কাজ করতে করতে আমাদের ভুলের মাত্রা প্রায় তলানিতে, এমন সময় তিনি চলে গেলেন। আর কিছুটা বছর তার সান্নিধ্য আমাদের বড় দরকার ছিলো। আজ আমরা অভিভাবকহীন।

কিন্তু তার অভিভাবকত্ব আমাদের মাথার উপর আজীবন ছায়া হয়ে থাকবে। প্রতিটা কর্মে, প্রতিটা সৃজনে স্যারের উপস্থিতি জানান দিবে সিরাজুল ইসলাম ফারুক স্যার আছেন, ছিলেন, থাকবেন।

সিলেট গ্রামার স্কুলের আকাশের এই ধ্রুবতারা কোন দিন ম্লান হবার নয়।

ওপারে অনেক ভালো থাকবেন, স্যার।

মহান আল্লাহ আপনাকে বেহেশতের সম্মানিত স্থানে অধিষ্ঠিত করুন, আমিন।

ফারজানা ইসলাম লিনু, গল্পকার ও সিনিয়র শিক্ষক সিলেট গ্রামার স্কুল

Advertisement