এসব স্টেডিয়াম নির্মাণ বা সংস্কারের জন্য উন্নত কারিগরি জ্ঞান আহরণ করতে কর্মকর্তারা বিদেশ ভ্রমণ করেন। এ নিয়ে তাঁরা কোনো সংকোচ অনুভব করেন বলে শোনা যায়নি। এ যেন অতি স্বাভাবিক ঘটনা, আবশ্যকীয় ব্যাপার।
৪ মে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা সফরে গেছে ছয় সদস্যের একটি সরকারি প্রতিনিধিদল। দলে আছেন ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপপ্রধান, বিকেএসপির মহাপরিচালক, উপপরিচালক এবং প্রধান ফুটবল প্রশিক্ষক। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) প্রমীলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য অবকাঠামো ও পরিকাঠামোগত জ্ঞান আহরণ। এই প্রকল্পের দুটি অংশ—ফুটবল ও ক্রিকেট। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় এই দল গেছে ফুটবলের কাজে। কদিন পর ক্রিকেটের জন্য ভারত ও শ্রীলঙ্কা সফরে যাবে আরেকটি দল। দুটি সফরের আনুমানিক ব্যয় ৫০ লাখ টাকা। বিকেএসপির মহাপরিচালকের কাছে টাকার চেয়ে বহুগুণ মূল্যবান এই সফর থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা।
প্রায় একই সময়ে নয় সদস্যের আরেকটি সরকারি প্রতিনিধিদল গেছে ভারত সফরে। জাতীয় টেনিস কমপ্লেক্সের ব্যাপক সংস্কার হবে, দেশে প্রথমবারের মতো বানানো হবে আন্তর্জাতিক মানের ক্লে-কোর্ট। সুতরাং জ্ঞান আহরণ ও অভিজ্ঞতা অর্জন দরকার। ক্রীড়া পরিষদের সচিব তাই ভারত সফরে গেলেন চারজন প্রকৌশলী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দুই কর্মকর্তা ও টেনিস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদককে সঙ্গী করে। দিল্লি যাওয়ার পথে কলকাতায় যাত্রাবিরতিকালে সফরকারী দল ঘুরে দেখেছে ইডেন গার্ডেন। দেখা থেকে শেখা জ্ঞানটা পরে কাজে লাগানো যাবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের সংস্কারকাজে। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই ক্রীড়া পরিষদ প্রায় ৯০ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে শুরু করবে কাজটা।
এ রকম সফর হরহামেশাই হয়। কখনো জানা যায়, কখনো যায় না। ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এ ধরনের সফর আড়ালে রাখতে পছন্দ করে। অনেক দিন আড়ালে থাকা আরেকটি সফরের কথা জানা গেছে সম্প্রতি। সেটিও ওই বিকেএসপিকেন্দ্রিক। বেশ বড়সড় একটি দল নিয়ে গত বছর চীন ঘুরে এসেছেন বিকেএসপির মহাপরিচালক সামছুর রহমান। তাঁর সঙ্গী ছিলেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব আজিজুল হক। যিনি ওই সময় মন্ত্রণালয়ের যুব শাখার কাজ দেখতেন।
চীনের লিয়াওনিং প্রদেশের শেনইয়াং ক্রীড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিল এই সফরকারী দল। উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম দেখা, জ্ঞান আহরণ করা। প্রশিক্ষণ কর্মসূচির বিনিময়মূলক একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষরও করেছিল দুটি ক্রীড়াশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শোনা গিয়েছিল, শেনইয়াং ক্রীড়া বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ থেকে ক্রিকেটের কোচ নেবে, বিনিময় করবে অ্যাথলেটিকস বা জিমন্যাস্টিকসের কোচ। বাস্তবে কাজ হয়নি কিছুই। সেই সমঝোতা স্মারক এখন হিমাগারে।
পেলে-ম্যারাডোনার দেশ সফরটাও ফলদায়ক কিছু হবে বলে মনে করেন না ক্রীড়াঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা। অনেকেই বলছেন, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা মেয়েদের ফুটবলে শীর্ষ সারির দেশ নয়। ব্রাজিলের মার্তা বিশ্ব প্রমীলা ফুটবলের মহাতারকা হতে পারেন, কিন্তু তাঁর দেশ এখনো মেয়েদের বিশ্বকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। আর্জেন্টিনা তো দূর অস্ত। আর সফর করে এসে একটি প্রতিবেদন দেওয়াই যথেষ্ট নয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী কাজ হওয়াটাই আসল। বিকেএসপির বর্তমান মহাপরিচালকের চাকরির মেয়াদ আছে আর দুই মাস। প্রকল্প পরিচালক ও বিকেএসপির উপপরিচালক অবসরে যাবেন চার মাস পরে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ঘুরে এসে সেই অনুযায়ী প্রকল্পের বাস্তবায়ন করতে গেলে এঁদের দুজনের নিবিড় তত্ত্বাবধান দরকার হবে। কিন্তু এঁরা তো খুবই অল্প সময়ের মধ্যে বিকেএসপির দৃশ্যপট থেকে সরে যাবেন। তারপর কী হবে? ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা থেকে আহরিত জ্ঞান বাক্সবন্দী হয়ে পড়বে। মাঝখান থেকে অযথা খরচের খাতায় লেখা থাকবে বড় অঙ্কের টাকা। যে টাকা আসলে জনসাধারণের, জনসাধারণের করের টাকা।
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সংস্কারকাজের জন্য ভারত ভ্রমণও ব্যতিক্রমী কিছু নয়। ব্যতিক্রমী নয় এ জন্যেই যে সবাই জানে, স্টেডিয়ামটিকে ভালো রাখার জন্য কী করতে হবে। সেটি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন। ব্যবস্থাপনা একটি চলমান প্রক্রিয়া। আপনি সুন্দর ব্যবস্থাপনার জন্য বার্ষিক বরাদ্দ রাখেন। বরাদ্দ অনুযায়ী কাজ করলে ফ্লাডলাইট এখন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ত না। একটি বাল্ব নষ্ট হলে নতুন একটি লাগিয়ে দিন। একটি রিফ্লেক্টরের (আলোবর্ধক যন্ত্রাংশ) কর্মক্ষমতা কমে গেলে সেটি পাল্টে ফেলুন। তা না করে দুই-তিন বছর পর কোটি কোটি টাকা খরচ করাটাকে টাকার শ্রাদ্ধই বলে মনে হয়।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে কাজ করেছেন এ রকম অনেক কর্মকর্তার সঙ্গে মাঝেমধ্যেই কথা হয়। তাঁদের অনেকেই বর্তমানে সরকারের সচিব হিসেবে কর্মরত। কেউ কেউ অবসরেও গিয়েছেন। এমন কাউকে পাওয়া যায় না, যিনি ক্রীড়া পরিষদের পরিকল্পনাকে সঠিক বলেন। ক্রীড়া পরিষদের প্রসঙ্গ উঠতেই একজন বলেন, ওই প্রতিষ্ঠানের নাম হওয়া উচিত নির্মাণ পরিষদ। ওখানে স্থাপনা নির্মাণের কাজ ছাড়া দরদ দিয়ে আর কোনো কাজ করা হয় না।
আর অবকাঠামো বা পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য কর্মকর্তাদের এই ভ্রমণকে কী বলবেন? জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোর অনেক কর্মকর্তার চোখে এটি স্রেফ প্রমোদভ্রমণ। সাবেক খেলোয়াড়, প্রশিক্ষক বা ক্রীড়া প্রশাসনের সাবেক কর্মকর্তাদের অনেকে একটু ভিন্নমত পোষণ করেন। কেউ কেউ বলেন, সফর কখনো কখনো কাজে লাগে, যদি সফরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর সদিচ্ছা থাকে। সেদিন সাবেক একজন ক্রীড়া প্রশাসক সখেদে বলছিলেন, ‘আপনারা বিদেশ ঘোরেন ক্ষতি নেই, কিন্তু দেশকে কিছু দেন। পাবলিক মানি খরচ করে দেশের জন্য একটু কাজ করেন।’
ইট-কাঠ-কংক্রিটে নির্মিত বোবা ক্রীড়া অবকাঠামোগুলোও অব্যক্ত ভাষায় এটাই হয়তো বলে: হে দেশের ক্রীড়া প্রশাসকগণ, আপনারা বিদেশ ভ্রমণ করুন, বিদেশ থেকে জ্ঞান অর্জন করে আসুন, কিন্তু দেশের মঙ্গলের জন্য অন্তত কিছু করুন!