বিলেতে বঙ্গবন্ধু – ২ বঙ্গবন্ধু ছানু মিয়াকে জড়িয়ে বললেন, শেখ মুজিব আর বাচতে চায় না!

আ স ম মাসুম, যুক্তরাজ্য : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৃতীয় বারের মতো বৃটেন আসেন ১৯৬৩ সালের আগষ্ট মাসে।

৮ আগষ্ট ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে তখনকার প্রবাসী কমিউনিটি নেতা আব্দুল মান্নান ছানু মিয়ার ২৯ সেন্ট মেরিজ অ্যাবোট টেরাসের আথিতেয়তা গ্রহন করেন।
এই সফরটি মূলত ছিলো লন্ডন সফররত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে আলাপ আলোচনার জন্য ছিলো।

১৯৬৩ সালের ১১ মার্চ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী জুরিখে চিকিতসার জন্য এলে আগস্ট মাসে এক সংক্ষিপ্ত সফরে ব্রিটেনে আসেন তিনি।
এই সফর সম্পর্কে লেখক, রাজনীতিবিদ নুরুল ইসলাম লিখেছেন, “… এমনি করে একদিন মান্নান সাহেবের গ্রীন মাস্ক রেস্তোরার বেইসমেন্টে খাওয়া দাওয়া করতে করতে ওস্তাদ সোহরাওয়ার্দী ও সাগরেদ শেখ সাহেবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ন আলোচনা চলছে।

মান্নান সাহেব কাছে বসে খানা পরিবেশন করছেন। এক সময় শেখ সাহেব বেশ জোড়েই বলে উঠলেন, “স্যার আপনি বা মাওলানা সাহেব ( মাওলানা ভাসানী ) যেই হোন না কেনো পাকিস্থানের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী, আপনারা কোন অবস্থায়ই ইষ্ট পাকিস্থানকে বাচাতে পারবেন না। কারন, ওয়েস্ট পাকিস্থান ইষ্ট পাকিস্থানকে গিলতে বসেছে। ইষ্ট পাকিস্তানকে একদিন না একদিন আলাদা হতেই হবে”।
এমনি গর্জে উঠলেন সোহরাওয়ার্দী সাহেব। “ ডোন্ট টক ননসেন্স” অর্থাত বাজে কথা বলো না। আর অগ্নিশর্মা চোখে চেয়ে রইলেন শেখ সাহেবের দিকে। শেখ সাহেব চুপ হয়ে গেলেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেবও চুপ হয়ে রইলেন কিছুক্ষন। তারপর ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন : কি আছে তোমাদের যে আলাদা হয়ে যাবে? পারবে ওদের সাথে যুদ্ধ করে আলাদা হতে? ১৯৫৪ সালে ৯৭ ভাগ ভোট পেয়েওতো ২ মাসের বেশি মন্ত্রীসভা টিকিয়ে রাখতে পারলে না। এখন একবারে আলাদা হয়ে যাবে! আর না হয় আলাদা হয়েই গেলে, তখন তোমার দেশের আর্থিক অবস্থার কি হবে? কোরিয়ান বুমতো আর নেই যে পাটের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় চালিয়ে দেবে দেশের অর্থনীতি। চলবে কি করে তোমাদের?
এবারে শেখ সাহেব আস্তে আস্তে মাথা তোলে বললেন, স্যার, এখনো ৯৭-৯৮ ভাগ বাঙ্গালী আমাদের ডাকে সারা দেবে। তবে সে ডাক হবে স্বাধিকারের ডাক। আর স্বাধিকারের ডাকে দেখা দেবে গন আন্দোলন। আন্দোলন সৃষ্টি করতে পারলে অস্ত্রের প্রয়োজন হবে না। বাশের লাঠিই যথেষ্ট।

তারপর মান্নান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, আর এই হাজার হাজার প্রবাসী বাঙ্গালী যাদের আপনি পাসপোর্ট দিয়ে পাঠিয়েছেন, তারা জোগাবে আমাদের বৈদিশিক মুদ্রা-তারাই গড়ে তুলবে বিশ্বজনমত বাংলার স্বাধীনতার পক্ষে।আশ্চর্যজনক হলেও বঙ্গবন্ধুর সেই আস্থার প্রতিদান দিয়েছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা! এই কথা বলার ৯ বছর পর যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন ব্রিটেনেব্যাপী প্রবাসী বাংলাদেশীরা ব্যাপক আন্দোলন – লবিং শুরু করে বিশ্ব জনমত আদায়ে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখেন।

আর স্বাধীন বাংলাদেশ, যাকে বলা হয়েছিলো তলাবিহীন ঝুড়ি, সেই বাংলাদেশের প্রথম রিজার্ভের সাড়ে ৪ কোটি টাকার মধ্যে ৪ কোটি টাকারই জোগান দিয়েছিলেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশীরা!

১৯৬৩ সালের ২০ দিনের সেই সফরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একদিন ততকালীন প্রবাসী নেতা জাকারিয়া খান চৌধুরীরর অনুরোধে ইষ্ট পাকিস্থান হাউসে যান এবং সেই উদ্যোগের প্রসংশা করে বলেন, ইষ্ট পাকিস্থান হাউস এক সময় পাকিস্থানের দাবি দাওয়া আদায়ের সংগ্রামে অংশীদার হবে এবং তিনি এর নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ রাখবেন বলে আশ্বাস দেন।
মূলত ওয়েষ্ট পাকিস্থান ও ইষ্ট পাকিস্থানের ছাত্ররা যাতে ব্রিটেনে পড়তে আসার পর থাকার জন্য পাকিস্থান হাউস ছিলো। কিন্তু সেখানেও ইষ্ট পাকিস্থান থেকে পড়তে আসা বাঙ্গালী ছাত্রদের নানা উতপাত ও যন্ত্রনা করতো। সেকারণে অতিষ্ট হয়ে বাঙ্গালী ছাত্ররা, প্রবাসী কমিউনিটি নেতৃবৃন্দর সহায়তায় ১৯৬৩ সালে ইষ্ট পাকিস্তান হাউস প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়।
১৯৬৩ সালের সেই সফর সম্পর্কে জাকারয়িা খান চৌধুরী তার স্মৃতিচারনে বলেন, প্রথম দেখায় কোন ভূমিকা ছাড়াই আমি পরিস্কার ভাষায় তার কাছে আমাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য, স্বাধীনতার কথা উত্থাপন করি। আমার আশঙ্কা ছিলো তিনি এর বিরোধীতা করবেন। কিন্তু শেখ মুজিব আমাদের আশ্চর্য করে দিলেন এই বলে যে, তিনিও স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন।তবে তার ভূমিকা হবে গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাওয়া। আমরা যেনো আমাদের মতো সশস্ত্র সংগ্রামের পথে এগিয়ে যাই। এই সমঝোতার ভিত্তিতে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আমার এক নিবিড় ও স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে উঠে, যা স্বাধীনতা কাল পর্যন্ত অটুট ছিলো। তখন কয়েকবার তিনি আমাকে সাথে নিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাড়া বাড়ীতে আলাপ-আলোচনার জন্য নিয়ে যান।
১৯৬৩ সালের ২৮ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে যাওয়ার সময় তিনি আব্দুল মান্নান ছানু মিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে যান, মান্নান সাহেব, শেখ মুজিব আর বাচতে চায় না। দেশের মানুষের স্বাধিকার আদায় না করে বেচে থাকার কোন অধিকার নেই। এর চেয়ে জালেমদের সাথে লড়াই করে মরে যাওয়াই শ্রেয়!
ব্রিটেনে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে আপনজন, হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার কৃতি সন্তান এই আব্দুল মান্নান ছানু মিয়াকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রবাসী এমপি হিসাবে জাতীয় সংসদে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু!

তথ্যসূত্র : বিলেতে বাংলার রাজনীতি, লেখক : ফারুক আহমদ

Advertisement