বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষার্থী নিপীড়ন

কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিভিন্ন দল ও মতের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে, যার মধ্যে ক্ষমতাসীন সরকারের শিক্ষার্থী সংগঠনের উপস্থিতিও ছিল। ইতিমধ্যে সংসদে প্রধানমন্ত্রী কোটা একেবারে বাতিলের ঘোষণা দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের বিজয় মিছিল উদ্যাপিত হয়েছে। নানাবিধ বিতর্কের একপর্যায়ে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শীর্ষ ব্যক্তিত্বরা কোটা সংস্কার আন্দোলনে তাঁদের সমর্থনও জ্ঞাপন করেছেন। কিন্তু সম্প্রতি কোটা সংস্কারের জন্য প্রজ্ঞাপন দাবি করা হলে হঠাৎই নানামুখী দমনচেষ্টা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জমায়েতে সহিংস আক্রমণ, হাতুড়ি দিয়ে হাড় ভেঙে দেওয়া, আন্দোলনে অংশ নেওয়া নারী কর্মীদের শারীরিকভাবে ও সাইবার পরিসরে যৌন নিপীড়ন, গ্রেপ্তার ও রিমান্ড।

তবে এবার রাষ্ট্রশক্তির পক্ষে রাজশাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক-উপাচার্য কোটা সংস্কার আন্দোলনে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের ‘বাম ঘরানার শিবির’ (বাশি) ও ‘জঙ্গি’ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টার মধ্য দিয়ে আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুন মাত্রা যোগ করলেন। এর আগে একবার রাষ্ট্রশক্তির পক্ষ থেকে তাদের ‘রাজাকার’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অবশ্য দুদিন পরেই সরাসরি ‘জঙ্গি বলেননি’, কিন্তু জঙ্গিদের কার্যকলাপের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের মিল আছে বলেছেন বলে গণমাধ্যমে জানিয়েছেন। তারপরও বলা যায়, এই দুই শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক কয়েক ধাপ এগিয়ে এভাবে শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্র বা সরকারের শত্রু হিসেবে জনপরিসরে পরিচিতি দেওয়ার চেষ্টা করলেন।

এই চেষ্টার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৯ জুলাই গণমাধ্যমে পাঠানো প্রভোস্ট কমিটির একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি। এই বিজ্ঞপ্তিতে কোনো সুস্পষ্ট সংজ্ঞায়ন ছাড়াই ‘বহিরাগত’ শব্দটির ব্যবহার এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাদের প্রবেশের ওপর নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এর পাশাপাশি বেশ কিছু শব্দ যেমন: ‘নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন’, ‘চরমপন্থী’, ‘উগ্র ভাবাদর্শ’, ‘উসকানিমূলক বক্তব্য’, ‘গুজব’ ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের এই চেষ্টা এবং প্রশ্নাতীতভাবে এসব শব্দের প্রচলন ও রাজনৈতিক ব্যবহারকে আসলে কোনো নির্দোষ কর্ম হিসেবে দেখার কিছু নেই। এগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তির মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার সুস্পষ্ট আলামত। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বকীয় এবং স্বাধীন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ন্যূনতম মূল্যবোধ হারিয়ে যাওয়ার প্রমাণ।

উল্লেখ্য, সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে এক কক্ষবিশিষ্ট রুমগুলোর ৬১ শতাংশতেই বহিরাগতরা অবস্থান করছে। আর এই অছাত্রদের উল্লেখযোগ্য অংশ ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক নেতা-কর্মী বা তাঁদের বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজন। বহিরাগতরা তো এভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করছেই। এই প্রশাসন যদি বহিরাগতদের উচ্ছেদের ব্যাপারে আন্তরিক হয়, তাহলে তাঁদের এই হল থেকেই উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা উচিত। যেসব প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী কিংবা সাধারণ নাগরিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়াতে আসেন, তাঁদের ক্যাম্পাসে ঢুকতে বাধা দিলে এবং অছাত্র বহিরাগত নেতা-কর্মীদের আবাসিক হলগুলোতে রেখে দিলে বহিরাগতসংক্রান্ত মূল সমস্যাটির কোনো সমাধানই হবে না।

এ রকম প্রেক্ষাপটে ‘বহিরাগত’ বা ‘জঙ্গি’ ইত্যাদি শব্দের রাজনৈতিক সুবিধা অনুযায়ী ব্যবহারকে প্রশ্ন করা জরুরি।

আবাসিক হলগুলোতে বহিরাগত কারা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা খুব ভালো করে জানে। শিক্ষার্থীদের শায়েস্তা করার জন্য রামদাসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কারা মোটরসাইকেলে চড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে, সেটা খুবই স্পষ্ট। এদের হাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্ত করার জন্য রকেট সায়েন্স জানা বা প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার প্রয়োজন হয় না, সত্যিকারের শিক্ষকসুলভ সদিচ্ছাই যথেষ্ট।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রশাসনিক শিক্ষকেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং ওপরের মহলের নির্দেশ উপেক্ষা করে স্বাধীনভাবে চলার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছেন। এই অবস্থার বিপরীতে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিণতি যাই হোক না কেন, এটা কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। আর তাই ‘বহিরাগত’, ‘চরমপন্থী’, ‘নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন’, ‘জঙ্গি’ এসব শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যেও তাঁরা প্রশাসনিক ভীতি তৈরি করার চেষ্টা করছেন, যাতে কেউ প্রতিবাদী হয়ে উঠতে না পারেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং আবাসিক হল ও ক্যাম্পাসজুড়ে চলমান নীরব বা সরব সহিংসতা যথারীতি বজায় থাকে। প্রতিবাদী শিক্ষার্থীকে ‘জঙ্গি’ হিসেবে চিহ্নিত করে যেন হাতুড়ি দিয়ে পেটানো থেকে শুরু করে গুম বা খুন করে ফেলা যায়। কাউকে একবার ‘জঙ্গি’ বানিয়ে ফেলতে পারলে সব রকম অন্যায়, অনাচার, হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি সব প্রশ্ন ও জবাবদিহির ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়া যায় খুব সহজে।

এটা কারোরই অজানা নয় যে, বিশেষ করে ছেলেদের আবাসিক হলগুলোতে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের অঙ্গুলিহেলন ছাড়া গাছের পাতাও নড়তে পারে না! যা কিছু হয় তা তাদের ছত্রচ্ছায়ায় হয়ে থাকে, হল প্রশাসনও তাদের কাছে যথারীতি জিম্মি।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সাম্প্রতিক সময়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনকারীদের ওপর চালানো সব হামলার আক্রমণকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে, আক্রমণে আহতদের সুচিকিৎসার দায় বহন করতে হবে, আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা ষড়যন্ত্রমূলক মামলা প্রত্যাহার করতে হবে এবং মামলা পরিচালনায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনি সহায়তা দিতে হবে। আন্দোলনকারীদের ওপর হলে-রাস্তায়-সাইবার স্পেসে সব নীরব-সরব হয়রানি বন্ধ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক ও নিপীড়নমুক্ত পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। ক্যাম্পাস বন্ধ করে নয়, বরং হল থেকে বহিরাগতদের বহিষ্কারের মাধ্যমে দমন-পীড়ন বন্ধ করতে হবে।

Advertisement